ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১

প্লাটিনাম জুবিলিতে আওয়ামী লীগ

মুক্ত পারিপার্শ্বিকতা নিশ্চিতে নজর দেওয়া প্রয়োজন

কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ 

প্রকাশিত: ২৩:৩৪, ২২ জুন ২০২৪

মুক্ত পারিপার্শ্বিকতা নিশ্চিতে নজর দেওয়া প্রয়োজন

ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের ৭৫ বছর পূর্তিতে অভিনন্দন জানাই। এই দীর্ঘদিন ধরে কখনো সুসময়, কখনো বা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে দলটি এগিয়ে চলেছে। অর্থাৎ কখনো দুর্দিন, কখনো সুদিন। কিন্তু দলটি পাকিস্তান আমল থেকে নানা প্রতিকূলতা থাকা সত্ত্বেও ক্রমশ শক্তিশালী হয়েছে। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রথমেই ভাষার অধিকার অর্থাৎ বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রীয় ভাষার স্বীকৃতির দাবিসহ আর্থসামাজিক অন্যান্য দাবি সামনে রেখে ১৯৫৪ সালে দলটি যুক্তফ্রন্টে অংশগ্রহণ করে এবং জয়লাভ করে।

তারপর ১৯৫৬ সালে শাসনতন্ত্র আন্দোলনে ভূমিকা পালন করে। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করলে দেশে রাজনৈতিক কর্মকা- ব্যাহত হলে আওয়ামী লীগও দুর্দিনে পড়ে। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে আবার শিক্ষার্থী আন্দোলন জোরদার হয়, রাজনৈতিক কর্মকা- গতি পেতে শুরু করে।
এখানে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের বিকাশ সম্বন্ধে কিছু কথা বলে নিতে চাই। তিনি অত্যন্ত দায়িত্বশীল ও বলিষ্ঠ ছাত্রনেতা ছিলেন। ১৯৪৯ সালে ২৩ জুন যখন আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তিনি জেলে ছিলেন। তারপরও তাকে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। অর্থাৎ তাঁর নেতৃত্ব দানের পরিসর সম্প্রসারিত হয়। সেই ধারাবাহিকতায় তিনি নানা চক্রান্ত থাকা সত্ত্বেও ১৯৫৩ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। উল্লেখ্য, ১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবর দলের কাউন্সিল সভায় ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির অনুসরণে দলের নাম থেকে মুসলিম বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ করা হয়।
পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে এতদঞ্চলের মানুষের সকল অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন। তাঁর প্রস্তাব গৃহীত না হওয়ায় এবং ৬ ফেব্রুয়ারি পত্রিকায় তাঁকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যায়িত করায় তিনি সম্মেলন বর্জন করেন।

পরবর্তী সময়ে এই ছয় দফা আওয়ামী লীগ কাউন্সিলে আলোচিত হয় এবং ‘আমাদের বাঁচার দাবি ছয় দফা কর্মসূচি’ হিসেবে প্রচার করা হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ অনুষ্ঠানিকভাবে ছয় দফা উত্থাপন করা হয়। ছয় দফায় যা হলো : ১) প্রাপ্তবয়স্ক সর্বজনীন ভোটে নির্বাচন এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতির সরকার, ২) কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে শুধু পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা থাকবে, ৩) পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের জন্য অর্থাৎ দুটি অঙ্গরাজ্যের জন্য দুটি মুদ্রা থাকবে অথবা আলাদা হিসাব সংরক্ষণ ব্যবস্থায়ও একটি থাকতে পারে, ৪) কর ও অন্য রাজস্ব অঙ্গরাজ্যগুলো নিজ নিজ এলাকায় ধার্য করবে ও আদায় করবে এবং কেন্দ্রকে একটি নির্দিষ্ট অংশ দেবে কেন্দ্রের খরচ মেটানোর জন্য, ৫) নিজেদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা অঙ্গরাজ্যগুলোর মালিকানায় থাকবে এবং ৬) আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য অঙ্গরাজ্যগুলো আধা সামরিক বাহিনী গঠন করতে পারবে।

বাঙালির জাতীয় জীবনে এমন এক সন্ধিক্ষণে ১৯৬৬ সালে ১ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ছয় দফার পালে বাতাস আরও বেগবান হয়ে ওঠে। ৭ জুন, ১৯৬৬ সালে ছয় দফা দিবস পালন করা হয়। ওই দিন ছয় দফার পক্ষে দেশব্যাপী গণআন্দোলনের সূচনা হয়। অনেকে হতাহত হন। আন্দোলন দুর্বার হয়ে ওঠে। শেখ মুজিবুর রহমান সারাদেশে ঘুরে ঘুরে ছয় দফার ন্যায্যতা ও প্রয়োজনীয়তা জনগণের কাছে তুলে ধরেন এবং ব্যাপক সাড়া ও সমর্থন পান। বাঙালি মানসে ছয় দফা বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে ব্যাপকভাবে প্রতিভাত হয়।
অবশ্য প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী বসে থাকে নাই। শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামি করে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয় এবং তাকে এবং অন্যান্য আসামিকে অন্তরীণ রাখা হয়। বিচার চলে ক্যান্টনমেন্টে। প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসি দেওয়ার তৎপরতা চলছিল। অন্য আসামিদেরকেও। কিন্তু ১৯৬৯-এ পূর্ব বাংলায় গণঅভ্যুত্থান ফুঁসে ওঠে এবং তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে।

আইয়ুব খানের ক্ষমতা নড়বড়ে হয়ে পড়ে। তিনি আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল আসামিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। তারিখ ছিল ২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯। পরের দিন তদানীন্তন রেসকোর্স ময়দানে এক মহাসমাবেশে সমগ্র বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়। অপরদিকে, গদি ছাড়তে হয় আইয়ুব খানকে। ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয় পাকিস্তানের তদানীন্তন সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খানের কাছে।

ইয়াহিয়া খান নির্বাচন দিলেন, যা অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০-এর ৭ ডিসেম্বর। আওয়ামী লীগ পাকিস্তান জাতীয় সংসদে মাত্র দুটি ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের সব আসনে জয়লাভ করে এবং সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল এবং সেই সুবাদে কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের দাবিদার হিসেবে আবির্ভূত হয়।
পর্যায়ক্রমে ছাত্রনেতা, আওয়ামী মুসলিম লীগের দ্বিতীয় পর্যায়ের নেতা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দলটির একজন প্রধান নেতা, আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে বাঙালির সব দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতা এবং ১৯৬৯ থেকে বঙ্গবন্ধু এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে তাঁর অধিষ্ঠান ঘটে। তাঁরই নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এই সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে থাকে।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ৭ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত অভূতপূর্ব অসহযোগ আন্দোলন, ২৫ মার্চ রাতে নিরীহ বাঙালির ওপর পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর বর্বর হত্যাকা- শুরু, ২৬ মার্চের অতি ভোরে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা এবং মুক্তিযুদ্ধের সূচনাÑ এসব ঘটনাপ্রবাহের কেন্দ্রে ছিলেন বঙ্গবন্ধু এবং অবয়বে ছিল আওয়ামী লীগ। এর পর অবশ্যম্ভাবীভাবে মুক্তিযুদ্ধেও আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দান করে।

অবশ্য পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে গেলেও তাঁরই অনুপ্রেরণা এবং যে সকল দিকনির্দেশনা তিনি রেখে গিয়েছিলেন, সেসব তাঁর অদৃশ্য হাত হিসেবে মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পেছনে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। ১৬ ডিসেম্বর,  ১৯৭১-এ বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হয় এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
জনতার মধ্য থেকে উত্থিত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ পাকিস্তান সময়ে গণমানুষের বঞ্চনা থেকে মুক্তি এবং আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক হিসেবে স্থান করে নেয় জনতার মনোজগতে, বিশেষ করে ১৯৬৬ সালে ছয় দফা দাবি উত্থাপন থেকে পরবর্তী সময়ে। বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগ সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ না হলে বাঙালির স্বাধীনতা সূর্যের উদয় কবে ঘটত কিংবা এখনো উদিত হতো কি নাÑ তা বলা না গেলেও এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, যখন দেশ স্বাধীন হয়েছে তখন থেকে দীর্ঘদিন পরাধীনতার গ্লানি বহন করে চলতে হতো বাঙালিকে।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার সাড়ে তিন বছরের মতো রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে কেন্দ্রে রেখে দেশ গড়ার মৌল নীতি ও অঙ্গীকারসমূহ দ্রুত নির্ধারণ করে মাত্র নয় মাসের মতো সময়ে দেশের সংবিধান প্রণয়ন ও গ্রহণ করা হয়। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সামনে রেখে মানবকেন্দ্রিক উন্নয়ন ধারার সূচনা করেন বঙ্গবন্ধু। একটি প্রায় সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত অর্থনীতির পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন সংবিধানে বিধৃত মৌলিক তাগিদকে বিবেচনায় রেখে যে, এ দেশের সকল নাগরিক দেশটির মালিক। সেই আলোকেই প্রত্যয় ছিল সকলের মানবাধিকার ও মানবমর্যাদা নিশ্চিত করে সাম্যভিত্তিক রাষ্ট্র গড়া। তিনি বলেছিলেন, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে হবে এবং এ দেশে বেশি ধনী কেউ থাকবে না, আবার বেশি গরিব কেউ থাকবে না, সকলেই মর্যাদার জীবনের অধিকারী হবে।
সেই লক্ষ্যে সূচিত ধারায় কাজ হচ্ছে না, কাজ করা যাচ্ছে না, তা অনুধাবন করে বঙ্গবন্ধু সমবায়ের মাধ্যমে সকলকে অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক সাম্যের ছায়াতলে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন এবং সেই কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন ১৯৭৫ সালের গোড়ার দিকে। কিন্তু ঘাতকরা তাঁকে সময় দেয়নি, নির্মমভাবে তাঁকে হত্যা করা হয়। শুরু হয় উন্নয়ন ধারণা থেকে মানবকেন্দ্রিকতা বর্জন এবং ধীরে ধীরে পুঁজি কেন্দ্রিকতার দিকে ধাবমানতা। এই ধারা ক্রমে জোরদার করা হয়, কিন্তু দেশের আর্থসামাজিক উন্নতি হয় সামান্যই।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর আওয়ামী লীগ নানা টানাপোড়নে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে ১৯৮১ সালে বিদেশে অবস্থানরত শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচন করা হয়। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং দলের হাল ধরেন। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে ধারাবাহিকভাবে দলটি পুনর্গঠিত হতে থাকে, শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আবার রাষ্ট্রক্ষমতায় ফিরে ১৯৯৬ সালে।

ফেরার প্রেক্ষিত ছিল অন্য সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে দুর্বার আন্দোলনের মাধ্যমে দলটি একতরফাভাবে নির্বাচন করে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় বসা বিএনপিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচন দিতে বাধ্য করা। আর সেই নির্বাচনে জয়ী হয় আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধুর সরকারের পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশে দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ।
সেই আওয়ামী লীগ সরকারের দুটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ স্মরণে আনতে চাই। বঙ্গবন্ধুর পর কৃষিপ্রধান দেশে কৃষি অনেকটা অবহেলিত ছিল। উন্নয়ন সহযোগী কোনো কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও দেশের পরামর্শে পুঁজিবাদের প্রসারে মনোযোগ দেওয়া ও কৃষিকে অবহেলা করা হচ্ছিল। ধারণাগত অবস্থান ছিল এই যে, অর্থ থাকলে খাদ্য আন্তর্জাতিক বাজার থেকে সংগ্রহ করা যাবে। কিন্তু শিল্পায়ন এগোয়নি এবং উল্লেখযোগ্য খাদ্য ঘাটতি বিদ্যমান থাকে।

সার্বিকভাবে দেশের আর্থিক সামর্থ্য থেকে যায় খুবই দুর্বল এবং বিদেশ থাকে খাদ্য সহায়তাসহ ব্যাপকভাবে বিদেশনির্ভর। ১৯৯৬ সালে নির্বাচিত হওয়ার পর তথাকথিত উন্নয়ন সহযোগীদের ঘোর আপত্তি থাকা সত্ত্বেও নতুন আওয়ামী সরকার কৃষিতে ভর্তুকি দে য়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং যথেষ্ট পরিমাণে তা দেওয়া হয় প্রতি বছর। ফলে ২০০০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ পর্যায়ে পৌঁছে যায়। অন্য যে বিষয়টি সম্বন্ধে কথা বলতে চাই তা হচ্ছে শিক্ষানীতি সংক্রান্ত।

বঙ্গবন্ধু কর্তৃক নিয়োগকৃত কুদরত-ই-খুদা কমিশনসহ ওই সময় পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে কয়েকটি শিক্ষা কমিশন ও কমিটি প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং প্রত্যেক ক্ষেত্রেই প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। কিন্তু কোনোটাই শিক্ষানীতিতে রূপান্তর করা হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকারও অধ্যাপক শামসুল হকের নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করে এবং কমিশন যথারীতি একটি প্রতিবেদন জমা দেয়।

ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য বিষয় সংযোজন করে একটি যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করার জন্য ২০০০ সালের মাঝামাঝি সময়ে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড. নজরুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। আমি ওই কমিটির সদস্য ছিলাম। কমিটি একটি খসড়া শিক্ষানীতি তৈরি করে। কিন্তু ২০০১ সালে সরকার পরিবর্তন হওয়ার পর সেটি বাদ পড়ে যায় এবং আরও একটি নতুন শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়।
আওয়ামী লীগ আবার নির্বাচনে জয়ী হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে। আওয়ামী লীগের ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা দেওয়া হয়, এ দেশে ‘অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল উদার গণতান্ত্রিক কল্যাণ রাষ্ট্র’ গড়ে তোলা হবে। সেই আলোকে অন্যান্য পদক্ষেপের সঙ্গে দ্রুত একটি যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি-২০১০ গঠন করা হয়। অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে চেয়ারম্যান এবং আমাকে (কাজী খলীকুজ্জমান আহমদকে) কো-চেয়ারম্যান করা হয়।

অধ্যাপক কবীর চৌধুরী বয়স ও অসুস্থতার কারণে বেশি সময় দিতে পারেননি। কাজেই আমাকে দায়িত্ব নিয়ে কাজটি সুসম্পন্ন করতে হয়। নির্ধারিত চার মাস সময় শেষ হওয়ার একদিন আগেই কমিটি খসড়া নীতি সরকারের কাছে জমা দেয় এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ শেষে ২০১০-এর ডিসেম্বর মাসে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ মন্ত্রিপরিষদে অনুমোদিত হয়। এই নীতি এখনো বলবৎ আছে।
দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ২০১১-২০১৯ পর্যন্ত অভূতপূর্ব অগ্রগতি হয়। এই সময়ে উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলোর মধ্যে রয়েছে : জাতীয় উৎপাদনের ধারাবাহিক উচ্চ প্রবৃদ্ধি; রাজস্ব বছর ২০১০-এর তুলনায় ২০১৯ সালে মাথাপিছু জাতীয় উৎপাদন বেড়ে তিনগুণ; খাদ্য উৎপাদনে মোটামুটি স্বয়ংসম্পূর্ণতা; কৃষি, অবকাঠামো এবং কুটির ও মাইক্রো উদ্যোগসহ গ্রামীণ অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি; শিশু মৃত্যু এবং খর্বাকৃতি ও কম ওজনের শিশুর হার দ্রুত হ্রাস; নারীর ক্ষমতায়নে দক্ষিণ এশিয়ায় অগ্রগামিতা এবং করোনা মহামারি ব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্য ও অর্থনীতি উভয় ক্ষেত্রে বিশেষ পারঙ্গমতা।

আর রয়েছে- ২০১৯-২০ সালে করোনার কারণে প্রবৃদ্ধি অর্জনে পৃথিবীব্যাপী ধস নামে, তবে যে ১৮টি দেশ সে বছর ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে বাংলাদেশ সেগুলোর প্রথম দিকে ছিল। করোনার আঘাত থেকে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া প্রথম দিকে যথেষ্ট সাবলীল ছিল। প্রবৃদ্ধির হার ছিল ২০২০-২১ সালে ছয় দশমিক ৯৪ শতাংশ এবং ২০২১-২২ সালে সাত দশমিক ১০ শতাংশ। করোনাকালেও অবকাঠামোর ক্ষেত্রে বিভিন্ন বৃহৎ প্রকল্পের কাজে অগ্রগতি হয়।

২০২২ সালের জুন মাসে নিজ অর্থে বাস্তবায়িত পদ্মা সেতু এবং ডিসেম্বর মাসে মেট্রোরেল উদ্বোধন করা হয়। ইতোমধ্যে (২০২২) বাংলাদেশ বিশ্বে ৩৫তম বৃহৎ অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হয়েছে এবং জন্মের সময় প্রত্যাশিত গড় আয়ু ভারত ও পাকিস্তানকে পেছনে রেখে বাংলাদেশে ৭৩ বছরে উন্নীত হয়েছে। মাথাপিছু জাতীয় উৎপাদন ২০১০ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে চারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
তবে করোনা মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারাবিশ্বে অর্থনৈতিক বিস্তর টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়, যা এখনো পৃথিবীর সর্বত্রই নানা মাত্রায় এবং নানা ব্যাপ্তিতে বিদ্যমান রয়েছে। বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। উল্লেখ্য, পৃথিবীতে কখনো কোনো দেশ সব সময় ধারাবাহিকভাবে আর্থসামাজিক উন্নয়নে উঁচু ধারা বজায় রাখতে পারেনি, পারা যায় না। কারণগুলোর মধ্যে থাকতে পারে আন্তর্জাতিক পরিম-লে অর্থনৈতিক বিপর্যয় বা যুদ্ধবিগ্রহ, করোনা মহামারির মতো মহামারি, অভ্যন্তরীণ অর্থনৈনিতক-সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, প্রকৃতিক দুর্যোগ বা এগুলোর একাধিক একসঙ্গে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়।

বর্তমানে বাংলাদেশ কয়েকটি সাম্প্রতিক এবং কয়েকটি অনেক দিন থেকে চলে আসা চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে : উঁচু মাত্রার মূল্যস্ফীতি, মুদ্রার বিনিময় হারে অস্থিতিশীলতা, বৈদেশিক মুদ্রা তহবিলে ব্যাপক অবনমন এবং ব্যাংক ঋণে সুদের হারে অস্থিতিশীলতা। অনেক দিন থেকে চলে আসা চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে : দুর্নীতি, বিদেশে অর্থ পাচার, ব্যাংকিং খাতে নানা সমস্যা, অতি নিম্ন কর-জাতীয় উৎপাদ অনুপাত, বাজেট ও প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা এবং সমন্বয়হীনতা এ সবই আওয়ামী লীগের ২০১৮ ও ২০২৩ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে চিহ্নিত। 
লক্ষণীয়, আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহারে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে চ্যালেঞ্জসমূহ চিহ্নিত করে সেগুলো মোকাবিলার কথা বলেছে। পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে কোনো কোনো চ্যালেঞ্জ সমাধানের লক্ষ্যে। তবে মূল্যবোধহীন বিভিন্ন দুষ্টচক্র বাংলাদেশ এগিয়ে চলার পথে এক কঠিন পারিপার্শি^কতা সৃষ্টি করেছে এবং করে চলেছে। আশা করা যায়, এ সকল দুষ্টচক্রসহ সব জঞ্জাল হটিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আবার ২০১০-এর দশকে সূচিত ধারায় ফিরবে এবং এ যাবৎ অর্জিত অগ্রগতি সুসংহত এবং তরান্বিত হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ এগিয়ে চলবে উন্নত, স্মার্ট, কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার লক্ষ্যে।
এই লেখা শেষ করার আগে একটি কথা বলতে চাই যে, ক্ষমতাবলয়ভুক্ত গোষ্ঠীগুলোর দাপটে অন্য সকল মানুষ ঐতিহাসিকভাবে জনগণতন্ত্রের ধারক ও বাহক আওয়ামী লীগ থেকে বিচ্ছিন্ন এবং সামাজিক বিন্যাসে অপাঙক্তেও হয়ে পড়ছেন বলে প্রতীয়মান হয়। এ ছাড়া স্বার্থান্বেষী চাটুকারদের তৎপরতায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত এবং দক্ষ অনেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছেন। এসব অশুভ থেকে মুক্ত পারিপার্শ্বিকতা নিশ্চিত করার জন্য কার্যকরভাবে নজর দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে বলে দেশের একজন সচেতন এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ নাগরিক হিসেবে আমি মনে করি।

গণমানুষের স্বার্থেও আওয়ামী লীগের জনভিত্তির যথার্থতা এবং বঙ্গবন্ধুর ‘দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো’ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘কল্যাণ রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠা লক্ষ্যে রাখলে কাজটি করা জরুরি। আওয়ামী লীগ গণমানুষের পক্ষের শক্তি হিসেবে এবং তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ হোক, দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সোনার বাংলা গড়ে তুলতে সচেষ্ট থাকুক, সফলতার পথে এগিয়ে চলুক। দলটির প্লাটিনাম জুবিলিতে এই কামনা রেখে লেখাটি শেষ করছি। 
লেখক : ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা, সমাজচিন্তক এবং সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি। 

×