ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৩ জুন ২০২৫, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

‘কিংস চার্লস হারমনি অ্যাওয়ার্ড’ গ্রহণ করলেন ড. ইউনূস

জনকণ্ঠ রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০০:০৩, ১৩ জুন ২০২৫; আপডেট: ০১:৫৮, ১৩ জুন ২০২৫

‘কিংস চার্লস হারমনি অ্যাওয়ার্ড’ গ্রহণ করলেন ড. ইউনূস

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে বৃহস্পতিবার লন্ডনের বাকিংহাম রাজপ্রাসাদে স্বাগত জানান রাজা তৃতীয় চার্লস

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বৃহস্পতিবার ব্রিটেনের মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার ‘কিংস চার্লস হারমনি অ্যাওয়ার্ড-২০২৫’ গ্রহণ করেছেন। লন্ডনে সেন্ট জেমস প্যালেসে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ রাজা তৃতীয় চার্লস প্রধান উপদেষ্টার হাতে এই পুরস্কার তুলে দেন। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এ তথ্য জানান।
বিশ্বব্যাপী শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং পরিবেশ-প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আজীবন অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ব্রিটিশ রাজা তৃতীয় চার্লস প্রধান উপদেষ্টাকে এই সম্মাননার জন্য মনোনীত করেন। ২০২৪ সালের জুন মাসে রাজা চার্লস প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনযাপনের উদ্যাপন হিসেবে নতুন এই পুরস্কার প্রবর্তন করেন। এই পুরস্কারের প্রথম বিজয়ী ছিলেন জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি-মুন।
১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘দ্য কিং’স ফাউন্ডেশন’, যা তৎকালীন প্রিন্স অব ওয়েলসের উদ্যোগে গঠিত যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি দাতব্য সংস্থা, প্রতিবছর টেকসই উন্নয়ন ও মানবিক কর্মকা-ে অসামান্য অবদানের জন্য এই মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার প্রদান করে। এ ছাড়া ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে রাজা ও রানীর স্বাক্ষরযুক্ত একটি ছবি উপহার হিসেবে প্রফেসর ইউনূসকে উপহার দেন রাজা। বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত সম্মানজক রাজকীয় এ অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তি প্রফেসর ইউনূসের সঙ্গে ব্রিটিশ রাজপরিবারের দীর্ঘদিনের সম্পর্কের বহির্প্রকাশ হিসেবে দেখছেন পর্যবেক্ষকরা।
কিংস চার্লস হারমনি অ্যাওয়ার্ড গ্রহণ ছাড়াও বৃহস্পতিবার সকালে তিনি বাকিংহাম প্যালেসে ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় চার্লসের সঙ্গে দেখা করেন। এ ছাড়া ওয়েস্ট মিনিস্টারে হাউস অব কমেন্সের স্পিকার স্যার লিন্ডসে হলির সঙ্গে বৈঠক করেন অধ্যাপক ইউনূস। চারদিনের সরকারি সফরে বর্তমানে লন্ডনে রয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। আজ শুক্রবার সকালে তিনি দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে একান্তে বৈঠক করবেন।
বাকিংহাম প্যালেসে রাজার সঙ্গে সাক্ষাৎ ॥ এর আগে বৃহস্পতিবার সকালে লন্ডনের বাকিংহাম প্যালেসে ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় চার্লসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। অধ্যাপক ইউনূস প্যালেসে পৌঁছলে রাজা তৃতীয় চার্লস তাকে স্বাগত জানান। বৈঠকের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ও ব্রিটিশ রাজা তৃতীয় চার্লসের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকটি ছিল একান্তই ব্যক্তিগত।

বৈঠকে বাংলাদেশের চলমান গণতান্ত্রিক রূপান্তর প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়। প্রধান উপদেষ্টা তাঁর সরকার গৃহীত সংস্কার কার্যক্রম সম্পর্কে রাজা চার্লসকে অবহিত করেন। প্রায় ৩০ মিনিটের এ বৈঠকটি অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ ছিল এবং যেহেতু রাজা চার্লস বহুদিন ধরে অধ্যাপক ইউনূসকে চেনেন, তাই নানা বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। পুরো সফরের এটা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক। একান্ত সাক্ষাতের পর, রাজা ও রানীর স্বাক্ষরযুক্ত একটি ছবি উপহার হিসেবে অধ্যাপক ইউনূসকে প্রদান করা হয়, যা প্রধান উপদেষ্টার জন্য একটি বড় সম্মানের ছিল বলে জানান প্রেস সচিব।
পাচারকৃত অর্থ ফেরাতে জোর প্রচেষ্টা ॥ স্থানীয় সময় বুধবার রাতে লন্ডনে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে যুক্তরাজ্য সরকারের সঙ্গে যৌথ প্রচেষ্টা জোরদার করেছে বাংলাদেশ। পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধার একটি দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল প্রক্রিয়া জানিয়ে তিনি বলেন, পাচার হওয়া সম্পদ ফেরত আনার বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইমস এজেন্সি (এনসিএ)-এর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। পাচারের অর্থ শনাক্ত, কীভাবে পাচার হয়েছে তা খুঁজে বের করা ও জব্দ করার বিষয়ে ‘এনসিএ’-এর ভালো অভিজ্ঞতা রয়েছে।

এ বিষয়ে সংস্থাটি ইতোমধ্যে দুটি পদক্ষেপও নিয়েছে বলে জানান তিনি। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সফরসঙ্গী হিসেবে লন্ডন সফরে রয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। তথ্য সচিব আরও জানান, যুক্তরাজ্যের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জনাথন পাওয়েলের সঙ্গেও এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস।

পাচারকৃত অর্থ কীভাবে ফেরত আনা যায় তা জানতে অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতাও যাচাই করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যেই একাধিক বৈঠক হচ্ছে। বৈঠকে রোহিঙ্গা সংকট, জাতীয় ঐকমত্য গঠনে বাংলাদেশের উদ্যোগ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিয়েও তারা আলোচনা করেন।
ব্রিটিশ বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক ॥ যুক্তরাজ্যের ব্যবসা ও বাণিজ্যমন্ত্রী এবং বোর্ড অব ট্রেডের প্রেসিডেন্ট জনাথন রেনল্ডস বুধবার ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সাক্ষাৎকালে তাঁরা বন্ধুত্বপূর্ণ দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়ন ও বিনিয়োগের সুযোগ বৃদ্ধির বিষয়ে আলোচনা করেন। আলোচনায় পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় ছাড়াও বাণিজ্য বৃদ্ধির কৌশল এবং বাংলাদেশে ব্রিটিশ বিনিয়োগ বাড়ানোর উপায় অন্তর্ভুক্ত ছিল।

রেনল্ডস বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে পাচার হওয়া অবৈধ অর্থ পুনরুদ্ধারে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগের প্রতি যুক্তরাজ্যের সমর্থনের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। অধ্যাপক ইউনূস অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রচেষ্টার কথা তুলে ধরেন, বিশেষ করে ব্যাংক খাত সংস্কার, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখা এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার বিষয়গুলো। বৈঠকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী এবং এসডিজি বিষয়ক সিনিয়র সচিব লামিয়া মোরশেদ উপস্থিত ছিলেন। বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) শুরু করার প্রস্তাব দেন।

তিনি জানান, ঢাকা ইতোমধ্যেই জাপানসহ একাধিক দেশের সঙ্গে এফটিএ আলোচনা শুরু করেছে। বৈঠকে যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশ বিষয়ক বাণিজ্য দূত ব্যারোনেস রোজি উইন্টারটন এবং ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারা কুক অংশগ্রহণ করেন।
গুরুত্ব পাচ্ছে পাচার অর্থ পুনরুদ্ধার- প্রেস সচিব ॥ লন্ডনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, শেখ হাসিনার শাসনামলে ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে পাচার হয়ে গেছে। এর একটা অংশ যুক্তরাজ্যে পাঠানো হয়েছে। তাই এবার যুক্তরাজ্য সফরে বড় ফোকাস দেওয়া হচ্ছে সম্পদ পুনরুদ্ধারে। এ বিষয়ে ব্রিটিশ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বাংলাদেশকে যথেষ্ট সহযোগিতা করছেন।

এর উদাহরণ হিসেবে তিনি শেখ হাসিনা সরকারের ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের সম্পদ জব্দ করার ঘটনা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, পাচার হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধার করা সরকারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আমরা সেটি করছি, যাতে এই টাকা দেশে ফিরিয়ে এনে মানুষের কল্যাণে কাজে লাগানো যায়।

×