
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস শনিবার আগারগাঁওয়ে পরিকল্পনা কমিশনের এনইসি সম্মেলন কক্ষে ১১তম একনেক সভায় সভাপতিত্ব করেন
পরাজিত শক্তির ইন্ধনে এবং বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে কেউ সরকারের দায়িত্ব পালন অসম্ভব করে তুললে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। শনিবার দুপুরে উপদেষ্টা পরিষদের অনির্ধারিত বৈঠক শেষে উপদেষ্টা পরিষদের এই সিদ্ধান্তের কথা বিবৃতির মাধ্যমে জানানো হয়।
উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, যদি পরাজিত শক্তির ইন্ধনে এবং বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সরকারের ওপর আরোপিত দায়িত্ব পালনকে অসম্ভব করে তোলা হয়, তবে সরকার সব কারণ জনসমক্ষে উত্থাপন করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। সরকারের স্বকীয়তা, সংস্কার উদ্যোগ, বিচার প্রক্রিয়া, সুষ্ঠু নির্বাচন ও স্বাভাবিক কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কর্মকাণ্ড অর্পিত দায়িত্ব পালন করাকে অসম্ভব করে তুললে সরকার জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে এ বিবৃতি পাঠানো হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্য শুনবে এবং সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করবে।
এর আগে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগের গুঞ্জন উড়িয়ে দিয়ে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা আমাদের সঙ্গে থাকবেন। তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) বলেননি তিনি পদত্যাগ করবেন। অন্য উপদেষ্টারাও থাকছেন। আমাদের যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, আমরা সে দায়িত্ব পালন করতে এসেছি।’
শনিবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের সভা শেষে উপদেষ্টা পরিষদের এক অনির্ধারিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর অর্পিত তিনটি প্রধান দায়িত্ব (নির্বাচন, সংস্কার ও বিচার) বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর এলাকায় পরিকল্পনা কমিশনে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
এসব দায়িত্ব পালনে বিভিন্ন সময় নানা ধরনের অযৌক্তিক দাবি-দাওয়া, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও এখতিয়ারবহির্ভূত বক্তব্য এবং কর্মসূচি দিয়ে যেভাবে স্বাভাবিক কাজের পরিবেশ বাধাগ্রস্ত করে তোলা হচ্ছে এবং জনমনে সংশয় ও সন্দেহ সৃষ্টি করা হচ্ছে, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে। উপদেষ্টা পরিষদের বিবৃতিতে বলা হয়, দেশকে স্থিতিশীল রাখতে, নির্বাচন, বিচার ও সংস্কারকাজ এগিয়ে নিতে এবং চিরতরে এ দেশে স্বৈরাচারের আগমন প্রতিহত করতে বৃহত্তর ঐক্য প্রয়োজন বলে মনে করে উপদেষ্টা পরিষদ। এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্য শুনবে এবং সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করবে।
বিবৃতিতে বলা হয়, শত বাধার মাঝেও গোষ্ঠীস্বার্থকে উপেক্ষা করে অন্তর্বর্তী সরকার তার ওপর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। যদি পরাজিত শক্তির ইন্ধনে এবং বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সরকারের ওপর আরোপিত দায়িত্ব পালনকে অসম্ভব করে তোলা হয়, তবে সরকার সব কারণ জনসমক্ষে উত্থাপন করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
এতে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই অভ্যুত্থানের জনপ্রত্যাশাকে ধারণ করে। কিন্তু সরকারের স্বকীয়তা, সংস্কার উদ্যোগ, বিচার প্রক্রিয়া, সুষ্ঠু নির্বাচন ও স্বাভাবিক কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কর্মকাণ্ড অর্পিত দায়িত্ব পালন করাকে অসম্ভব করে তুললে সরকার জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করছেন না, সঙ্গেই থাকবেন- পরিকল্পনা উপদেষ্টা ॥ এর আগে একনেক ও উপদেষ্টা পরিষদের অনির্ধারিত বৈঠক শেষে ব্রিফিংকালে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগের গুঞ্জন উড়িয়ে দিয়ে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা আমাদের সঙ্গে থাকবেন।’
কয়েক দিন ধরে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে শনিবার দুপুরে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা। বৈঠক শেষে পরিকল্পনা উপদেষ্টা সাংবাদিকদের এ কথা জানান। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভা শেষ হওয়ার পরই এই অনির্ধারিত বৈঠক শুরু হয়। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলনকক্ষে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকটি শুরু হয়ে প্রায় দুই ঘণ্টা পর তা শেষ হয়।
সভা সূত্র জানায়, উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উপদেষ্টাদের বাইরে আর কাউকে রাখা হয়নি। একনেক বৈঠক শেষে একে একে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, পরিকল্পনাসচিবসহ সব সরকারি কর্মকর্তাকে এনইসি কক্ষ থেকে বের হয়ে যেতে দেখা গেছে। চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় উপদেষ্টা পরিষদের এই বৈঠকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হচ্ছে।
বৈঠক শেষে ব্রিফিংকালে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘উনি তো চলে যাবেন- বলেননি। তিনি বলেছেন, ‘আমরা যে কাজ করছি, আমাদের ওপরে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সে দায়িত্ব পালনে অনেক প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে; কিন্তু আমরা সকল প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে আমাদের অর্পিত দায়িত্ব, এটা তো বড় দায়িত্ব, এটার ওপর নির্ভর করছে ভবিষ্যৎ, বহু বছরের ভবিষ্যৎ, এ দায়িত্ব ছেড়ে তো আমরা যেতে পারব না।’
উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক প্রসঙ্গে ওয়াহিদউদ্দিন বলেন, ‘দায়িত্ব পালনে যে প্রতিবন্ধকতাগুলো আসছে, সেগুলো নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি। আমরা প্রত্যেকে বিভিন্ন জায়গা থেকে কী প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে, কার কী প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে সংস্কার কাজ আমরা এগিয়ে নিতে গেলে কী হচ্ছে, সেগুলো আমরা দেখছি।’
আগামী নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে কোনো কথা হয়েছে কি না, এ প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি পরিকল্পনা উপদেষ্টা। শুধু এটুকু বলেন, এ ক্ষেত্রেও যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তা চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, ‘আগামী নির্বাচন ও সুশাসিত গণতান্ত্রিক অবস্থায় উত্তরণে যে ধরনের ক্ষেত্র তৈরি করা দরকার- সেই কাজেও, এটা তো আমাদের প্রধান কাজ; সেই কাজেও কোথা থেকে কী প্রতিবন্ধকতা আসছে- সেগুলো আমরা চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছি।’ নির্বাচনের প্রতিবন্ধকতা কি চিহ্নিত করা হয়েছে, এ প্রশ্ন করা হলে তিনি এড়িয়ে যান।
গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের সব শক্তি ও রাষ্ট্রীয় সব সংস্থাকে লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করার জন্য জানিয়ে এই উপদেষ্টা বলেন, ‘এটা তো আমাদের একার দায়িত্ব না।’ তিনি বলেন, ‘তাঁর বিপক্ষে যে কথাগুলো বলা হয়েছে তা দলীয় বক্তব্য নয়। সেরকম কিছু যদি হতোই তাহলে তো আমরা কেউ স্বপ্রণোদিতভাবে এখানে আসিনি এবং এই দায়িত্ব খুব উপভোগ্য না। কাজেই সে রকমন হলে তো আমরা যে কেউ পদত্যাগ করতে পারতাম। কিন্তু আমাকে বলা হয়েছে যে আসলে দলীয়ভাবে এমন কোনো কথা আসেনি।’
বর্তমান সরকার জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শক্তি এবং সমর্থনে এসেছে উল্লেখ করে পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, তাঁদের জুলাই ভিত্তিই জুলাই গণঅভ্যুত্থান। সেখানে কাউকে নিয়ে কোনো বিতর্ক সৃষ্টি হলে সেটা সমীচীন হবে না।
‘অনির্ধারিত বৈঠক’ চলার মধ্যে দুপুর ২টার পর ‘জরুরি কাজের’ কথা বলে বেরিয়ে যান পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। সে সময় বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নির্বাচন, সংস্কার এবং জুলাই ঘোষণা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সরকারের মন্ত্রী-এমপি, আওয়ামী লীগের নেতাদের অনেকেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। জুলাই আন্দোলনের ঐক্য মাস কয়েক বজায় থাকলেও এরপর অনেকের মধ্যেই সম্পর্কে ফাটল ধরে। তারপর রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ ও ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ নিয়ে বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলেনের দূরত্ব তৈরি হয়।
এর পর ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্র আন্দোলন ও তাদের জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে নতুন দল এনসিপির আত্মপ্রকাশের পর সংস্কার ও নির্বাচন বিষয়ে মিত্র দলগুলোর মধ্যে বিভেদ স্পষ্ট হতে শুরু করে। রাজপথ দখলে নিয়ে টানা বিক্ষোভ দেখিয়ে এনসিপি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি আদায় করে নিয়েছে, বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন সেই একই কৌশলে মেয়র পদে বসার চেষ্টা করলে এনসিপির সঙ্গে বিরোধ বাড়তে শুরু করে।
ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে শপথ পড়ানোর দাবিতে এক সপ্তাহ আগে নগর ভবনের সামনে লাগাতার আন্দোলন শুরু করেন তার সমর্থকরা। পরে তারা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের কাছে কাকরাইলে সড়ক অবরোধ করেও বিক্ষোভ দেখান। সে বিক্ষোভ কর্মসূচি থেকে ইশরাক হোসেন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের পদত্যাগ দাবি করেন।
অন্যদিকে ইশরাককে মেয়র ঘোষণার গেজেট প্রকাশ করায় নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে এনসিপি। কমিশন পুনর্গঠন দাবি করে তারা নির্বাচন ভবনের সামনে বিক্ষোভও করে। সেখানে দলটির নেতা নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী পরিকল্পনা উপদেষ্ট ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ও আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলকে ‘বিএনপির মুখপাত্র’ আখ্যায়িত করে তাদের পদত্যাগ দাবি করেন।
এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার মধ্যে সেনানিবাসে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার বিষয়ে কথা বলেছেন বলে খবরে এসেছে। গত বৃহস্পতিবার বিএনপি জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে স্থানীয় সরকার, তথ্য ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করে। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন না হলে সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের হুমকি দেয়।
এমন পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টার ‘পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশের’ গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস বৃহস্পতিবার অন্য উপদেষ্টাদের সঙ্গে এক অনির্ধারিত বৈঠকে তাঁর পদত্যাগের ভাবনার কথা বলেন। বিভিন্ন পক্ষের প্রতিবন্ধকতার পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর অসহযোগিতায় তাঁর সরকার কাজ করতে পারছে না বলে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেন তিনি।
বিষয়টি গণমাধ্যমে আসে জাতীয় নাগরিক পার্টি এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের মাধ্যমে। তিনি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। বিষয়টি সামনে আসার পর সব পক্ষ থেকেই প্রধান উপদেষ্টাকে পদত্যাগ না করার অনুরোধ জানানো হচ্ছে।
দেশের এই রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে শনিবার বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুসের সঙ্গে তাঁর বাসভবন যমুনায় সাক্ষাত করেছেন। যমুনার বৈঠকের দিকে তাই তাকিয়ে আছে সারা দেশ।