ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

আওয়ামী লীগ-জাপা গোপন বৈঠকেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি

আসন সমঝোতা নিয়ে সবার মুখে কুলুপ

বিকাশ দত্ত

প্রকাশিত: ০০:১০, ৮ ডিসেম্বর ২০২৩

আসন সমঝোতা নিয়ে সবার মুখে কুলুপ

জাতীয় পার্টির (জাপা) সঙ্গে আসন সমঝোতা নিয়ে সবাই মুখে কুলুপ এঁটেছেন

জাতীয় পার্টির (জাপা) সঙ্গে আসন সমঝোতা নিয়ে সবাই মুখে কুলুপ এঁটেছেন। বৈঠক নিয়েও চলছে লুকোচুরি খেলা। তবে পরপর দুদিনের টানা গোপন বৈঠকে আসন নিয়ে আলোচনা হলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। জাপা ৫০ আসন দাবি করলেও ৩০টির বেশি আসন দিতে রাজি নয় আওয়ামী লীগ। দুই দলের নির্ভরযোগ্য সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও জাপার মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু দুজনেই বলেছেন, আসন ভাগাভাগি নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করার বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দুজনই পৃথক ব্রিফিংয়ে এ কথা জানান।
ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সংসদের বিরোধী দল জাপার সঙ্গে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আসন ভাগাভাগি নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। রাজনৈতিক আলোচনাই ছিল মুখ্য। আসন ভাগাভাগির বিষয়টা আমি জানি না।
অন্যদিকে জাপা মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতা হয়নি। তার প্রয়োজনও নাই। তিনি বলেছেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, এবার জাতীয় পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে।’ তিনি বলেন, ভোটাররা কেন্দ্রে আসতে পারলে ’৯১ সালের মতো নীরব বিপ্লব হয়ে যেতে পারে। আমরা নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে আলোচনা করেছি। 
সূত্র জানায়, বৈঠকে আসন বণ্টনের বিষয় ছাড়াও আরও কিছু বিষয় উঠে আসে। যার মধ্যে জাপার একটি বড় ইস্যু ছিল স্বতন্ত্র প্রার্থী। তারা দাবি করেছে যে, বিভিন্ন আসনে যেসব স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়া হয়েছে, তারা নির্বাচনে বড় ধরনের সমস্যা তৈরি করতে পারে। বৈঠকে জাপার পক্ষ থেকে কয়েকটি দাবি উত্থাপন করা হয়েছে। বৈঠক শেষে জাপার দাবি-দাওয়া নিয়ে গণভবনে যান ওবায়দুল কাদের ও জাহাঙ্গীর কবির নানক। দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলে পরবর্তী করণীয় ঠিক করবেন তারা। ধারণা করা হচ্ছে, এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে পারেন জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাপার এক কো-চেয়ারম্যান জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের পূর্বনির্ধারিত বৈঠকটি আমির হোসেন আমুর বাসায় হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আপনাদেরসহ (গণমাধ্যম) বিভিন্ন কারণে গোপনীয় জায়গায় হয়েছে। যে ভবনে, যেখানে গণমাধ্যমের প্রবেশ নেই। বৈঠকে জাপার দুই নেতা অংশ নেন। লিয়াজোঁ কমিটির সংখ্যা বেশি হলে ঝামেলা বাড়ে। নানা কথাবার্তাও ছড়ায়। আওয়ামী লীগের আমু ছাড়াও যারা থাকার, তারা বৈঠকে ছিলেন।’
বুধবার গুলশানের এক হোটেলে এই গোপন বৈঠক হয়। বৈঠক সূত্র জানায়, অনেক গোপনীয়তা রক্ষা করে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষে সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সভাপতিম-লীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নাকক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, আফম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম অংশ নেন। অন্যদিকে জাপার পক্ষে মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ও কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল হক মাহমুদ উপস্থিত ছিলেন। তবে বৈঠকের বিষয়ে কোনো নেতাই মুখ খুলতে রাজি হননি।
এদিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতা প্রায় চূড়ান্ত জাপার। জাপাকে ৩০টির বেশি আসন দিতে চাইছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। জাপাকে ডেপুটি স্পিকারসহ মন্ত্রণালয় দেওয়ার বিষয়টি আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরাসরি নাকচ করে দিয়েছেন। সরকার চাচ্ছে জাপাকে প্রধান বিরোধী দল বানাতে। ২০১৪ সালের মতো নয়, এবার ক্ষমতাসীন অংশ থেকে আলাদা রাখা হবে জাপাকে।
জাপার একটি সূত্র জানায়, এবার বিএনপি না থাকায় অনেক দল ও জোট দাঁড়িয়ে গেছে। সবাই আসন চাচ্ছে। এসব বিবেচনা করে ৩০টির বেশি আসন জাপাকে ছাড়তে নারাজ আওয়ামী লীগ। 
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জাপা নেতা জানান, ‘আমাদের চাওয়া ছিল ৫০টির মতো আসন। আমরা লিখিতভাবে প্রত্যাশিত আসনের কথা তুলে ধরেছি। আশা করছি, ঢাকায় দুই আসন আগের মতোই থাকবে। ঢাকা-৪ ও ঢাকা-৬ আসনে আওয়ামী লীগ ছাড় দিতে রাজি হয়েছে। বাকিটা দেখা যাক কী হয়’।
ঢাকা-৪ আসনে বর্তমান এমপি সৈয়দ আবু হোসেন বাবলাকে আবারও মনোনয়ন দিয়েছে জাপা। এই আসনে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন সাবেক এমপি সানজিদা খানম। একইভাবে ঢাকা-৬ আসনে বর্তমান এমপি কাজী ফিরোজ রশীদকে মনোনয়ন দিয়েছে জাপা। আর সাবেক মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনকে মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ।
জাপার আরেক কো-চেয়ারম্যান বলেন, ‘সংসদের ডেপুটি স্পিকারসহ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের যে চাহিদা ছিল; তা সরাসরি নাকচ করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। জাপাকে এবার নির্ভেজাল বিরোধী দল বানাতে চান তিনি। এজন্য ওসব বিষয়ে কোনো আলাপ হয়নি। বিরোধীদলীয় নেতা হবেন জিএম কাদের।
জাপার দপ্তর থেকে জানা গেছে, ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৪ আসনে জাপা প্রার্থী ঘোষণা করলেও বাছাইয়ে ১২ প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়। যদিও ৪/৫ জন মনোনয়ন ফিরে পেতে ইসিতে আবেদন করেছেন।
২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচন থেকে প্রতিটিতেই জাপার সঙ্গে আসন সমঝোতা করেছে আওয়ামী লীগ। বিএনপি-জামায়াত জোট বর্জনের দশম সংসদ নির্বাচন জাপাকে ৩৪টি আসনে ছাড় দেয় আওয়ামী লীগ। আর একাদশ নির্বাচনে ২৯ আসনে ছাড় দেয় আওয়ামী লীগ।
এদিকে জাপাকে নির্বাচনে রাখাই এখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তারা নির্বাচনে আছেন, নির্বাচনে থাকতে চান। তবে নির্বাচনের পরিবেশ আরও সুষ্ঠু হওয়ার দাবি করেছেন জাপা মহাসচিব চুন্নু।
সূত্র মতে, বুধবারের বৈঠকে জাপার একটি বড় ইস্যু ছিল স্বতন্ত্র প্রার্থী। দলটি দাবি করেছে যে, বিভিন্ন আসনে যেসব স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন, তারা নির্বাচনে বড় ধরনের সমস্যা তৈরি করতে পারেন। বিশেষ করে, যদি নৌকা প্রতীকের প্রার্থীকে বসিয়ে দেওয়া হয় এবং সেই জায়গায় যদি আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকে তাহলে জাপার পক্ষে তারা কাজ করবে না। অবশ্য জাপার কোনো নেতা তাদের পক্ষে আওয়ামী লীগের কাজ করা না করা নিয়ে চিন্তিত নন। জাপা নেতারা বলছেন, যদি সমঝোতার ভিত্তিতে নৌকার প্রার্থীদের সরিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে জাপা অবশ্যই ভালো করবে।

বিশেষ করে যেসব আসনে জাপার এমপিরা এখনো আছেন, সেসব আসনে হয়ত আওয়ামী লীগ জাপাকে ছাড় দেবে।
সূত্র জানায়, জাপাকে ছাড় দেওয়ার চেয়েও বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে শেষ পর্যন্ত জাপার নির্বাচনে থাকা না-থাকার বিষয়টি। বিএনপি এবং অন্য বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করায় এখন নির্বাচনে জাপার থাকাটা বড় প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে আওয়ামী লীগের জন্য। কারণ জাপা যদি নির্বাচন থেকে সরে যায়, তাহলে এই নির্বাচন আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগ নির্বাচন হিসাবে পরিগণিত হবে।

কারণ ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। সেই নির্বাচনে তৎকালীন জাপা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন। এদিকে রওশন এরশাদ ছাড়া জাপা নির্বাচনে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন তার অনুসারীরা। তবে তারা নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।

×