ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৬ জুলাই ২০২৫, ১১ শ্রাবণ ১৪৩২

আনোয়ার পঙ্গু, আর কেউ কেউ বিলাসে মত্ত, এ কেমন গণঅভ্যুত্থান?

আব্দুল আজিজ

প্রকাশিত: ২০:৫৬, ২৫ জুলাই ২০২৫

আনোয়ার পঙ্গু, আর কেউ কেউ বিলাসে মত্ত, এ কেমন গণঅভ্যুত্থান?

গত এক বছরে বাংলাদেশে অনেক কিছু বদলেছে কিন্তু বদলায়নি রাষ্ট্র, সমাজ এবং আমাদের ব্যবস্থার হৃদয়হীন কাঠামো। ১৯ জুলাই ২০২৪ একটি দিন, যা আনোয়ার হোসেন নামের এক তরুণের জীবনে চিরন্তন ক্ষতের মতো নেমে আসে। রাজধানীর গুলশান-২, শাহজাদপুর এলাকায় একটি মাত্র গুলিতে চিরতরে থেমে যায় তার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। গুলি লাগে বুকের মাঝ বরাবর, স্পাইনাল কর্ড ভেঙে চিরতরে পঙ্গু হয়ে পড়ে আনোয়ার।

রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলার কলিমহর গ্রামের এই সাহসী যুবক বেড়ে উঠেছিল এতিমখানার চার দেয়ালের ভেতর। তবুও প্রতিকূলতাকে জয় করে ভর্তি হয়েছিল সোনারগাঁও ইউনিভার্সিটিতে, কাজ নিয়েছিল একটি গার্মেন্টসে। তার স্বপ্ন ছিল নিজের পায়ে দাঁড়ানো, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে তার বিয়ে হয় আকলিমা খাতুনের সঙ্গে একজন নার্সিং শিক্ষার্থী, যিনি তখন মানিকগঞ্জে পড়তেন। গুলিবিদ্ধ হওয়ার সময় আকলিমা ছিলেন তিন মাসের গর্ভবতী।

যে সন্তানের জন্ম হওয়ার কথা ছিল বাবার আশীর্বাদ ও ভালোবাসার ছায়ায়, সে জন্ম নেয় হাসপাতালের করিডোরে বাবার অসহনীয় যন্ত্রণার পাশে। আকলিমা নিজের পড়াশোনা ছেড়ে ছয় মাস কাটান স্বামীর পাশে। প্রথমে আনোয়ারকে নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেলে, যেখানে চিকিৎসায় ছিল চরম অবহেলা। পরে ইভার কেয়ারে ভর্তি হলেও উন্নতি হয় না। চিকিৎসার দায়ভার কেউ নেয় না, দায়িত্বহীনভাবে আবার তাকে ফেরানো হয় সেই সরকারি হাসপাতালেই।

অবশেষে শেষ আশার আলো নিয়ে তাকে পাঠানো হয় থাইল্যান্ডে। সেখানকার চিকিৎসকরা জানান উন্নত থেরাপি, রিহ্যাব ও যত্ন পেলে আনোয়ার একদিন হাঁটতেও পারে। সেই আশার আলোই ছিল পরিবারটির একমাত্র বাঁচার রশ্মি। কিন্তু এখন, এই জুলাই মাসেই তার পরিবারকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। চিকিৎসা অসম্পূর্ণ থাকা অবস্থায় এমন সিদ্ধান্ত তাদের ওপর বজ্রাঘাতের মতো নেমে আসে। আনোয়ার ও তার পরিবার এখন ভীত, ভেঙে পড়েছে তারা জানে না দেশে ফিরে কী অপেক্ষা করছে তার জন্য।

একজন পঙ্গু তরুণ, একজন স্বপ্নভঙ্গ স্বামী, একজন নবজাতকের বাবা যখন বিদেশে শেষ আশায় চিকিৎসাধীন, তখনই তাকে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত যেন প্রমাণ করে এই রাষ্ট্র দায়িত্ব নয়, শুধু অবজ্ঞা করতে জানে।

আরেকদিকে, যাদের নাম আনোয়ারের রক্তের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তারা আজ বিলাসে মত্ত। সেই আন্দোলনের নেতৃত্বের দাবিদার একদল সুবিধাভোগী এখন বিদেশি গাড়িতে চড়ে, বিলাসবহুল পোশাক পরে, বিদেশে চিকিৎসা নেয়। তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় বিপ্লবী ভান করে নিজেদের “আন্দোলনের রূপকার” হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে। অথচ তারা কেউ গুলির মুখোমুখি হয়নি, রাস্তায় রক্ত দেয়নি, পরিবারের পাশে বিছানায় রাত কাটায়নি।

আনোয়ারের মতো শত শত তরুণ আজ অবহেলার ছুরিতে ক্ষতবিক্ষত আর তাদের নামে কিছু লোক রাজনীতি করছে, ক্ষমতার অলিন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে, দলীয় পদ দখল করে চলছে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি। এটাই কি আমাদের স্বপ্নের গণঅভ্যুত্থান?

যেখানে গুলি খাওয়ার পুরস্কার হয় হুইলচেয়ার, আর গুলির ভয় না পাওয়ার পুরস্কার হয় বিলাসবহুল জীবন সেখানে তো প্রশ্ন তুলতেই হয়: এ কোন সমাজ? এ কোন রাষ্ট্র?

রাষ্ট্র যদি সত্যিকার অর্থে জনগণের হতো, তবে আনোয়ারের উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করা হতো। রাষ্ট্র যদি মানবিক হতো, তবে তার পরিবারকে এই আতঙ্কে ফেলত না যে “আপনাকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়া হচ্ছে, চিকিৎসা থাকুক অসম্পূর্ণ।” আজ আনোয়ার শুধুই একজন পঙ্গু যুবক নয়, সে এক প্রতীক ত্যাগের, অবহেলার, আর রাষ্ট্রীয় নিষ্ঠুরতার এক বাস্তব চিত্র।

পরিশেষে,আমরা আনোয়ার হোসেনের উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করার জোর দাবি জানাই। তাকে থাইল্যান্ড থেকে অসম্পূর্ণ চিকিৎসা অবস্থায় দেশে ফেরত আনা রাষ্ট্রের চরম দায়িত্বহীনতা এবং অমানবিকতা। আনোয়ারের মতো গুলিবিদ্ধ প্রতিটি নাগরিকের পাশে রাষ্ট্রকে দাঁড়াতেই হবে।

আর সেইসব সুবিধাভোগী নেতা-কর্মীদের বলি আনোয়ারের পঙ্গুত্বের ওপর রাজনীতি বন্ধ করুন। যার শরীরে এখনো গুলির যন্ত্রণা বয়ে চলেছে, তার মুখোমুখি দাঁড়ান দেখুন, বিপ্লব কার হাতে গড়ে উঠেছিল। আন্দোলনের নামে বিলাসী ব্র্যান্ডের নিচে অন্যের ত্যাগকে মাড়িয়ে যাওয়া বন্ধ করুন।

এই সমাজ তখনই পাল্টাবে, যখন মুখোশ খুলে সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ানো যাবে। আনোয়ার যেন হয় না আরও একটি নাম, আরও একটি উপেক্ষিত ইতিহাস।

আফরোজা

×