
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস
উৎকণ্ঠা-অস্থিরতা কাটিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সবার সহযোগিতায় নতুন প্রত্যয় নিয়ে দ্রুত সংস্কার কাজ শেষে করে নির্বাচন আয়োজনের ম্যান্ডেট পেলেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। প্রায় সব রাজনৈতিক দলই প্রধান উপদেষ্টার ওপর আস্থাও রেখেছেন দু’দিনের ধারাবাহিক বৈঠকে। নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবির প্রেক্ষিতে প্রধান উপদেষ্টা দলগুলোকে জানিয়েছেন, ভালো সময় তৈরি হলেই নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করবেন তিনি।
রবিবার বিকেলের পর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় দু’দফায় ২০টি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন বলে বৈঠকে উপস্থিত একাধিক দলের নেতা নিশ্চিত করেছেন। বৈঠকে সব রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি, সরকারের মধ্যে সৃষ্ট সমন্বয়হীনতা দূর করার কথাও বলেছেন রাজনৈতিক দলের নেতারা। বৈঠকে দলগুলোর নেতারা প্রধান উপদেষ্টাকে পদত্যাগ না করার অনুরোধ জানিয়ে অভিন্ন কণ্ঠে বলেছেন, এতে করে সংকট আরও ঘনীভূত হবে। বৈঠক শেষে মতবিনিময় সভায় থাকা একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে এসব কথা জানা গেছে। বৈঠক শেষে প্রবীণ রাজনীতিক, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি এবং ডাকসুর সাবেক ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, সংস্কারে বেশি সময়ক্ষেপণ করলে এটা সরকারের জন্য উল্টো হতে পারে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যাবে। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আমরা একটি সংক্ষিপ্ত সংলাপে মিলিত হয়েছি। সেই বৈঠকে দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা বলেছি, পরিস্থিতির দিকে ভালো করে নজর রাখতে হবে।
দেশের ভেতরে এবং বাইরে নানা রকম ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে অভ্যুত্থানের বিজয়কে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্র আরও পেকে উঠছে। সেখান থেকে যদি দেশকে রক্ষা করতে না পারি, তাহলে রক্তের সঙ্গে বেইমানি করা হবে। তিনি বলেন, এরশাদের পতনের পর আমরা যেভাবে রাজনৈতিক দলগুলো একত্রিত হয়ে একটা আচরণবিধি তৈরি করেছিলাম সেরকম সমস্ত রাজনৈতিক দল একটা আচরণবিধি তৈরি করে জনগণের কাছে দিতে পারে। সংস্কার অর্থবহ করতে হলে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। জনগণের মতামত নিয়ে সেটা করতে হবে। আমি বা আমরা যতই তাত্ত্বিক কাগজপত্র লিখি না কেন জনগণের অংশ গ্রহণ ছাড়া আমরা সেগুলো বাস্তবায়ন করতে পারব না। তিনি আরও বলেন, জনগণ অংশগ্রহণের জন্য অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। নির্বাচনে যে সংস্কার দরকার, সেগুলো করে দিয়ে আমরা যদি জনগণের অংশগ্রহণের সংস্কার কাজ এগিয়ে নিয়ে যাই তাহলে এটাই হবে সার্থক। আমার বাংলাদেশের পার্টির (এবি পার্টি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু সাংবাদিকদের বলেন, প্রধান উপদেষ্টার কাছে ৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানিয়েছি। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ভালো সময় তৈরি হলে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করবেন।
সুষ্ঠু নির্বাচন দিয়ে দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন তিনি। তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা কেন পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন জানতে চাইলে তিনি বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া নিয়ে তিনি শঙ্কায় ছিলেন। আমরা বলেছি, কোনো কোনো উপদেষ্টার কারণে ঐক্যে ফাটল ধরছে। এখন উভয়কেই সহনশীল হতে হবে, সবাইকে সঙ্গে রাখতে হবে। বৈঠক শেষে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়েছি। সরকারের নেতৃত্বের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দেখা যাচ্ছে। উপদেষ্টারা একেক সময় একেক কথা বলছেন। আগামী এক মাসের মধ্যে একটি জাতীয় সনদ করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, গত কয়েক দিনের ঘটনায় প্রধান উপদেষ্টা বিব্রত হয়েছিলেন। তাই পদত্যাগের কথা ভাবছিলেন। আমরা বলেছি, এতে রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হবে। আমরা প্রস্তাব দিয়েছি, সবাইকে যেন সমানভাবে মূল্যায়ন করা হয়। করিডর ও বন্দরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত না নিতে বলা হয়েছে।
তিনি বলেন, মাঝ নদীতে মাঝি বদলাতে হয় না। আপনার সরকারের ওপরে আমরা আস্থা রাখতে চাই। আমরা এক সরকারের মধ্যে অনেকগুলো সরকার দেখতে চাই না। আপনাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দেখা যাচ্ছে। একেক উপদেষ্টার একেক রকম মন্তব্য। সবকিছু ঠিক করা জরুরি। নির্বাচন ইস্যুতে তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ ১৬ বছর ধরে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করছে। আমরা আপনাদের যৌক্তিকভাবে সহযোগিতা করতে চাই এবং সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চাই। রবিবার সন্ধ্যা ছয়টার দিকে যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে প্রথমে বৈঠক করেন ১১টি রাজনৈতিক দলের ১১ শীর্ষ নেতা। প্রথম দফায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে যারা সাক্ষাত করেন তাদের মধ্যে ছিলেন- লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম, আমার বাংলা (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) প্রধান উপদেষ্টা খালেকুজ্জামান ভূঁইয়া, জাতীয় গণফ্রন্টের সমন্বয়ক টিপু বিশ্বাস, ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন।
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে দ্বিতীয় দফায় ৯টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে মতবিনিময়কালে উপস্থিত ছিলেন- ইসলামী চিন্তক মাওলানা সাদিকুর রহমান, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের, হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নূর, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির মহাসচিব মাওলানা মুসা বিন ইজহার এবং ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন রাজী।
বৈঠক শেষে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, ড. ইউনূসের মাঝপথে চলে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ড. ইউনূসকে যেহেতু জনগণ একটা ভরসার জায়গায় রেখেছেন সে কারণে তাকেই এই দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমরা মনে করি, ড. ইউনূসের ওপর যত চাপই থাকুক না কেন তিনি যে ঐতিহাসিক দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন তা পালন করে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। তিনি আরও বলেন, আমরা আজ আমাদের পক্ষ থেকে বলেছি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার যে ঐতিহাসিক দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, যেখানে একদিকে হত্যাকারীদের বিচার এবং জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত করার জন্য গণতান্ত্রিক সংস্কারে যাওয়ার প্রয়োজন। এতে যে দায়িত্ব নেওয়া দরকার সেটা আপনার সরকারকেই নিয়ে যেতে হবে। অন্যথায় আর কোনো সুযোগ নাই। নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা কোনোভাবেই তার ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে চান না এবং তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের সময় আর বাড়াতে চান না। এপ্রিলের পর নির্বাচন বিলম্বিত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই বলেও তিনি আশ্বস্ত করেছেন।
তিনি বলেন, আমরা সংস্কারের বিষয়ে কিছু বলছি না। আমরা শুধু চাই একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। প্রধান উপদেষ্টা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন যে জুনের পর কোনোভাবেই আর সময় গড়াবে না। প্রয়োজনে আমি পদত্যাগপত্র লিখে রাখব। ১৭টি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ৩০ জুন ২০২৬-এর পর একদিনের জন্যও ক্ষমতায় থাকবেন না বলে জানিয়েছেন। তিনি জানান, বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক নেতাদের বলেন, আমরা এখন এক প্রকার যুদ্ধাবস্থায় রয়েছি। তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হওয়ার পর কিছু মানুষ মেনে নিতে পারছে না। দেশ ও দেশের বাইরে থেকে আমাদের আবারও পরাধীনতার দিকে ঠেলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। প্রধান উপদেষ্টার উদ্ধৃতি দিয়ে শফিকুল বলেন, আমি এমন কোনো কাজের অংশ হব না যা দেশের ক্ষতি বয়ে আনে। যদি আমি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে না পারি, তবে অনুশোচনায় ভুগব।
প্রধান উপদেষ্টার উদ্বৃতি দিয়ে প্রেস সচিব বলেন- প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, মহাসুযোগ পেয়েছি আন্দোলনের মাধ্যমে। ধ্বংস হয়ে যাওয়া দেশকে টেনে আনা, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে দেশের ভিতরে ও বাইরে। যাতে আমরা এগোতে না পারি, যাতে সবকিছু ভেঙে পড়ে, আবার যাতে গোলামিতে ফেরত যাই। যতদিন আছি দেশের কোনো অনিষ্ট কাজ আমাকে দিয়ে হবে না, নিশ্চিত থাকেন। প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেছেন, আমরা বড় যুদ্ধাবস্থার ভেতরে আছি।
আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ার পরে অস্থিতিশীলতা তৈরির যত চেষ্টা পারা যায়, করা হচ্ছে। এটা থেকে আমাদের রক্ষা করতে হবে। তারা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। বিভাজন থেকে আমাদের উদ্ধার পেতে হবে, ঐকমত্য থাকতে হবে। আত্মমর্যাদাপূর্ণ জাতি হিসেবে আমরা যতটুকু দাঁড়াতে পেরেছি, এটা যেন সামনের দিকে যায়। সবাই একসঙ্গে বসায় আমি মনে সাহস পেলাম। সুষ্ঠু নির্বাচন করতে না পারলে আমি নিজেকে অপরাধী অনুভব করব। এর আগে শনিবার বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা। ওই বৈঠকে বিএনপি বলেছে, তাদের প্রত্যাশিত সময় ডিসেম্বরের মধ্যে যে নির্বাচন হবে, সেই প্রতিশ্রুতি তারা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে পায়নি। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনের সঙ্গে সংস্কারের পথনকশা চাইলেও কোনো সময়ের কথা বলেনি। তবে তারা আগের মতোই নির্বাচনের আগে সংস্কারের ভাবনা জানিয়ে এসেছে। অন্যদিকে এনসিপি বিচার, সংস্কার ও গণপরিষদ নির্বাচনের সঙ্গে জুলাই ঘোষণাপত্রের বিষয়টি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে জানিয়ে এসেছে। তারা বলেছে, আওয়ামী লীগের সময়ের সব নির্বাচন আইন করে নিষিদ্ধ করতে হবে। প্রসঙ্গত, গত বৃহস্পতিবার দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশের গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস বৃহস্পতিবার অন্য উপদেষ্টাদের সঙ্গে এক অনির্ধারিত বৈঠকে তার পদত্যাগের ভাবনার কথা বলেন। বিভিন্ন পক্ষের প্রতিবন্ধকতার পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর অসহযোগিতায় তার সরকার কাজ করতে পারছে না বলে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেন তিনি। প্রায় সব দলই তার প্রতি আস্থা প্রকাশ করলে প্রধান উপদেষ্টা সর্বদলীয় বৈঠকের সিদ্ধান্ত নেন। গত দুই দিনে তিনি প্রায় ২৩টি দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। জানা গেছে, এসব বৈঠকের বিষয়বস্তু মিলিয়ে খুব শীঘ্রই প্রধান উপদেষ্টা দেশবাসীকে একটি পূর্ণ দিক-নির্দেশনা দিতে পারেন।
প্যানেল