ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৮ জুলাই ২০২৫, ১২ শ্রাবণ ১৪৩২

গ্রাফিতি ও দেওয়াল লিখনে জ্বলে ওঠে প্রতিবাদের আগুন

আল জুবায়ের

প্রকাশিত: ২৩:৩৩, ২৭ জুলাই ২০২৫

গ্রাফিতি ও দেওয়াল লিখনে জ্বলে ওঠে প্রতিবাদের আগুন

গ্রাফিতি ও দেওয়াল লিখনে জ্বলে ওঠে প্রতিবাদের আগুন

জুলাইয়ের শেষদিকে শিক্ষার্থীদের নির্যাতন, গণগ্রেপ্তারসহ বিভিন্নভাবে বলপ্রয়োগ শুরু করলে অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা সমন্বয়কদের আটকে রাখে ডিবি। একদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চাপ অন্যদিকে সরকারের দলীয় নেতাকর্মীদের তাদের সঙ্গে আঁতাত সবমিলিয়ে ব্যাপক সমস্যায় পড়ে আন্দোলনকারীরা। তবে ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়া আন্দোলনকারীরা দমে না যেয়ে গোপনে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করার চেষ্টা করে। 
সরকারের নৃশংসতার প্রতিবাদ জানাতে গত বছরের ২৮ জুলাই (রবিবার) সারাদেশে গ্রাফিতি ও দেওয়াল লিখন এবং অনলাইন-অফলাইনে গণসংযোগ কর্মসূচি পালন করে তারা। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দেওয়াল লিখন ও গ্রাফিতিতে ফুটিয়ে তোলা হয় অগ্নিঝরা প্রতিবাদ। তবে রাজধানীতে দেওয়াল লিখনের সময় পুলিশি বাধার মুখে পড়লেও পিছপা হননি তারা। এদিন রাজধানীর পলাশীতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) দেওয়াল লিখন ও গ্রাফিতি কর্মসূচি পালন করেন কার্টুনিস্ট এবং চারুকলার শিক্ষার্থীরা। তবে পুলিশি বাধায় তাদের ওই কর্মসূচি আর শেষ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। পুলিশ তাদের রংতুলি জব্দ করে। 
এ ছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দেওয়াল লিখন ও গ্রাফিতি করা হয়। দেয়ালগুলোর গ্রাফিতিতে ‘সোনার বাংলা আজ মৃত্যুপুরী কেন?’, ‘আমার ভাইদের মারলি কেন?’, ‘সেভ দ্য কান্ট্রি জয়েন দ্য ফাইট’, ‘পুলিশি হত্যার বিচার চাই’, ‘একদিকে নাটক করে অন্যদিকে গুম করে’, ‘৫২ দেখিনি ২৪ দেখেছি’, ‘সম্পদের হিসাব পরে লাশের হিসাব আগে’, ‘হামার বেটাক মারলু ক্যান’ ইত্যাদি লেখা হয়। গ্রাফিতিতে স্থান পায় ছাদে গিয়ে গুলিতে নিহত ছোট্ট রিয়ার কথাও।
আবু সাঈদের হাত উঁচিয়ে গুলির সামনে বুক পেতে দেওয়ার গ্রাফিতি আঁকেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) শিক্ষার্থীরা। 
এদিকে গোয়েন্দা পুলিশের ‘হেফাজতে’ থাকা অবস্থায় এদিন রাতে কর্মসূচি প্রত্যাহার করার একটি ভিডিও বার্তা দেন কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। তবে অন্য দুইজন সমন্বয়ক অভিযোগ করেন, জিম্মি করে নির্যাতনের মুখে এই বক্তব্য দেয়ানো হয়েছে।
পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল কাদেরের গণমাধ্যমে পাঠানো বার্তায় সারাদেশে সোমবার ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ কর্মসূচি ও প্রতিবাদ সমাবেশ ঘোষণা করা হয়। অন্যদিকে ডিবি হেফাজতে থাকা সমন্বয়কদের পরিবারের সদস্যরা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে গেলেও তাদের সঙ্গে দেখা করতে দেয়নি। এদিন ভোরে কোটা সংস্কার আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুমকে ডিবি হেফাজতে নেওয়া হয়। মিরপুরের একটি বাসার গেট ভেঙে তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় বলে পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়।
দেশে ১০ দিন বন্ধ থাকার পর ২৮ জুলাই চালু করা হয় ইন্টারনেট সেবা। তবে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টিকটকসহ বিভিন্ন সেবা বন্ধ রাখা হয়। এদিন বিকেল ৪টা থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের তুলে নেওয়ার প্রতিবাদে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা সমাবেশ-বিক্ষোভ করে। তারা অবিলম্বে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার অন্যতম সমন্বয়ক আরিফ সোহেলকে মুক্তির দাবি জানায়। 
রাত ১১টার দিকে সমন্বয়কদের জিম্মি ও নির্যাতন করে বিবৃতি দেয়ানোর প্রতিবাদে পরদিন ২৯ জুলাই আবারো রাজপথে আসার ঘোষণা দেয় দেশের প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকার বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওই বিবৃতিতে বলা হয়, ৯ দফা দাবি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত তারা এই আন্দোলন চালিয়ে যাবে। 
এদিকে প্রায় দুইদিন গোয়েন্দা হেফাজতে থাকার পর ২৮ জুলাই রাতে একটি খাবার টেবিলে তাদের সামনে খাবার দিয়ে ছবি তোলেন তৎকালীন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন-অর-রশীদ।
এদিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রচারিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সহিংসতা এবং সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের ঘটনায় নাগরিক সমাজের সংগঠন এবং গণমাধ্যমসহ কিছু আন্তর্জাতিক অংশীদারদের উদ্বেগ প্রকাশের বিষয়টি সরকার লক্ষ্য করেছে। বিশেষ করে অপপ্রচার, ভুল তথ্য এবং বিভ্রান্তির ব্যাপক প্রচারের প্রেক্ষাপটে অকুণ্ঠ সমর্থন ও পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণার জন্য সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে কৃতজ্ঞ। 
এদিকে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ, সংঘর্ষ, সংঘাত, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত থাকে। সব মিলিয়ে রবিবার পর্যন্ত রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে গ্রেপ্তার হয় ১০ হাজার ২৮ জন। এদিন রাজধানীতে সহিংসতার বিভিন্ন ঘটনায় আরও ২২টি মামলা হয়। এ নিয়ে রাজধানীতে মোট মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় ২২৯ এবং গ্রেপ্তার সংখ্যা দাঁড়ায় ২ হাজার ৭৬৪ জনে। 
এদিন সচিবালয়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানান, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাত-সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত ১৪৭ জন মারা গেছেন। এইদিন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়, নির্বিচারে হত্যাকান্ড, মামলা ও গ্রেপ্তার চলতে পারে না।
কোটা আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাত-সহিংসতা ও সংকট শান্তিপূর্ণভাবে নিরসনে বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে বলে জানান যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু। সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের কারফিউ জারি ও নাশকতাকারীদের গুলি করতে পুলিশকে নির্দেশ দেওয়ার কথাও জানান ডোনাল্ড লু। তিনি বলেন, গুলির নির্দেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্রের মাধ্যমে উদ্বেগ জানানো হয়েছে। 
২৮ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় আহত পুলিশ সদস্যদের দেখতে রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল পরিদর্শন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী। পরে তিনি সাম্প্রতিক সহিংসতায় আহতদের দেখতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। সেখানে চিকিৎসাধীন আহতদের খোঁজ-খবর নেন। এর আগে সকালে গণভবনে আন্দোলনে নিহত আবু সাঈদসহ ৩৪ জনের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন।

প্যানেল হু

×