(গত শুক্রবারের পর)
এখানে অবস্থানকালে তিনি স্বপ্নযোগে কারও কারও দেয়া তথ্যানুযায়ী মুরাকাবারত অবস্থায় হিন্দুস্তানে আসবার নির্দেশপ্রাপ্ত হন। এই নির্দেশ স্বয়ং প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামই তাঁকে দান করেন। এরই মাধ্যমে গওসুল আজম আবদুল কাদির জিলানী আল বাগদাদী রহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁকে যে হিন্দুস্তানের রুহানী কর্তৃত্ব দান করেছেন তা নিশ্চিতভাবে স্বীকৃতি লাভ করল। তিনি লাহোরে এসে খানকা শরীফ স্থাপন করেন। উল্লেখ্য, ১১৯১ খ্রিস্টাব্দে চৌহান রাজ পৃথ¦ীরাজের সঙ্গে গজনীর সুলতান শিহাবুদ্দীন মুহম্মদ ঘুরীর তরাইন নামক স্থানে যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে ঘুরী সাফল্য অর্জন করতে না পারলে ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে খাজা মুঈনুদ্দীন চিশ্তী রহমাতুল্লাহি আলায়হির দোয়ার বরকতে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে তিনি বিজয় পতাকা উড্ডীন করেন এবং তদানীন্তন ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের সুদৃঢ়প্রসারী বুনিয়াদ স্থাপন করেন। আর এর পেছনে যে মহান সূফীর দোয়া ছিল তিনি হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশ্তী রহমাতুল্লাহি আলায়হি। জানা যায়, তিনি লাহোর থেকে ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে দিল্লীতে এসে কিছুকাল অবস্থান করে ১১৯৫ খ্রিস্টাব্দে আজমীর শরীফে এসে স্থায়ী খানকা শরীফ স্থাপন করেন। দলে দলে লোক তাঁর মুরিদ হতে থাকে এবং অন্যান্য ধর্মের বহুলোক ইসলাম গ্রহণ করে। অল্প দিনের মধ্যে আজমীর শরীফ সমগ্র উপমহাদেশের রুহানী রাজধানীতে পরিণত হয়। তিনি ৬৩৩ হিজরীর ৬ রজব রাতের বেলায় গভীর মুরাকাবারত অবস্থায় তাঁর হুজ্রা শরীফেই ইন্তেকাল করেন এবং সেখানে তাঁকে দাফন করা হয়। আজমীর শরীফ কালক্রমে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের তীর্থস্থানে পরিণত হয়।
হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশ্তী রহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেছেন : আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভ করার জন্য শরিয়তের পূর্ণ পাবন্দ হওয়া অবশ্য কর্তব্য। শরিয়ত ও তরিকত বর্জন করে সূফী হওয়া যায় না।
মাজার শরীফ সংরক্ষণ ও সৌন্দর্যকরণের কাজ তাঁর ইন্তেকালের পর পরই শুরু হয়। ১৪৫৫ খ্রিস্টাব্দের সুলতান মাহমুদ খিলজী (১৪৩৬-৬৯) মাজার শরীফের প্রবেশ পথে বুলন্দ দরওয়াজা নামে এক বিশাল সুরম্য তোরণ নির্মাণ করেন। ওইখানে একটি মসজিদ ও মাজার শরীফের ওপর একটি গম্বুজও নির্মিত হয়। পরবর্তীকালে মুঘল সম্রাট আকবর খাজা মুঈনুদ্দীন চিশ্তী রহমাতুল্লাহি আলায়হি রুহানী শক্তির ফলাফল লাভ করেন। যে কারণে তিনি হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশ্তীর প্রতি ভীষণভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। সম্রাটের কোন সন্তানাদি হচ্ছিল না। তখন তিনি একজন চিশতিয়া তরিকার পীরের কাছে থেকে সন্তান লাভের জন্য তদ্বির নিয়ে সন্তান লাভ করেন। সেই পীর হচ্ছেন শাহ সেলিম চিশতী। যার মাজার সম্রাট আকবরের মাজারের কাছেই রয়েছে। সে যাক, সেলিম চিশতীর নামে তিনি পুত্রের নাম রাখেন নুরুদ্দীন মুহম্মদ সেলিম। এই সেলিমই পিতার মৃত্যুর পর জাহাঙ্গীর উপাধি ধারণ করে হিন্দুস্তানের বাদশাহ হয়েছিলেন।
সম্রাট আকবর পুত্র সন্তান লাভ করায় এত খুশি হয়েছিলেন যে ১৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে আগ্রা থেকে দীর্ঘ পথ হেঁটে আজমীর শরীফ এসে খাজা মুঈনুদ্দীন চিশ্তী রহমাতুল্লাহি আলায়হির মাজার শরীফ জিয়ারত করেন এবং এর উন্নয়নের জন্য প্রচুর অর্থ বরাদ্দ করেন। তিনি দশ হাজার লোকের খাবার একটা পাত্রে রান্না করার উপযোগী একটি ডেকচি তৈরি করেন এবং তা মাজারের বাইরের চত্বরে স্থাপন করেন একটি চুল্লির ওপর। তিনি বেশ কিছুদিন আজমীর শরীফে অবস্থান করেন এবং ওই ডেকচিতে খাদ্য রান্না করে নিজ হাতে জিয়ারতকারী সবার মধ্যে খাবার পরিবেশন করেন বলে জানা যায়।
পিতার ইন্তেকালের পর জাহাঙ্গীর বাদশাহ্ হয়ে ১৬১৪ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহি আলায়হির মাজার শরীফ জিয়ারত করতে আজমীর শরীফ আসেন এবং পাঁচ হাজার লোকের খাবার রান্নার উপযোগী একটি ডেকচি এখানে স্থাপন করেন। মুঘল আমলে মাজার শরীফ এবং এর আশপাশের সম্প্রসারণ ও সৌন্দর্যকরণের কাজ সবচেয়ে বেশি হয়। সম্রাট শাহজাহান ও সম্রাট আওরঙ্গজেব মসজিদ স্থাপন করেন। সম্রাট শাহ্জাহান সমগ্র মাজার এলাকা শ্বেতপাথর দিয়ে বেঁধে দেন।
আজও লাখ লাখ লোক খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতি রহমাতুল্লাহি আলায়হি মাজার শরীফ জিযারত করতে ভিড় জমায়। হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশ্তী (রহ.) উপমহাদেশে চিশ্তীর ইরকা নিয়ে আসেন। ইলমে তাসাওউফে যে প্রধান প্রধান তরিকা বা পদ্ধতি রয়েছে তার মধ্যে কাদিরিয়া, চিশ্তিয়া, নকশবন্দিয়া, মুজাদ্দাদিয়া, সুহ্রাওয়ারর্দীয়া প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। চিশ্তিয়া তরিকার প্রচলন বাংলাদেশেও রয়েছে। কিন্তু একশ্রেণীর ভ- ও প্রতারক খাজা বাবা, চিশ্তী, আজমেরী উপাধি ধারণ করে পীর সেজে মানুষকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালিয়ে আসছে। এদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করা উচিত। প্রকৃত পীরের কাছ থেকে এই তরিকার নিসবত অনুযায়ী যদি যথাযথ তালিম নেয়া যায় তাহলে অতি সহজেই আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা ও রসূলের মুহব্বত হাসিল করা সম্ভব হয়।
খাজা মুঈনুদ্দীন চিশ্তী (রহ.) সম্পর্কে আমাদের জাতীয় জাগরণের কবি ফররুখ আহ্মদ সুলতানুল হিন্দ কবিতায় বলেন, নয়া জিন্দিগীর স্বপ্নের আনিলে নতুন সূর্যোদয়! সেই থেকে তুমি আছো হিন্দের একক সুলতান। কোন সম্রাটের ধ্বজা দেখেনি এ জীবন অক্ষয়, কোন প্রেমিকের বহ্নি জ্বলেনি এমন অনির্বাণ।
(সমাপ্ত)
লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ