ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৮ জুলাই ২০২৫, ১২ শ্রাবণ ১৪৩২

বঞ্চনার শিকার গফরগাঁওয়ের শহীদের স্ত্রী-সন্তান

শেখ আব্দুল আওয়াল

প্রকাশিত: ২৩:৫১, ২৭ জুলাই ২০২৫

বঞ্চনার শিকার গফরগাঁওয়ের শহীদের স্ত্রী-সন্তান

সন্তান কোলে শহীদের স্ত্রী সাদিয়া খাতুন

যখন স্বামী শহীদ হলেন তখন তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা সাদিয়া খাতুন। বিয়ের মাত্র ছয় মাস পর স্বামীকে হারিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় তিনি। সারাক্ষণ বাড়িতে পুলিশের আনাগোনা, হাজারো হুমকি-ধামকি আর নানা প্রশ্ন। শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে গেলেন তিনি। অন্তঃসত্ত্বা সাদিয়া দিশেহারা হয়ে গেলেন স্বামীর শেষ স্মৃতি গর্ভের সন্তানের নিরাপত্তার কথা ভেবে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ায় বাবা শাহাব উদ্দিন ওরফে আব্দুর রাজ্জাক এসে তাকে নিয়ে গেলেন ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার পুনাইল গ্রামে নিজ বাড়িতে। এমন কঠিন দুঃসময়ে পাশে দাঁড়ায়নি শ্বশুর বাড়ির লোকজন। পাননি কোনো সান্ত¡নাও।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারত পালিয়ে গেলে নতুন স্বাধীন দেশে স্বস্তির নিশ্বাস নেন সাদিয়া খাতুন। কিন্তু তখন বুঝতে পারেননি স্বামীর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশে বঞ্চিত হবেন তিনি ও তাদের সন্তান। স্বামী শহীদ হওয়ার ছয় মাস পর ১৯ জানুয়ারি তার একটি কন্যা সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। নাম রাখেন- সাবরিনা বিনতে সিদ্দিকী।

সরকার শহীদ পরিবারের জন্য ৫ লাখ টাকা অনুদান দিলেও আজও একটি টাকাও পাননি তিনি। শ্বশুর আব্দুল হালিম সব টাকা উত্তোলন করে নিজের নামে ব্যাংকে জমা করেছেন। অপরদিকে সরকার ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র দিলেও তার নমিনি কে হবে, তা নিয়ে চলছে জটিলতা। বাবা ও স্ত্রী দুইজনই নমিনি হওয়ার দাবি করছেন।
কোলের শিশুকে নিয়ে ইউএনও কার্যালয়সহ নানা জনের কাছে  ঘোরাঘুরি করেছেন সাদিয়া, কেউ পাশে দাঁড়ায়নি তার। শিশু সন্তানের লালন-পালনের ব্যয় কোথা থেকে আসবে, কেউ খোঁজ নেয়নি। স্বামীর শোক আর সন্তানের ভবিষ্যৎ ভাবনায়, এখন পাগলপ্রায় তিনি। তবে এর মধ্যে ময়মনসিংহ জেলা পরিষদ থেকে একজন সমন্বয়কের মাধ্যমে কিছু অনুদান পেয়েছেন সাদিয়া।
বর্তমানে সন্তানকে নিয়ে বাবার বাড়িতেই আছেন সাদিয়া খাতুন। ছোট্ট শিশুটি বাবার স্নেহ, আদর-ভালোবাসা কোনোদিন পাবে না, তার ভবিষ্যৎ নিয়ে এখন উদ্বিগ্ন তিনি। লালন-পালন আর ভবিষ্যতে লেখাপড়ার খরচ আসবে কোথায় থেকে, এমন হাজারও চিন্তায় দিশেহারা সাদিয়া। সরকার থেকে প্রাপ্ত  ৫ লাখ টাকা তার শ্বশুর উত্তোলন করে নিজের নামে ব্যাংকে রেখে দিয়েছেন অথচ শহীদ নূরে আলম সিদ্দিকীর শিশু সন্তানের লালন-পালনের খরচ কোথা থেকে আসবে, সেখবর কখনো নেন না তিনি।
এ ব্যাপারে জানতে নূরে আলম সিদ্দিকীর বাবা আব্দুল হালিমকে একাধিকবার কল দিলেও ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।
গৌরীপুর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছাত্র প্রতিনিধি বাহালুল মুন্সী বলেন, শহীদ নূরে আলম সিদ্দিকী রাকিবের সন্তানের লালন-পালন ও একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা আমাদের সকলের দায়িত্ব। নূরে আলম সিদ্দিকীর পরিবারের সঙ্গে তার স্ত্রীর কিছু বিষয়ে মতবিরোধ রয়েছে, এগুলো সমাধানের জন্য চেষ্টাও হয়েছে একাধিকবার।
গৌরীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আফিয়া আমীন পাপ্পা বলেন, শিশু সন্তানকে নিয়ে শহীদ নূরে আলম সিদ্দিকীর স্ত্রী কষ্ট করছেন, বিষয়টি অমানবিক। দুই পরিবারের বিরোধ সমাধান করতে একাধিকবার উভয় পরিবারকে নিয়ে বসা হয়েছে কিন্তু কোনো মীমাংসা হয়নি। আমরা আন্তরিকভাবেই সে চেষ্টা করছি। অনুদানের ৫ লাখ টাকা নূরে আলম সিদ্দিকীর বাবা আব্দুল হালিমের নামে সোনালী ব্যাংকে সঞ্চয় পত্রের মাধ্যমে জমা আছে। স্ত্রী-সন্তানের প্রাপ্য হিস্যা ডিসি স্যারের (জেলা প্রশাসক) সঙ্গে পরামর্শ করে দ্রুত দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।
উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের ২০ জুলাই সারাদেশে ১৪৪ ধারা জারি করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। এদিন সকাল থেকেই ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার কলতাপাড়া বাজারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে জড়ো হতে থাকেন ছাত্র-জনতা।
একপর্যায়ে কার্ফু ভেঙে তারা ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়ক অবরোধ করে মিছিল করেন। খবর পেয়ে গৌরীপুর থানা পুলিশের একটি দল গিয়ে প্রথমে তাদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ করে ও পরে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালায়। এতে উপজেলার রামগোপালপুর ইউনিয়নের নন্দীগ্রাম গ্রামের নূরে আলম সিদ্দিকী রাকিব, ডৌহাখলা ইউনিয়নের কলতাপাড়া গ্রামের বিপ্লব হাসান ও মইলাকান্দা ইউনিয়নের কাউরাট গ্রামের জুবায়ের শহীদ হয়েছেন। এদিন আহত হয়েছেন আরও অর্ধশতাধিক আন্দোলনকারী।

প্যানেল হু

×