
ছবি: জনকণ্ঠ
জুলাইয়ের সূচনা হয়েছিল বৈষম্যের প্রতিফলে—কিন্তু যখন রাষ্ট্র নিজেই ছাত্রদের তিরস্কার করে, তখন কি ন্যায়বিচার বেঁচে থাকে? তাই তো রাস্তায় নেমেছে জনগণ, তরুণেরা বুক পেতে দিয়েছে গুলির সামনে। তাদের বয়স কি ভীরুতা শেখায়? না, শেখায় প্রতিবাদের ভাষা। যাদের কাজ ছিল আমাদের রক্ষা করা, তারা কেন আমাদেরই রক্ত ঝরাল? এই দেশ দেখেছে আঠারো—যে বয়স থেমে থাকে না, যে বয়স সংশয় চেনে না। রাষ্ট্র যখন নিঃসঙ্গে দাঁড়ায়, তখনই জন্ম নেয় প্রতিরোধ।জুলাই যোদ্ধাদের কথা তুলে ধরেছেন
-তানজিল কাজী
কোটা থেকে মাতৃভূমির সংস্কার
ক্যালেন্ডারের পাতায় জুলাই ২০২৪ নিছক একটি মাস নয়—এটি যেন এক জাতিগত আত্মচেতনার জাগরণ, স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্রশক্তির গর্জন, যা কাঁপিয়ে দিয়েছিল স্বৈরশাসনের মসনদ। নিয়ম অনুযায়ী এই মাসের শুরু হয় ১ জুলাই, কিন্তু বাস্তবতার মঞ্চে এর সমাপ্তি ঘটে ৩৬ জুলাই—অর্থাৎ ৫ আগস্টে। সময় যেন নিজেই হার মানে এই ইতিহাসের কাছে।
এর সূচনা হয়েছিল সরকারি চাকরিতে ৩০% কোটা বহাল রাখার প্রতিবাদে, যেখানে ছাত্রসমাজ আওয়াজ তোলে ন্যায়ের পক্ষে। একে একে “বাংলা ব্লকেড” হয়ে উঠলো জনতার অধিকার আদায়ের প্রতীক। ১৪ জুলাই রাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের পর ঢাবির আবাসিক হলগুলো যেন বিস্ফোরিত হয় প্রতিবাদের স্লোগানে—
তুমি কে, আমি কে? রাজাকার! রাজাকার!
কে বলেছে, কে বলেছে? স্বৈরাচার! স্বৈরাচার!
রিডিং রুমের নীরবতা ভেঙে পড়ে শিক্ষার্থীরা ছুটে আসে টিএসসির উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে। নারী শিক্ষার্থীরাও পিছিয়ে থাকেনি—হাতা খুন্তি, কলম, খোলা চুল আর নির্ভীক কণ্ঠে তারা জানান দেয়: সাহসিকতার কোনো লিঙ্গ থাকে না, প্রতিবাদের কোনো সীমা থাকে না।
১৫ জুলাই টিএসসি প্রাঙ্গণে নারীসহ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের বর্বর হামলা আগুনে ঘি ঢেলে দেয়। পরদিন বাংলার উর্বর মাটি যখন শিক্ষার্থীদের রক্তে রঞ্জিত হয়, তখন সেই রক্তই হয়ে ওঠে প্রতিজ্ঞার আগুন। ভাই হারানোর কান্না পরিণত হয় ক্ষোভের ঝড়ে, শোকের ছায়া পরিণত হয় সাহসের ছায়াছবিতে। ছাত্র আন্দোলন ধীরে ধীরে রূপ নেয় জন-অভ্যুত্থানে। সাহসিকতা, আত্মত্যাগ আর এক অদম্য প্রত্যয়ে জন্ম নেয় নতুন এক বাংলাদেশ।
এই আন্দোলনে কেউ নেতা ছিল না, কেউ অনুসারী ছিল না—সবাই ছিলো যোদ্ধা। ব্যতিক্রমহীন একতাবদ্ধতা, এক অসাধারণ সাহসিকতা, এক ঐতিহাসিক সংহতি—এসবই জন্ম দেয় এক অভাবনীয় বিজয়ের। শহীদের রক্তে লেখা হয় এক নতুন অধ্যায়, আর তাতে ভেসে যায় ক্ষমতার অহংকার, গোঁজামিলের রাজনীতি।
তবে, জুলাই থেকে জুলাই—৩৬৫ দিনের অঙ্ক মেলালেও, প্রত্যাশিত বাংলাদেশের অঙ্কে এখনও আছে গড়মিল। কোটার সংস্কার হয়তো হয়েছে, কিন্তু সমাজ সংস্কারের সংগ্রাম কি শেষ? এখনও তো আসিয়ার মত ফুলেরা ঝরে যায় ধর্ষণের ভয়াবহতায়; রাজনীতির নামে এখনও সৃষ্ট হয় বিভ্রান্তি, বিভাজন; মন্দিরের পুরোহিত থেকে মসজিদের ইমাম পর্যন্ত নিরাপত্তাহীন; পথশিশুদের মুখে এখনও অভুক্ত ভোর।
তাই লড়াই এখনও বাকি—একটি নিরাপদ, মানবিক, সহনশীল ও সমানাধিকারের বাংলাদেশ গড়ার লড়াই। সেই বাংলাদেশ, যেখানে আমি, তুমি আর আমরা একত্রে উচ্চারণ করবো—
এই দেশ আমার, এই দেশ আমাদের।
এখানে থাকবে না কোনো বৈষম্য, থাকবে না কোনো ভয়। থাকবে শুধু ঐক্য, সাহস আর মানুষের জয়।
মাসুমা বিনতে মুজিব
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
রক্তে লেখা মুক্তির শপথ
সেদিনের জুলাই—ইতিহাসের পাতায় অগ্নি অক্ষরে লেখা এক দিন। আমি ছিলাম সেই রক্তাক্ত পথে, যেখানে রাজপথ কেঁপে উঠেছিল গুলির গর্জনে। আকাশে বারুদের গন্ধ, মাটিতে শহীদের রক্ত। আমার চোখের সামনে লুটিয়ে পড়ছিল সহযোদ্ধারা—একজন, দু’জন, তারপর অসংখ্য। লাল হয়ে উঠছিল ধূসর নগরী, লাল হয়ে উঠছিল আমাদের বুকের স্বপ্ন।
কিন্তু আমরা কাঁদিনি। চোখের কোণে জ্বালা ছিল, তবুও আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম দৃঢ় প্রতিজ্ঞায়। কারণ আমরা জানতাম—এই ত্যাগ বৃথা যাবে না। আমাদের রক্তের বিনিময়ে জন্ম নেবে এক নতুন বাংলাদেশ। সেই মুহূর্তে বুকের ভেতর শুধু এক শপথ জ্বলছিল—অন্যায়ের বিরুদ্ধে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত লড়ব, ন্যায়ের আলোয় আলোকিত করব দেশ।
আজ সেই সূর্যোদয় হয়েছে। আমরা নতুন বাংলাদেশের ভোর দেখেছি। কিন্তু শহীদদের রক্তের গন্ধ আজও বাতাসে ভেসে বেড়ায়, তাদের আহ্বান আজও কানে বাজে। জুলাই কেবল ক্যালেন্ডারের একটি মাস নয়—এটা আমাদের বিদ্রোহ, আমাদের মুক্তি, আমাদের শপথ।
আমরা শপথ করি—এই রক্তের ঋণ কোনোদিন ভুলব না। যারা জীবনের বিনিময়ে আশা জ্বালিয়েছে, তাদের স্বপ্নকে আমরা কখনো ভাঙতে দেব না। জুলাই, তুমি কেবল তারিখ নও—তুমি বাংলার হৃদস্পন্দন, তুমি চিরন্তন আগুন।
এস এম জুবায়ের আহমেদ
শিক্ষার্থী, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ স্কলার্স
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অসাধারণ ভূমিকা
২০২৪ সালের জুলাইয়ের আন্দোলনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সাহসিকতার এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। ১৭জুলাই ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (UIU) প্রথম বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদের আগুন জ্বালায়। এই সাহসিকতা ব্র্যাক, নর্থ সাউথ, আইইউবি, ডিআইইউ সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরও আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার প্রেরণা দেয়।
১৮ জুলাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হল বন্ধ থাকায় আন্দোলন শিথিল হলেও, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই নেতৃত্বে থেকে যমুনা গেট, রামপুরা, মিরপুরসহ সব জায়গায় শক্ত অবস্থান গড়ে তোলে। তাঁদের এই সংগ্রাম ঢাকাকে ছাড়িয়ে দেশে ছড়িয়ে পড়ে, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদেরও আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করে।
বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ৩০ জন বেসরকারি শিক্ষার্থী শহীদ হন, ৩০০-এর বেশি আহত হন—এতে তাঁদের আত্মত্যাগের জ্বলন্ত প্রমাণ মেলে। বিশেষ করে UIU ছাত্র ইরফান ভূঁইয়া জাতির জন্য জীবন উৎসর্গ করেন।
১৮ জুলাই পালিত ‘প্রতিরোধ দিবস’ বেসরকারি শিক্ষার্থীদের প্রতি নেতিবাচক ধারণা ভেঙে দেশের সংস্কারের প্রত্যয় আরও দৃঢ় করে। কিন্তু ৫ আগস্টের পর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সেভাবে সুযোগ না পাওয়া সত্যিই দুঃখজনক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এককভাবে এই লড়াইয়ের দাবিদার নয়; ১৮ জুলাইয়ের প্রতিরোধ না থাকলে হয়তো নতুন বাংলাদেশই গড়ে উঠত না।
তারেক রহমান
শিক্ষার্থী, ইউনাইটেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
বুক চিতিয়ে নেতৃত্ব
জুলাই আন্দোলন যখন তীব্রতর হচ্ছিল, ১০ জুলাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রামপুরা ব্রিজ ব্লকেড কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে, যেখানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলও সক্রিয় ভূমিকা রাখে। ১৪ জুলাই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান নেয়। এরপর থেকে তারা বিভিন্ন মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করে রাজপথে নিয়ে আসে।
যখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হল বন্ধ হয়, তখন ১৮ জুলাই থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল সর্বাত্মকভাবে আন্দোলনের ভ্যানগার্ড হিসেবে রামপুরা, বাড্ডা, উত্তরা, মিরপুর ও সাইন্সল্যাবসহ বিভিন্ন স্থানে নেতৃত্ব দেয়। সংকটময় মুহূর্তেও তাদের অপ্রাণ চেষ্টা শতভাগ সফল হয়। ১৮ জুলাই থেকে গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত তারা মৃত্যুঝুঁকি উপেক্ষা করে বুক চিতিয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
আবদুল্লাহ আল মঈন
সাংগঠনিক সম্পাদক, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ছাত্রদল
শিহাব