
ছবি: সংগৃহীত
১৫ জুলাই ছাত্রলীগের হামলা এবং ১৬ জুলাই ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রংপুরে আবু সাঈদসহ ছয়জনের মৃত্যুর পর, দেশজুড়ে শিক্ষার্থীরা ফুঁসে ওঠে। ১৭ জুলাই সকালের আলো ফোটার আগেই জানা যায় ক্যাম্পাসগুলোয় শিক্ষার্থীদের বিজয়ের খবর: ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাত্রলীগমুক্ত হয়। ১৬ তারিখ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের হলগুলোয় এই প্রতিরোধ শুরু হলেও, দ্রুতই তা ছেলেদের হলগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে। এই অভূতপূর্ব ঘটনার পর এদিন সকালেই 'রাজনীতিমুক্ত' ঘোষণা করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়।
আশুরার কারণে সরকারি ছুটির আমেজ থাকলেও, দেশের অফিস-আদালত পাড়া যখন শান্ত, তখন ক্যাম্পাসগুলো ছিল উত্তাল। বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। ছাত্রলীগকে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করার ঘটনা সরকারকে সত্যিকারের বিপদের মুখে ফেলে দেয়। যে গুণ্ডাবাহিনী এত দিন ক্যাম্পাসগুলোতে তাদের দখল নিশ্চিত করত, তাদের বিতাড়িত হওয়ার ঘটনা ছিল নজিরবিহীন। তাই ক্যাম্পাস বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া সরকারের হাতে আর কোনো বিকল্প ছিল না। এক্ষেত্রে তারা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)-এর ওপর সওয়ার হন। ইউজিসিকে এর আগে কখনো ক্যাম্পাস বন্ধ করার ঘোষণা দিতে দেখা যায়নি। কিন্তু ১৭ তারিখ রাতের মধ্যেই ছাত্রাবাস ত্যাগ করার নির্দেশ আসে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভা করে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে এবং সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে ক্যাম্পাস ছেড়ে দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে এত কিছু ঘটে চললেও, উপাচার্য মাকসুদ কামালকে কোথাও দেখা যায়নি। তিনি আহতদের দেখতে হাসপাতালে যাননি, এমনকি ছাত্রলীগ-পুলিশের নিপীড়ন নিয়েও কোনো মন্তব্য করেননি। ব্যাপকসংখ্যক পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি সদস্যের উপস্থিতি বিষয়ে এদিন গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, "ক্যাম্পাস আমার নিয়ন্ত্রণে নেই।"
দুপুর থেকেই সারা দেশে ছাত্রবিক্ষোভ, সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ, গায়েবানা জানাজা, কফিন মিছিল এবং দফায় দফায় সংঘর্ষ ও পাল্টা-পাল্টি ধাওয়ার ঘটনা চলতে থাকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বন্ধ করে দেওয়া হয় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটও।
বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো বায়তুল মোকাররম মসজিদে গায়েবানা জানাজার আয়োজন করে। জানাজা শেষে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা একত্রভাবে মিছিল বের করলে পুলিশ তা ছত্রভঙ্গ করে দেয়। জানাজা শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল সাংবাদিকদের বলেন, "চলমান কোটা আন্দোলনের সঙ্গে বিএনপি জড়িত নয়, এই আন্দোলনের সঙ্গে শিক্ষার্থীরা জড়িত। তাদের আন্দোলনে নৈতিক সমর্থন দিয়েছে বিএনপি এবং সেই নৈতিক সমর্থন বিএনপি দিয়ে যাবে, কারণ দলটি মনে করে, এই আন্দোলন যুক্তিসংগত।"
এদিন, সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় কালো শাড়ি পরে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই ভাষণ ছিল তার অতীতের ভাষণগুলোর তুলনায় খুবই স্বল্প সময়ের, প্রায় আট মিনিটের মতো। তার চেহারা ছিল বিমর্ষ ও ভীত। এই ভাষণে তিনি তার আপনজন হারানোর বেদনাকে বড় করে তুললেও, আগের দিন শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ-ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ত্রিপক্ষীয় হামলায় নিহত ও আহতদের বিষয়ে তেমন কিছু বলেননি। উল্টো তিনি আন্দোলনের ফলে হামলা-ভাংচুর ও জনভোগান্তির ওপর গুরুত্ব দেন। তার বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিনি তরুণ সমাজের স্বপ্নিল ভবিষ্যৎ ও পেশাগত সুযোগের দাবির বিষয়টি সেদিনও অন্তরে ধারণ করেননি। তার বিচারে বরং সেইসব 'কোমলমতি' তরুণ 'কিছু বিশেষ মহল' দ্বারা বিভ্রান্ত। সেই বিশেষ মহলকে তিনি সংজ্ঞায়িত করেননি, কিন্তু তাদের 'সন্ত্রাসী কার্যক্রমের' যে উদাহরণ তিনি দিলেন, তার শিকার হিসেবে কেবল নিজের দলের ছাত্রের কথাই উল্লেখ করেন। তিনি জানান, যেকোনো তরুণ প্রাণের, তার ভাষায়, 'অহেতুক মৃত্যু'ই বেদনাদায়ক ও নিন্দনীয়। কিন্তু তার এই পক্ষপাতে বোঝা যায় তিনি সব নাগরিকের রাষ্ট্রপ্রধান নন, কেবল তার নিজের লোকের জন্যই তার ভাবনা ও কার্যক্রম আবর্তিত। চট্টগ্রামের ছাত্রলীগের সদস্যের মৃত্যুর বাইরে যে পুলিশ বাহিনী ও ছাত্রলীগের যৌথ তৎপরতায় আন্দোলনে অন্য প্রাণহানির ঘটনা উল্লেখ করার প্রয়োজন তিনি বোধ করেননি। এমনকি যে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের কথা তিনি বারবার উল্লেখ করেছেন, তা যেন কেবল আন্দোলনকারী এবং কিছু মহলেরই একার ব্যাপার ছিল। তার অনুগত ছাত্রলীগের সদস্য ও বহিরাগত ভাড়াটেরাই যে ১৫ জুলাই প্রথম আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হয়ে ব্যাপকভাবে সন্ত্রাসের জন্ম দেয়, তার ভাষণে সেসবের কোনো উল্লেখ ছিল না। তিনি জানান, বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে বের করা হবে কারা ছিল উসকানিদাতা ও অরাজক পরিস্থিতি তৈরির জন্য কারা দায়ী ছিল। তাদের বের করে যে শাস্তি দেওয়া হবে, তাও তিনি উল্লেখ করেন। কিন্তু তার উদাহরণ বাছাই দেখে সন্দেহ করার কারণ রয়েছে যে, এই তদন্ত ও শাস্তি প্রক্রিয়ায় হত্যাকারী পুলিশ ও সন্ত্রাস কায়েমকারী ছাত্রলীগের সদস্যদের রেহাই দেওয়া হবে এবং আন্দোলনকারীদেরই বেছে বেছে শাস্তি দেওয়া হবে। ফলে দেশের চরম সংকটময় পরিস্থিতিতে তার এই ভাষণ শিক্ষার্থীদের আরও বিক্ষুব্ধ করে তোলে।
এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকার ডাস চত্বর থেকে ডাকসুর সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক ও গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি সংগঠনের সভাপতি আখতার হোসেনকে আটক করে পুলিশ। দুপুর আড়াইটা নাগাদ ডাস চত্বরের পাশে আখতার হোসেনসহ তিনজন এসে অবস্থান নেন। পুলিশের পক্ষ থেকে তাদের চলে যেতে বলা হলে সেখানে তিনি শুয়ে পড়েন। এ সময় সাংবাদিকেরা তাদের চারদিকে ঘিরে দাঁড়ান। চলমান আন্দোলন সম্পর্কে তাদের বক্তব্য নেওয়ার সময় পুলিশের দিক থেকে জটলা উদ্দেশ করে চার-পাঁচটি সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়া হয়। এতে সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে আখতার হোসেনকে আটক করে নিয়ে যায় পুলিশ। উল্লেখ্য, আখতারের মুক্তি মেলে হাসিনার পতনের পর।
এদিন, বেলা ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে একটি প্রতিবাদ সমাবেশ আয়োজন করে। 'হত্যাকাণ্ড ও হামলার বিচার চাই, নিপীড়নমুক্ত ক্যাম্পাস ও রাষ্ট্র চাই' দাবি নিয়ে 'নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক সমাবেশ' ব্যানার করা হয়, যাতে নেটওয়ার্কের বাইরের শিক্ষকরাও যুক্ত হন। তাদের মধ্যে ডক্টর আসিফ নজরুলসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি-জামায়াতপন্থী শিক্ষকদের সাদা দলের সদস্যরাও ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন প্রতিবাদ সমাবেশে সভাপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। সমাবেশ থেকে গীতি আরা নাসরীন, নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নাভিন মুরশিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক চৌধুরী সায়মা ফেরদৌসের বক্তব্য অনলাইনে ভাইরাল হয়।
এদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ছাত্রাবাসে পুলিশ টিয়ার সেল নিক্ষেপ করে হলগুলোকে খালি করে দেয়। শিক্ষার্থীরা হল ছাড়তে বাধ্য হন। এদিন দিবাগত রাতে বিএনপির নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অভিযান চালায় পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ। এ সময় ছাত্রদলসহ বিএনপির সহযোগী সংগঠনের সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ফারুক