ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সিপিডির পর্যালোচনা

সংকট মোকাবিলায় বাজেট সময়োপযোগী হয়নি

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ০১:৩৬, ৩ জুন ২০২৩

সংকট মোকাবিলায় বাজেট সময়োপযোগী হয়নি

সিপিডির বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন

প্রস্তাবিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে সামষ্টিক অর্থনীতির যে চলকগুলো ধরা হয়েছে, সেগুলো বাস্তবসম্মত হয়নিবলে মনে করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগের যে লক্ষ্যমাত্রা বাজেটে ধরা হয়েছে, তা অর্জন কঠিন হবে বলেও মত তাদেরবাজেট ঘাটতি পূরণে ব্যাংক খাত থেকে যে ঋণের কথা বলা হয়েছে, সেটি মূল্যস্ফীতি বাড়াবে বলে মনে করছে সিপিডিএকদিকে মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হয়েছে, অন্যদিকে ন্যূনতম কর দুই হাজার টাকা করা হয়েছেযাদের করযোগ্য আয় নেই, তারাও এই করের আওতায় পড়বেনএ কারণে উদ্যোগটি নৈতিকতার দিক থেকে ঠিক নয়, আবার যৌক্তিকও নয় বলে দাবি করেছে সংস্থাটি

সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় এবারের বাজেটটি সময়োপযোগী হয়নিশুক্রবার রাজধানীর গুলশানের লেকশোর হোটেলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব পর্যালোচনা তুলে ধরে সিপিডিঅনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুনসংস্থার সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেনমূল প্রবন্ধে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক বলেন, এই কঠিন সময়ে কঠিন কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ ছিল যা  নেওয়া হয়নিরেমিটেন্স নিম্নমুখীবৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও নিম্নমুখীবৈদ্যুতিক এবং জ্বালানি খাতে ব্যাপক একটা ঘাটতি দেখা গেছেএর ফলে অভ্যন্তরীণ উপাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে

প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগের বিষয়ে বাজেটের বক্তব্য তুলে ধরে তিনি বলেন, নতুন অর্থবছর ২০২৩-২৪ এ জিডিপির প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশগত অর্থবছরেও ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হয়েছিলপরে এটাকে নামিয়ে ৬ শতাংশ করা হয়সরকারি বিনিয়োগের হার ৬ দশমিক ২ শতাংশ আর ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ জিডিপির ২৭ দশমিক ৪ শতাংশ ধরা হয়েছেকিন্তু গত বছর যেটা ধরা হয়েছিল, তার চেয়ে কম হয়েছে এখন পর্যন্ত; সেটা ২১ দশমিক ৮ শতাংশএখান থেকে লাফ দিয়ে ২৭ শতাংশ কীভাবে হবে? সেটা আমাদের কাছে মনে হচ্ছে একটি উচ্চাকাক্সক্ষা

ব্যক্তি খাতে ঋণ প্রবাহ নিয়ে ফাহমিদা বলেন, ব্যক্তি খাতে ঋণ প্রবাহ ১৫ শতাংশ ধরা হয়েছেএই বছরের ঋণ প্রবাহ যেটা ধরা হয়েছে সেটা গত বছরের ধরা ঋণ প্রবাহের সঙ্গে মিলছে নাব্যক্তি খাতের যে বিনিয়োগের হার ধরা হয়েছে সেটা এমন ঋণ প্রবাহ দিয়ে কীভাবে বাস্তবায়ন হবে তা আমাদের বোধগম্য নয়মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনও কঠিন মনে হয়েছে ফাহমিদার কাছেতিনি বলেন, আমাদের আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতির কথা বলা হলেও বৈশ্বিক বাজারে এখন সব পণ্যের দাম নিম্নমুখীতাই মূল্যস্ফীতিকে এর ওপর চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না, আমাদের অভ্যন্তরীণ অনেক দুর্বলতা আছে, করকাঠামোর মধ্যে আছে, প্রাতিষ্ঠানিক ও মনিটারি পলিসির মধ্যেও দুর্বলতা আছেমুদ্রানীতির সঙ্গে আমাদের আর্থিক নীতির যদি সমন্বয় না থাকে তাহলে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ খুবই কঠিন হবে

করমুক্ত আয় সীমা তিন লাখ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে তিন লাখ টাকা করাকে ভালো বিষয়বলে উল্লেখ করেন সিপিডি নির্বাহী পরিচালকতবে ন্যূনতম দুই হাজার টাকা করারোপের বিষয়টি ভালো হয়নি বলে মত দেন তিনিতিনি বলেন, কারো যদি আয় সাড়ে তিন লাখের নিচেও হয়, তাহলে সরকারি ৩৮টি সেবা নিতে টিন লাগবেকরযোগ্য আয় না থাকলেও তাকে দুই হাজার টাকা দিতে হবেমানুষকে স্বস্তি দিতে এখানে করমুক্ত আয় বাড়িয়ে আবার যার করযোগ্য আয় নেই তার ওপর দুই হাজার টাকার কর আরোপ করা এটা কীভাবে যুক্তিযুক্ত হয় তা আমরা বুঝে পাই নাতিনি বলেন, যে কর দেওয়ার যোগ্য, আয়ের ক্ষমতা আছে সেই তো কর দেবে, কিন্তু যার নেই তার, ওপর আবার বসিয়ে দিলামএটা সাংঘর্ষিক ও বৈষম্যমূলকনৈতিকভাবেও এটা ঠিক নাএটা অর্থনৈতিক চাপ বাড়াবেফল মূল যে উদ্দেশ্য ছিল সেটিও নষ্ট হয়ে গেলফাহমিদা খাতুন বলেন, আমরা বরাবরই বলেছি, বাজেটে গ্যাস উত্তোলনে বরাদ্দ থাকা উচিততাই নতুন অর্থবছরের বাজেটে গ্যাস উত্তোলনে বাপেক্সকে বরাদ্দ দেওয়া উচিত ছিলতিনি বলেন, জ্বালানি খাতে ২০২৩ অর্থবছরের তুলনায় এবার বরাদ্দ বেড়েছে ৪ দশমিক ৬ শতাংশতবে খনিজসম্পদ বিভাগে বরাদ্দ কমেছেএছাড়া বিভিন্ন প্রকল্পে ৬৪ শতাংশ বরাদ্দ কমে গেছে

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, চলমান অর্থবছর অর্থা ২০২২-২৩ সালের বাজেটটি যখন দেওয়া হয়, বৈশ্বিক পরিস্থিতি কী এবং আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ অভিঘাত কী তা স্পষ্ট করা ছিলতারপরও আমরা সাড়ে ৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ধরেছি, মুদ্রাস্ফীতি ধরেছি ৫.৪ শতাংশ।  আমরা ধরেছিলাম যে, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৬ বিলিয়ন ছিল, আর তার কোনো ব্যত্যয় ঘটবে নাআমরা ধরেছি যে, আমাদের ডলার এক্সচেঞ্জ রেট ৪৬ টাকার পরিবর্তন হবে নাতিনি আরও বলেন, আমরা যে বলি বছরের পর বছর অনুমিতিগুলো সত্য হয় না এবং বাস্তবতার সঙ্গে মিল থাকে নাতখন যখন বাজেট করা হয় সেই বাজেটের পরিণতি সেটাই হয় যেটা অনুমিতির কারণে দুর্বল ছিলআপনারা দেখেছেন এবার সাড়ে ৭ শতাংশের জায়গায় ৬.০৩ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছেরিজার্ভ ৪৬ বিলিয়নের জায়গায় ৩১ বিলিয়ন (২৯ বিলিয়ন) হলোডলার এক্সচেঞ্জ রেইট ১০৮ টাকা হলোমুদ্রাস্ফীতি সাড়ে ৮ শতাংশ হলোবাস্তবতাকে বিবেচনা না করে আকাক্সক্ষাকে মাথায় রেখে বাজেট করলে এ অবস্থা হয়মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নতুন অর্থবছরের বাজেটের মূল উদ্দেশ্যে থাকা উচিত ছিল চলমান অর্থনীতিতে যে স্থিতিশীলতার সংকট রয়েছে সেটা ঠিক করাকিন্তু এবারের বাজেট যেসব অনুমিতির ভিত্তিতে করা হয়েছে, সেই জায়গায় দুর্বলতা রয়েছে

পরবর্তী সময়ে এসব দুর্বল জায়গার প্রতিটিতে বাজেট পরিকল্পনা হোঁচট খাবেএই বাজেট বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আমাদের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জে পড়তে হবেব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া প্রসঙ্গে সিপিডির এই বিশেষ ফেলো বলেন, দেখতে হবে সংস্কারের কোন জায়গাগুলোতে শক্তভাবে হাত দিয়ে এই সমস্যা সমাধান করা যাবেআমরা অনেক দিন ধরে বলছি একটি ব্যাংকিং কমিশন করার জন্য২০০৯ সালে যখন এই সরকার ক্ষমতায় আসে তখন খেলাপি ঋণ ছিল ২১ হাজার কোটি টাকাকিন্তু আজকে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকাএটা নিয়ে কি কারও কোনো দুশ্চিন্তা নেইএটা কারা নিচ্ছেন (ঋণ), আর কারা দিচ্ছেনএ কারণে ব্যাংকিং খাতে অনেক সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছেখন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ডাইরেক্ট ট্যাক্স বাড়ানোর ব্যাপারে সরকারের চরম অনীহা রয়েছেকিন্তু ইনডাইরেক্ট ট্যাক্সের পরিমাণ বাড়াতে চাচ্ছেসরকারের হাতে এবার খুব বড় রাজস্ব নেইফলে সরকার বাড়তি অর্থ দিতে পারেনিতিনি বলেন, যে সুবিধাগুলো আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী কমিয়ে আনার অঙ্গীকার করেছিল, সেগুলোতে সরকার হাত দেয়নিতার মধ্যে রয়েছে কর কাঠামোতে হাত না দেওয়া ও ইনকাম ট্যাক্সে হাত না দেওয়াযদিও এসব খাতে সরকার এ বাজেটে হাত দেওয়ার কথা ছিলসম্ভবত নির্বাচন সামনে বলেই সরকার আইএমএফের সংস্কারে হাত দেয়নিধারণা করা হচ্ছে, সরকার আইএমএফের সঙ্গে সংস্কার কাজ অব্যাহত রাখলেও নির্বাচনের পরে এসব  খাতে সরকার হাত দেবে

গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এবারের বাজেটে সবচেয়ে দুর্বলতম দিক হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নেওয়াজনগণের যে আকাক্সক্ষা ছিল, এই বাজেটে তার প্রতিফলন ঘটেনিদুই হাজার টাকা করের যে কথা বলা হয়েছে, সেটি মাসভিত্তিতে নিলে ১৬৭ টাকা আসেদ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বৃদ্ধি করা হয়েছেবয়স্ক ভাতা ৫০০-৬০০ টাকা করা হয়েছে মানে হলো ১ বা ২ কেজি চাল-ডাল বেশি কেনা যাবেযা নিম্নআয়ের মানুষের চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট নয়আমরা বলেছিলাম, এই সামাজিক নিরাপত্তার (বয়স্ক ভাতা) পরিমাণ আড়াই হাজার টাকা করা উচিত

তিনি বলেন, দেশের পুঁজিবাজার এখনো উপযোগী নয়পুঁজিবাজারকে যদি বাজার উপযোগী না করতে পারি, তাহলে এই বাজার দিয়ে কিছু আশা করতে পারি নাঅনুদান ও সরকারের সাহায্য নির্ভর পুঁজিবাজার আসলে বেশি দিন টিকতে পারে নাআমার মনে হয়, অনুদান ও সাহায্য নির্ভর কাঠামো থেকে পুঁজিবাজারকে বের করে আনার জন্য স্মার্ট সংস্কারের উদ্যোগ দরকারতিনি বলেন, দুর্ভাগ্যবশত আইএমএফের সংস্কার কাঠামোর ভেতরে পুঁজিবাজার সংক্রান্ত কোনো শর্ত নেইফলে পুঁজিবাজার সংক্রান্ত শব্দ বাজেটে নেইস্মার্ট বাজেটের জন্য স্মার্ট পুঁজিবাজারের উদ্যোগ প্রয়োজনতিনি বলেন, বেনিফিশিয়ারি ওনার্স নিয়ে আমাদের আপত্তি রয়েছে, সেকেন্ডারি মার্কেট, আইপিও, কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনের বিষয়েও আপত্তি রয়েছেসুতরাং স্মার্ট পুঁজিবাজারের জন্য স্মার্ট সংস্কার করতে হবে

×