চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে মাদক নির্মূলে র্যাবের অভিযান শুরু হয়েছে। মাদকের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হুশিয়ারি ও অভিযান পরিচালনার নির্দেশনার পর সারাদেশে এখন কঠোর অবস্থানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। দেশজুড়ে চলছে সাঁড়াশি অভিযান। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ১৭শ’ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে। মাদকসহ ৪৯৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অভিযান পরিচালনাকালে র্যাবের সঙ্গে গুলি বিনিময়কালে ৬ জন মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন। সব মিলিয়ে মাদক-নির্মূলে বিরাট পদক্ষেপ। তবে পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা ও সক্রিয়তাও যে এই মারণ থাবা থেকে বাঁচার বড় পথÑ সেটিও আমাদের মনে রাখতে হবে।
সিগারেট থেকে নেশা শুরু করলেও মাদকের প্রতি আসক্তি ধীরে ধীরে শুরু হয়। বেশিরভাগই শুরু হয় বন্ধুবান্ধবের সাহচর্যে। মূলত মাদক কেনার অর্থ জোগাড় করতে গিয়েই কিশোর-তরুণরা ব্যাপকভাবে নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। এ সুযোগে মাদক ব্যবসায়ী, সংঘবদ্ধ অপরাধীচক্র খুন, অপহরণ ও চাঁদাবাজিসহ নানা কাজে তাদের ব্যবহার করতে থাকে। মাদকের এই নেশার জালে একবার জড়িয়ে পড়লে কেউ আর সহজে বেরিয়ে আসতে পারে না। ফলে মাদকসেবীরা দিনে দিনে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। দেশের সর্বত্র সন্ত্রাসী কার্যক্রম, স্কুল-কলেজগামী মেয়েদের নানাভাবে উত্ত্যক্ত করা, গুলি বা ছুরিকাঘাতে হত্যা কিংবা সড়ক দুর্ঘটনার আধিক্যের পেছনেও মাদকাসক্তির ভূমিকা অন্যতম। মাদকের নেশা এখন আলো ঝলমলনগরীর প্রাণকেন্দ্র থেকে শুরু করে অন্ধকার গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে।
মাদকমুক্ত সমাজ গড়তে হলে মাদকদ্রব্যের প্রাপ্তি সহজলভ্য যাতে না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। যে কোনো মূল্যে ঠেকাতে হবে মাদকের অনুপ্রবেশ। দেশেও যাতে মাদকদ্রব্য উৎপাদন হতে না পারে, সে ব্যাপারেও পদক্ষেপ নিতে হবে। দুঃখজনক হচ্ছে, মাঝে-মধ্যে ছোটখাট মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকের চালান ধরা পড়লেও তাদের মূল কুশীলবরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। অভিযোগ রয়েছে, সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ এসব সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত থাকায় তাদের টিকিটি স্পর্শ করতে পারে না আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। এই অবস্থার পরিবর্তন জরুরি। মাদকের ভয়াল থাবা থেকে দেশকে বাঁচাতে হলে মাদক সিন্ডিকেট যতই শক্তিশালী হোক, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ব্যাপারে সামাজিক সচেতনতারও কোনো বিকল্প নেই। ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নীতিনৈতিকতার উন্মেষ ঘটাতে হবে। যারা ইতিমধ্যেই মাদকাসক্ত হয়েছে, তাদেরও সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সুস্থধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। বাড়াতে হবে মাদক নিরাময় কেন্দ্রের সংখ্যা। সর্বোপরি সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করে যার যার অবস্থান থেকে মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই করে এই যুদ্ধে জয়ী হতেই হবে।
এখন সরকারি হিসেবেই দিনে সেবন হয় ২০ লাখ ইয়াবা বড়ি। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকে স্রোতের মতো ইয়াবা ঢুকছে বাংলাদেশে। যেখানে ২০১০ সালে ৮১ হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট আটক হয়েছিল, সেখানে ২০১৬ সালে আটকের সংখ্যা দাঁড়ায় তিন কোটি। মিয়ানমারের বিদ্রোহী ও কিছু অপরাধী গোষ্ঠী ইয়াবা বিস্তারের প্রধান রুট করেছে বাংলাদেশকে। তিন কোটি ইয়াবা আটক হলে বছরে কতো কোটি ইয়াবা আসে বাংলাদেশে? ধারণা করা হয়, বছরে কেবল বাংলাদেশে বিক্রিত ইয়াবার দাম আসে ২১ হাজার ৬শ’ কোটি টাকা। এক দিনেই মিয়ানমার বিক্রি করছে ৬০ কোটি টাকার ইয়াবা।
আমরা মনে করি দেশ থেকে সম্পূর্ণরূপে মাদক নির্মূল করতে হলে নিয়মিত বিশেষ অভিযান পরিচালনার কোনো বিকল্প নেই। মাদক বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে সরকার ঘোষিত জিরো টলারেন্স নীতির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন জরুরি। সেইসঙ্গে মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও সুপথে ফিরিয়ে আনার জন্যেও অভিযান জোরদার কার্যক্রম প্রয়োজন।