ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

হঠাৎ আলোচনায় সংলাপ

জনকণ্ঠ রিপোর্ট

প্রকাশিত: ২২:৫৭, ৭ জুন ২০২৩

হঠাৎ আলোচনায় সংলাপ

ওবায়দুল কাদের ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর

‘সংলাপ’ ইস্যু নিয়ে ফের জমজমাট রাজনীতির মাঠ। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য আমির হোসেন আমুর এ সংক্রান্ত একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে আন্দোলনরত বিএনপির সংলাপের বিষয়টি আবার সামন চলে এসেছে। কূটনীতিকরাও কিছুদিন ধরে চেষ্টা চালাচ্ছেন প্রধান দুই দলের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের একটা সমাধানে পৌঁছাতে। তবে সংলাপ আদৌ হবে কি না- এ নিয়ে এখনো পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দলের কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। অবশ্য আগের দিন জাতিসংঘের মধ্যস্ততায় সংলাপ হতে পারে বলে বুধবার ছয় দফার আলোচনায় আমির হোসেন আমু মন্তব্য করেন। তবে তিনি বলেন, ‘আলোচনার জন্য কাউকে দাওয়াত দেয়া হয়নি।’
সংলাপের বিষয়টি নিয়ে বুধবার সরকারের অনেক মন্ত্রীই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, সংলাপের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, যারা নির্বাচন ঠেকানোর ঘোষণা দিয়েছে তাদের সঙ্গে আলোচনা করে কী লাভ হবে? আবার যে বিএনপির সঙ্গে এই সংলাপ নিয়ে এত আলোচনা, তারা তাদের আগের অবস্থানেই অটল রয়েছে। ফলে সংলাপ আদৌ হবে কিনা বা হলে তা কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। 
কিছুদিন ধরেই কূটনৈতিক পাড়া, সরকার ও বিরোধী দল এবং দেশের সাধারণ মানুষের মুখে মুখে সংলাপ ইস্যুটি ঘুরপাক খাচ্ছে। নাগরিক সমাজও মনে করে, রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে আলোচনার প্রয়োজন আছে।

যদিও নিকট অতীতে বাংলাদেশে সংলাপের সফলতা নিয়ে ভালো কোন অভিজ্ঞতা নেই। ১৯৯৪ সালের পর থেকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সব সরকারের আমলেই সংলাপের বিষয়টি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বারবার আশা ছড়ালেও দিনশেষে সংলাপের ফলাফল নিয়ে হতাশা ছিল সব দলের মধ্যেই। ২০১৩ সালে জাতিসংঘ মহাসচিবের উদ্যোগেও এক মাসব্যাপী সংলাপটির ফল ছিল কার্যত শূন্য। এছাড়া বিগত বিএনপি সরকারের আমলেও দুই দলের শীর্ষ দুই নেতার মধ্যে সংলাপও গুরুত্ব পেয়েছিল। কিন্তু শেষের দিকে ভেস্তে যায় সংলাপের প্রক্রিয়া। 
আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে যখন সংঘাতের আশঙ্কা বাড়ছে, তখন প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের প্রসঙ্গটি দেশের মানুষকে আশাবাদী করে তুলেছে। বিদেশী কূটনীতিকরাও নানা সময়ে সংকট সমাধানে নিজেদের মধ্যে সংলাপের তাগিদ দিচ্ছেন। সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতা ও মন্ত্রী সংলাপের বিষয়টি সম্প্রতি উত্থাপন করলেও দলগতভাবে সংলাপের বিষয়টি নাকচ করা হয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, যদি নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা নিয়ে সংলাপের উদ্যোগ নেওয়া হয় তবে এটি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। অন্যকিছু নিয়ে সংলাপের প্রশ্নই নেই।
সংকট সমাধানে বাংলাদেশের সংলাপের বিষয়টি গুরুত্ব পেতে থাকে নববইয়ের দশকে। বিগত ১৯৯৪ সালে বিএনপি শাসনমালে ভোটারবিহীন মাগুরার উপনির্বাচন নিয়ে সংঘাতের দিকে এগোয় বাংলাদেশ। ওই সময়ে কমনওয়েলথ সেক্রেটারি জেনারেল নিনিয়েন স্টিফেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলের মধ্যে সংলাপ শুরু করেন। সেটিও বিফল হয়েছে। ১৯৯৬ সালেও সংলাপের আয়োজন ব্যর্থ হয়। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার একইভাবে সংলাপের চেষ্টা করেন। সেটিও সফল হয়নি। ২০০৬ সালে উভয় দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা বিএনপি মহাসচিব আবদুল মান্নান ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। ওই সময়ে একেবারে  শেষ দিকে এসে সংলাপটি ব্যর্থ হয়।

বিগত ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশে আসেন জাতিসংঘের রাজনীতিবিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। ওই সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। এছাড়া আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে বৈঠক করেন। কিন্তু দীর্ঘ এক মাস প্রচেষ্টার পরও ২০১৪ সালের নির্বাচন নিয়ে ঐকমত্যে আসতে পারেনি কোন পক্ষ। সেই কারণে বর্তমানে নতুন করে সংলাপের আলোচনা উঠলেও শেষ পর্যন্ত সেটি কতটুকু ফল দিতে পারবেÑ সেই বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে রাজনৈতিক দল ও কূটনীতিক মহলে। এরপরও বিশ্লেষকরা সংকট সমাধানে সংলাপের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।
বিগত কিছুদিন ধরেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কোন সংলাপ নয়। আইন মেনে বর্তমান সরকারের অধীনেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এটিই ছিল সরকার ও দলের নীতিগত অবস্থান। তবে মঙ্গলবার হঠাৎ করেই আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য ও ১৪ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু বলেন, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে বিএনপির সঙ্গে নির্বাচন বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। 
তবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহন এবং সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার সিদ্ধান্ত এখনো নেওয়া হয়নি। পাশাপাশি জাতিসংঘের মধ্যস্থতার বিষয়টিও নাকচ কর দিয়েছেন তিনি?
ওবায়দুল কাদের বলেন, দেশের সমস্যা আমরাই আলোচনা করে সমাধান করব। এখানে জাতিসংঘের মধ্যস্থতা বা হস্তক্ষেপের প্রয়োজন আছে-এমন রাজনৈতিক সংকট দেশে তৈরি হয়নি। বিএনপির সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলেও জানান তিনি।
একইদিনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও সংলাপের বিষয়ে কথা বলেন। তবে তথ্যমন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদ এমপি সংলাপের বিষয়টি উড়িয়ে দেন। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, আমির হোসেন আমুর বক্তব্য একান্তই ব্যক্তিগত। দলীয় ফোরামে কোনো আলোচনা হয়নি, এমনকি ১৪ দলেও আলোচনা হয়নি। ড. হাছান বলেন, নির্বাচন পরিচালনা করবে নির্বাচন কমিশন। তারা নির্বাচনের রেফারি। তারা যদি সংলাপ ডাকে আমরা যাব।
মন্ত্রী বলেন, তার সঙ্গে (আমু) যোগাযোগ করা হয়েছে। তিনি বলেছেন কাগজে বা গণমাধ্যমে যেভাবে এসেছে তিনি ঠিক সেভাবে বলেননি। যেভাবেই আসুক এটি তার ব্যক্তিগত অভিমত। এটি দল, সরকার এমনকি ১৪ দল কোথাও এ নিয়ে আলোচনা হয়নি।
এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, সংলাপের কোনো বিকল্প নেই। আমরা মনে করি সবকিছু সংলাপের মাধ্যমে, আলোচনার মাধ্যমে শেষ করতে হবে। আমরা সেটাই বিশ্বাস করি। আমাদের আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে জনগণের ক্ষমতায়ন। জনগণকে নিয়েই চলতে হবে। সবাইকে নিয়ে চলতে হবে, আলোচনার বিকল্প কিছু নেই।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী  বলেন, আমরা মনে করি রাষ্ট্রদূতরা তাদের শিষ্টাচার মেনে এবং তাদের ওপরে যে বিধি-বিধিনিষেধ আছে সে সকল মেনে তাদের অর্পিত দায়িত্ব পালন করবেন। তাদের বিষয়টি আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মনিটরিং করে থাকে এবং তাদের ওপর দৃষ্টি রাখছে।
জাতিসংঘের উদ্যোগে নির্বাচন নিয়ে বিএনপির সঙ্গে আলোচনা হতে পারে- আমির  হোসেন আমুর এমন বক্তব্যের বিষয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপি কিছু জানে না। এটি সরকারের বক্তব্য নাকি তিনি মুখপাত্র হয়ে কথা বলেছেন- সেটিই পরিষ্কার নয়। মির্জা ফখরুল বলেন, শুধু অনুমান করে রাজনীতি করা ঠিক হবে না। আবার আমাদের অতীতে তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। ২০১৮ সালে আমাদের সঙ্গে দুইবার বসে যে অঙ্গীকার আওয়ামী লীগ সরকার করেছিল, তার কোনোটাই রক্ষা করেনি। সেখানে আমির হোসেন আমুও ছিলেন। তাই আওয়ামী লীগের ওপর আস্থা রাখার কোনো সুযোগ নেই। সেজন্য আমরা পরিষ্কার বলছি যে, অন্য কোনো বিষয়ের ওপর আলোচনার কোনো সুযোগই নেই। একমাত্র নিরপেক্ষ সরকার কীভাবে হতে পারে, তারা যদি রাজি হয় যে, হ্যাঁ নিরপেক্ষ সরকার করব, সরকার যদি বলে, আমরা পদত্যাগ করব, আমরা নিরপেক্ষ সরকারের ব্যাপারে আলোচনা করব কি না, সেটা আমরা তখন সিদ্ধান্ত নেব।
তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আওয়ামী লীগ এবং সরকারের মন্ত্রী বিএনপির সঙ্গে সংলাপের যে বক্তব্য দিয়েছেন তা আপাতত আমলে নিচ্ছে না বিএনপি। তবে বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব পেলে জবাব দেওয়ার জন্য ভাববে দলটি। তিনি বলেন, কোথায় কোনো সমাবেশে কে কি বলছে সেটার জবাব দেওয়া আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমরা রাজনীতি পরিবর্তন করছি। আমাদের কাছে কেউ লিখিত প্রস্তাব দিলে সেটার জবাব দেওয়ার জন্য ভাবব।

×