ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২১ মে ২০২৫, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

দাবির ঢেউয়ে দুলছে ঢাকা, আন্দোলনে বিপর্যস্ত জনজীবন

আল জুবায়ের, সিটি রিপোর্টার

প্রকাশিত: ১৩:৫৭, ২১ মে ২০২৫

দাবির ঢেউয়ে দুলছে ঢাকা, আন্দোলনে বিপর্যস্ত জনজীবন

ছবি: জনকণ্ঠ

রাজধানী ঢাকায় যানজট নতুন কিছু নয়, কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তা যেন আর নিয়ন্ত্রণে নেই। প্রতিদিনের ব্যস্ত শহর এখন একেকটি দাবিদাওয়ার আন্দোলনের চাপে হাঁসফাঁস করছে। ফলে নগরের চাকা যেন থেমে গেছে। সকালে শুরু, রাতে থামে না। প্রতিদিন সকালে যখন রাজধানী জেগে ওঠে কর্মচাঞ্চল্যে, তখন থেকেই শুরু হয় গাড়ির লম্বা সারি। কোনো গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকলেই বোঝা যায়, কী ভয়াবহ অবস্থা! সড়কে না আছে শৃঙ্খলা, না আছে গন্তব্যে পৌঁছানোর নিশ্চয়তা। একদিকে রাস্তাজুড়ে আন্দোলনকারীদের অবস্থান, অন্যদিকে অস্থায়ী রুট পরিবর্তনে পথ হারানো যানবাহন।

প্রতিদিনই নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ নামছে রাস্তায়। রিকশাচালক থেকে শুরু করে উচ্চশ্রেণি পর্যন্ত, যৌক্তিক-অযৌক্তিক দাবি, কেউ চাকরির নিরাপত্তা চাচ্ছে, কেউ বেতন বৈষম্যের অবসান, আবার কেউ শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন দাবি করছে। এসব দাবির সঙ্গে সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক চলাচল যেন মুখোমুখি সংঘাতে পড়েছে। 

গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর নতুন অন্তবর্তীকালীন সরকার ড.মুহাম্মদ ইউনুস ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে বাড়তে থাকে একের পর এক আন্দোলন। 
গেল ৯ মাসে নগরজুড়ে প্রায় পাঁচ শতাধিক দাবি-দাওয়ার আন্দোলন। এতে, নগরের গুরুত্বপূর্ন পয়েন্টগুলো আটকে যাওয়ার ফলে ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়তে হয় কর্মজীবী মানুষদের। কেউ ফিরেন পায়ে হেঁটে আবার কেউ কেউ ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করেন সড়ক থেকে কখন তারা সরে যাবেন।


ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সূত্র বলছে, ঢাকায় গড়ে প্রতিদিন কমপক্ষে তিনটি আন্দোলন কর্মসূচি পালিত হয়। সে হিসেবে অন্তবর্তীকালীন সরকারের সময়ে পাঁচ শতাধিক আন্দোলন হয়েছে ঢাকার বুকে। আন্দোলনে যুক্ত সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, পেশাজীবীরা যেমন রাস্তায় দুর্ভোগ বাড়াচ্ছেন, সমান গতিতে সরকারি চাকরিজীবীরাও দফতরের ভেতরে-বাইরে আন্দোলন করে নগরবাসীর দুঃখ বাড়াচ্ছেন।

ডিএমপির পক্ষ থেকে দুর্ভোগ এড়ানো এবং নিরাপত্তার স্বার্থে আন্দোলন না করতে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, এলাকা নির্দিষ্ট করে বার বার বিজ্ঞপ্তি দিয়েও আন্দোলনকারীদের থামানো যাচ্ছে না। নগরবাসীকে জিম্মি করে দিনের পর দিন চলছে আন্দোলন। অন্যদিকে দিনভর মাইক ব্যবহার করে স্লোগানে মুখরিত করে তোলায় বাড়ছে শব্দ দূষণও।


আবার জুলাই অভ্যুত্থানপরবর্তী দেশের আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর চেইন অফ কমান্ড ভেঙে পড়ায় এসব আন্দোলন দমাতে বেশ বেগ পোহাতে হচ্ছে তাদেরকেও। কৌশলে, ধৈর্য্য ধরে মোকাবেলা করতে হচ্ছে আন্দোলনকারীদের।


নগরবাসীরা বলছেন, গত ১৬ বছর ধরে যারা মুখ খুলতে ভয়ে পেয়েছেন এখন তারা মুখ খুলছেন। বিষয়টিকে ইতিবাচক ভাবে নিয়ে তারা বলছেন, ফ্যাসিস্ট হাসিনা দেশকে জিম্মি করে রেখেছিল কেউ তার বিরুদ্ধে মুখ খুললেই তাকে গুম-খুন করতো। তবে, সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করে মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলা ঠিক না বলেও জানান তারা।

সাম্প্রতিক সময়ে, বড় বড় কয়েকটি আন্দোলন নগরবাসীকে আরও ভোগান্তিতে ফেলেছে। আওয়ামীলীগ নিষিদ্ধের দাবিতে ছাত্রজনতার শাহবাগ-যমুনায় অবস্থান, নানা দাবিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অবস্থান এরপর ডিপ্লোমা-নার্সিং শিক্ষার্থীদের অবরোধ, গার্মেন্টস কর্মীদের আন্দোলন অন্যদিকে ছাত্রদল নেতা সাম্য হত্যার দাবিতে শাহবাগ থানা ঘেরাও ও মোড়ে অবস্থান কর্মসূচি এবং সর্বশেষ বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র হিসেবে শপথ পড়ানোর দাবিতে টানা সাত দিন ধরে আন্দোলন করছেন তার সমর্থকেরা। তবে অন্য দিনের মতো বুধবার (২১ মে) নগর ভবনে না গিয়ে মৎস্য ভবন মোড়ে অবস্থান নেয় তারা। এতে ওই এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে ভোগান্তিতে পড়ে সবাই। এদিকে নির্বাচন ইস্যুতে এনসিপির আঁগারগাওতে সমাবেশ। সবমিলিয়ে নগরজুড়ে বেহাল অবস্থা


নগরের প্রতিদিনের আন্দোলন নিয়ে বিরক্তি নিয়ে বাসচালক আরিফ মিয়া বলেন, " মামা একটা দিন কাজে না গেলে আমাদের পুরো সংসার হুমকিতে পড়ে। কিন্তু কী করব, পথে বের হলেই জ্যামে আটকে যাই।" আগে কয়েকটা টিপ মারতে পারতাম আর এখন একটা মারতেই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সবাই সবার স্বার্থ নিয়ে পড়ে আছে।


ফারজানা ইসলাম নামে একজন অভিভাবক বলেন, “আমার ছেলেকে নিয়ে সকাল ৭টায় বের হই, ছুটি হয় ১২ টায় অথচ স্কুল থেকে ফিরতে গেলেই পৌঁছাতে ২টা বেজে যায়। যেসব দাবি নিয়ে তারা মাঠে নেমেছে, তার অনেকগুলোই সময়োপযোগী এবং বাস্তবসম্মত। কিন্তু আন্দোলন কেন রাস্তা অবরোধ বা যান চলাচল বন্ধ করে করে করতে হবে? এতে সাধারণ মানুষই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

নগর উন্নয়ন বিশ্লেষকরা বলছেন, “প্রতিটি দাবি-দাওয়ারই নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া রয়েছে। তা যদি নিয়মতান্ত্রিক ও পরিকল্পিতভাবে উপস্থাপন না করা হয়, তবে তাতে সমস্যার সমাধান তো হয়ই না, বরং সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়ে।” রাজধানীর এই নিত্যদিনের বিশৃঙ্খলা থেকে মুক্তি পেতে প্রয়োজন কার্যকর গণপরিবহন, বিকল্প আন্দোলনের সংস্কৃতি এবং দ্রুত সংলাপের ব্যবস্থা। নইলে এই চাপা ক্ষোভ এক সময় বড় সংকটে রূপ নিতে পারে।

নগর পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান আন্দোলন নিয়ে তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্র কাঠামোতে দাবি দাওয়া উপস্থাপনের একটা পদ্ধতি আছে। রাস্তা বন্ধ করার কথাও না। কেউ আন্দোলন করলেই বর্তমান সরকার শুরুর দিকে দাবি মেনে নেওয়ায় মানুষ ধরেই নিয়েছে এটাই পদ্ধতি। কিন্তু পার্থকুঞ্জ পার্ক নিয়ে নীরব আন্দোলন হচ্ছে অনেক দিন ধরে, দায়িত্বশীলরা গায়ে মাখছেন না।’

এই নগর পরিকল্পাবিদ বলেন, ‘এভাবে রাস্তায় বসে দাবি আদায়ের পদ্ধতি কোনোভাবে গ্রহণযোগ নয়। নগরীতে বড় বড় স্কয়ার করে দিতে হবে। যেখানে গিয়ে মানুষ তার দাবির কথা বলবেন। তাদের নিরাপত্তা দিতে হবে। তারা সরকারকে লিখিত দেবেন। সেখানে একজনের ন্যায্য দাবি হলেও সরকার তা মেনে নেবেন। কিন্তু লক্ষ মানুষও অন্যায় দাবি করলে তা মানবে না এমন সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’

আরো পড়ুন  

×