
মানবসম্পদ উন্নয়ন একটি প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশের জনগোষ্ঠী একটি বিশাল সম্পদে পরিণত হতে পারে। মানবসম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে একটি মানবগোষ্ঠীর সুপ্ত প্রতিভা, প্রচ্ছন্ন শক্তি, লুকায়িত সামর্থ্য, যোগ্যতার প্রসার ঘটে, মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা পূর্ণ হয়। মানুষের অর্থনৈতিক দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত করা হলো অর্থনীতির অন্যতম মূল বৈশিষ্ট্য। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে হলে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা আবশ্যক। উন্নত দেশের এটিই মূল চালিকাশক্তি। ব্যক্তিগত জীবনেও উন্নতির জন্য স্ব-স্ব ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন একান্ত প্রয়োজন। তবে দক্ষতা রাতারাতি অর্জন করা সম্ভব নয়।
মানবসম্পদ একটি অন্যতম অর্থনৈতিক প্রত্যয়। একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো মানবসম্পদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন দক্ষতা, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা, পরিশ্রম, দূরদর্শিতা এবং কাজের প্রতি একাগ্রতা। আর এই উন্নয়নকে যদি টেকসই করতে হয় এবং দীর্ঘমেয়াদে এগিয়ে নিতে হয় তাহলে দক্ষ মানবসম্পদ অপরিহার্য। অর্থ সম্পদ ও ভৌত সম্পদের প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও যদি মানবসম্পদের অভাব থাকে তবে সেক্ষেত্রে উন্নয়ন প্রক্রিয়া মন্থর হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে সরকারকে আরও অধিক কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। কেননা কেবল দেশেই নয়, বিদেশের শ্রমবাজারেও রয়েছে দক্ষ জনশক্তির বিরাট চাহিদা। সেই চাহিদা পূরণে দক্ষতা তৈরির সরকারী উদ্যোগ এখনও পর্যাপ্ত নয়। জনশক্তি রফতানিতে বেসরকারী খাত মূল ভূমিকা পালন করলেও বিদেশের শ্রমবাজার উপযোগী দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে তাদের ভূমিকাও গৌণ। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুযোগ কাজে লাগাতে হলে জরুরী ভিত্তিতে কতক বিষয় নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সবার আগে প্রয়োজন কর্মসংস্থান সৃষ্টি। আর এ জন্য বিনিয়োগ বাড়ানো জরুরী। বিদেশী বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি ও প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য মানবসম্পদ উন্নয়ন আবশ্যক। অর্থনীতিবিদগণ তাদের নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে একে ব্যাখ্যা করেছেন। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ পল জে মায়ার মানবসম্পদকে একটি দেশের শ্রেষ্ঠ সম্পদ বলে অভিহিত করেছেন। আধুনিক অর্থনীতিবিদগণ মনে করেন যে, অন্যান্য সম্পদের মতো মানুষও সম্পদ। তবে মানব শক্তি তখনই মানবসম্পদে পরিণত হবে, যখন তা সুপরিকল্পিত উপায়ে পরিচালিত হবে। মানবসম্পদকে উন্নয়নের ইঞ্জিন হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। বর্তমানে এই সম্পদকে একটি দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সীমিত আয়তনের জাপান, হংকং, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি দেশের উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি হলো তাদের দক্ষ মানব সম্পদ। তাই উন্নয়নের স্বার্থে মানব সম্পদের উন্নয়ন ঘটাতে হবে।
উন্নয়ন মূলত মানুষ কেন্দ্রিক। এজন্য পল্লী উন্নয়ন, প্রাকৃতিক সম্পদ উন্নয়ন, কৃষি উন্নয়ন, শিল্প উন্নয়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে অবদান রাখতে হবে মানুষকেই। এসব উন্নয়ন ঘটাবেও মানুষ। অতএব, একটি দেশের বস্তুগত সম্পদ এবং সম্ভাবনা যতই থাকুক না কেন, যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ এ সম্পদ ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে না পারবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এ থেকে কোন সুফল পাওয়া যাবে না। আর মানুষ তা করতে পারবে তখনই যখন তারা মানবসম্পদে পরিণত হবে। তাই দেশের স্বার্থে জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করতে হবে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার মতে মানব সম্পদ উন্নয়ন হলো ব্যক্তিকে কর্মে নিযুক্ত করার সম্ভাবনা বৃদ্ধির প্রক্রিয়া। অর্থাৎ মানবসম্পদ উন্নয়ন হলো এমন এক প্রক্রিয়া বা প্রচেষ্টা, যার মাধ্যমে কোন সমাজের সকল মানুষের জ্ঞান, দক্ষতা ও ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। শিক্ষা মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি উদার করতে সহায়তা করে। শিক্ষা মানুষের চেতনা ও বিবেকের পরিবর্তন ঘটায়। ফলে শিক্ষিত ব্যক্তি সমাজের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে ভাবতে শেখে, সমাজ উন্নয়নমূলক কাজে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে শেখে। শিক্ষা লাভের ফলে ব্যক্তি নাগরিক অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে জানতে পারে, নাগরিক দায়িত্ববোধ উপলব্ধি করতে পারে। নিজের ও রাষ্ট্রীয় কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারে। একজন সাক্ষর শ্রমিক নিরক্ষর শ্রমিকের চেয়ে বেশি দক্ষ। আবার মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা সম্পন্নকারী কর্মীরা যারা তা সম্পন্ন করেনি তারচেয়ে বেশি দক্ষতাসম্পন্ন। কেননা, শিক্ষিত ব্যক্তি নিরক্ষর বা কম শিক্ষিত ব্যক্তির চেয়ে বেশি সচেতন। তার চিন্তা, বিচার বিশ্লেষণ, আত্মমূল্যায়ন ও সংশোধন ক্ষমতা অনেক বেশি। তাছাড়াও নিজ পেশা সম্পর্কে একজন শিক্ষিত ব্যক্তি যে জ্ঞান অর্জন করতে পারে পড়াশোনার মাধ্যমে তা তার দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। সর্বজনীন শিক্ষা সুষম সমাজ গঠনে সহায়তা করে।
প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষা মানুষের দক্ষতাকে বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। শিক্ষার হার বৃদ্ধি এবং সুনির্বাচিত উচ্চশিক্ষা দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক। কোরিয়া, জাপান, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশ এর উদাহরণ। এসব দেশের মানবসম্পদ উন্নয়নে শিক্ষা এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। মানুষকে উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনায় আনলে উন্নয়ন কর্মসূচী বাস্তবায়নে মানবসম্পদ প্রসঙ্গটি প্রধান হিসেবে দেখা দেয়। আর দেশের জনসংখ্যাকে মানবসম্পদে রূপান্তর করতে হলে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। নিজের বিবেক-বুদ্ধির বিকাশ ঘটিয়ে সে সমাজ ও পরিবারের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। এদেশের বিপুলসংখ্যক জনসংখ্যাকে মানবসম্পদে পরিণত করতে পারলে তা দেশ ও জাতির উন্নয়নে বড় অবদান রাখতে পারবে। উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই তা সম্ভব। বর্তমান বিশ্বে কোন দেশই কেবল প্রাকৃতিক সম্পদের দ্বারা সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারে না। মানবসম্পদের গুরুত্বও অপরিসীম। মানবসম্পদ উন্নয়ন হলো দেশের সার্বিক উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার। আর মানবসম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে বর্তমানে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক এবং যুগোপযোগী শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা দেশের বিপুল জনসংখ্যাকে মানবসম্পদে পরিণত করতে পারেনি। তাই মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। সমাজের অবহেলিত মানুষও শিক্ষা লাভের মাধ্যমে নিজের জীবনমান এবং আয় বাড়াতে সমর্থ হয়। এটি সমাজের বৈষম্য দূর করে। মানবসম্পদ উন্নয়ন হলো জনসম্পদের এমন এক গুণগত পরিবর্তন প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে তারা উৎপাদন ও দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত হতে পারে। এসব জনশক্তি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় জোরালো ভূমিকা রাখতে সমর্থ হয় এবং মানবীয় শক্তি সামর্থ্যরে সর্বোত্তম বিকাশ সাধনে সক্ষম হয়ে উঠে।
লেখক : শিক্ষার্থী
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়