ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ভালো মানের বই ছাপানো হবে চ্যালেঞ্জ

নবম শ্রেণির বই নিয়ে সংশয়, লেখার কাজই শুরু হয়নি

​​​​​​​আসিফ হাসান কাজল

প্রকাশিত: ০১:১৬, ২৬ মে ২০২৩

নবম শ্রেণির বই নিয়ে  সংশয়, লেখার  কাজই শুরু হয়নি

.

নবম শ্রেণির বই লেখা ছাপানো নিয়ে দ্বিধায় পড়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) নতুন শিক্ষাক্রমের অষ্টম শ্রেণির বইয়ের কাজ শেষ পর্যায়ে থাকলেও নবম শ্রেণির বইয়ের কোনো কাজ এখনো শুরু হয়নি। এর ফলে সময়মতো বই লেখা, ভুল সংশোধন নির্ধারিত সময়ে শিক্ষার্থীর হাতে বই পৌঁছে দেওয়া নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২৪ সাল থেকে অষ্টম নবম শ্রেণিতে শুরু হবে নতুন শিক্ষাক্রম। কিন্তু নবম শ্রেণির নতুন বইয়ের কাজ না করার পরিবর্তে পুরাতন বই ছাপাতে চেয়েছিল এনসিটিবি। পরে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির নির্দেশের পরে নড়েচড়ে বসেছেন এনসিটিবি কর্মকর্তারা। কিন্তু নির্দেশনার পরও এখন পর্যন্ত বই লেখার কোনো অগ্রগতিই হয়নি।

জানতে চাইলে এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম জনকণ্ঠকে নবম শ্রেণির বই ছাপানোর বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, সময় কম থাকায় নির্দিষ্ট সময়ে এই বই লেখা ছাপিয়ে উঠানো সম্ভব হবে কী না তা নিয়ে দুশ্চিন্তা রয়েছে। সর্বশেষ মন্ত্রী মহোদয়ের নির্দেশে নতুন শিক্ষাক্রমের বইয়ের পান্ডু লিপি লেখার নির্দেশনা পাওয়া গেছে। খুব শীঘ্রই কাজ শুরু হবে বলে জানান তিনি।

প্রতিবছর নভেম্বর, ডিসেম্বরে বই ছাপানোর নিয়ম থাকলেও নির্বাচনের কারণে সময় ব্যস্ত থাকবে ছাপাখানা। নির্বাচনী পোস্টার তৈরির কারণে বাড়বে কাগজের দাম। এসব কারণে এবার সেপ্টেম্বর অক্টোবরের মধ্যে প্রাথমিক মাধ্যমিক স্তরের বই ছাপানোর উদ্যোগ নিয়েছে এনসিটিবি।

আগামী শিক্ষাবর্ষে নতুন শিক্ষাক্রমের অষ্টম নবম শ্রেণির জন্য ১৩টি করে মোট ২৬টি বই ছাপা হবে। অষ্টম শ্রেণির ১৩টি বইয়ের লেখার কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। চলছে ড্রয়িং এর কাজ। বিষয়ে এনসিটিবির প্রধান সম্পাদক অধ্যাপক সন্তোষ কুমার ঢালী জনকণ্ঠকে বলেন, ৮ম শ্রেণির বইয়ের ড্রয়িং যাচাই-বাছাই সংশোধনের কাজ একেবারেই শেষ পর্যায়ে আছে। এনসিটিবির নির্দেশনা অনুযায়ী ৩০ অক্টোবরের মধ্যে পাঠ্যবইটি ছাপানো সম্পন্ন হবে। নতুন বছরের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের হাতে এই বই তুলে দেওয়া হবে। তবে নবম শ্রেণির বইয়ের বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।

এদিকে এনসিটিবি সদস্য (পাঠ্যক্রম) অধ্যাপক মশিউজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা পুরাতন বইটি ছাপাতে চেয়েছিলাম। সেটি ভাল হতো। মন্ত্রীর নির্দেশনা অনুসারে এখন তা সম্ভব হচ্ছে না। বিষয়ে এখন পর্যন্ত বই লেখার জন্য কমিটি গঠন ছাড়া দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

সূত্র জানায়, সর্বশেষ নবম শ্রেণির ১৩টি বইয়ের জন্য ১২০ সদস্যের ১৩টি কমিটি করা হয়েছে। প্রতিটি কমিটিতে -১৪ জন সদস্য আছেন। এরমধ্যে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক, টিচার্স ট্রেনিং কলেজের শিক্ষক, বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার স্কুল শিক্ষকদের রাখা হয়েছে। এসব শিক্ষকরাই বই লেখা পা-ুলিপির কাজ করবেন।

এনসিটিবি চেয়ারম্যান ফরহাদুল ইসলাম বলেন, আমরা শিক্ষার্থীদের নতুন বই দেব না পুরাতন বই দেব তা নিয়ে সংশয়ে ছিলাম। কারণ নতুন বই লেখার সময় হাতে নেই। নির্বাচন অক্টোবরের মধ্যে বই শেষ করে শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তিনি আরও বলেন, এখন মন্ত্রী মহোদয়কে যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য পাচ্ছি। কিন্তু অক্টোবরের পর নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ায় তাকে পাওয়া কষ্টকর হবে। পান্ডুলিপি লেখা না থাকলে নির্দিষ্ট সময়ে বই দেওয়ার সম্ভবনাও কম।

কোন বইয়ের কী অবস্থা প্রতিবছর প্রাথমিক মাধ্যমিক মিলিয়ে ৩৫ কোটি বই ছাপানো হয়। এরমধ্যে প্রাথমিকে ১০ কোটি মাধ্যমিকে ২৫ কোটি। তবে বছর এই সংখ্যা আরও কমে আসতে পারে। চাহিদা কম থাকায় এবার বই ছাপানো হতে পারে ৩২-৩৩ কোটি। সে অনুযায়ী সেপ্টেম্বরের ৩০ তারিখের মধ্যে প্রাথমিক অক্টোবরের ৩০ তারিখের মধ্যে মাধ্যমিকের বই দেওয়া সম্পন্ন হবে।

এখন পর্যন্ত প্রাথমিকে বই ছাপানোতে এগিয়ে আছে এনসিটিবি। প্রাথমিক পর্যায়ের সকল শ্রেণির বইয়ের দরপত্র উন্মুক্ত করা হয়েছে। তবে দ্বিতীয়, তৃতীয় প্রি-প্রাইমারির বই নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে হওয়ায় এসব বই লেখার কাজ চলছে।

জানতে চাইলে এনসিটিবি সদস্য (প্রাথমিক) মো. রিয়াজুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, দ্বিতীয় শ্রেণির বইয়ের কাজ শেষ হয়েছে। ছবি আঁকার কাজ চলছে। তৃতীয় শ্রেণির বইয়ের পান্ডু  লিপি শেষ পর্যায়ে আছে। তবে বিপত্তি বেধেছে প্রি-প্রাইমারি নিয়ে। নিয়ে এখনো প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এনসিটিবির মধ্যে আলোচনা চলছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, প্রি-প্রাইমারি গ্রেড--এর কাজ নিয়ে সমস্যা নেই। কিন্তু গ্রেড- নিয়ে এখনো বরাদ্দ না থাকায় বই ছাপানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। অন্যদিকে মাধ্যমিক স্তরে নবম শ্রেণি ছাড়া অন্য কোনো শ্রেণির বই ছাপানোতে বড় কোনো সমস্যা নেই।

ভাল মানের বই ছাপানোর সম্ভাবনা এবারও কম বছর নিম্নমানের কাগজের বই নতুন শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে মুদ্রণ ছাপার মানও ছিল খারাপ। তবে এবারও খুব বেশি ভাল বই শিক্ষার্থীদের হাতে যাওয়ার সুযোগ নেই বললেই চলে। কারণ এরই মধ্যে কাগজের উজ্জ্বলতা পুরুত্ব নিয়ে এনসিটিবির যে শর্ত ছিল তা আরও শিথিল করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বছর আন্তর্জাতিক বাজারে কাগজের দাম কমে এসেছে। গত বছর যখন বই ছাপানো হয় তখন যে মূল্য ছিল এবার তা অর্ধেক। তবে এনসিটিবি কর্মকর্তারা জানান, প্রতিবছর মুদ্রণ ব্যবসায়ীদের হাতে শিক্ষার্থীরা জিম্মি হবে তা সহ্য করা হবে না। গতবছর কাগজের ব্রাইটনেস ৮৫ ছিল এবার তা ৮০ তে নামিয়ে আনা হয়েছে। এই ব্রাইটনেসে ভার্জিন পাল্প অল্প লাগে। অর্থাৎ অল্প দামেই এবার ভাল মানের বই দেওয়া সম্ভব হবে। এরপরও ব্যবসায়ীরা ৭৫ শতাংশ ব্রাইটনেস চান। সেটি দেওয়া হবে না, একইসঙ্গে আমরা কোনো ধরনের গাফিলতি সহ্য করব না।

অভিযোগ রয়েছে খারাপ মানের বই দিয়েও শাস্তি দেওয়া হয়নি ছাপাখানা মালিকদের। বিষয়ে এনসিটিবি বলছে, মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা যে বই দিয়েছে, সে অনুযায়ী কালো তালিকা করা হলে প্রেস থাকবে না বই ছাপানোর জন্য। এরপরও তিনটি প্রেসকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

সূত্র জানায়, যে তিনটি প্রেস কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে তা হলো- মেরাজ, আল আমিন জাহানারা। এসব প্রেসের কালো তালিকা থেকে বের করতে উচ্চপর্যায় থেকেও চাপ দেওয়া হচ্ছে। এর বাইরেও ১১টি প্রেসকে শোকজ করা হয়েছে। তবে এর বাইরেও ৪০টি প্রেসকে আর্থিক জরিমানা করা হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যে তিন প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে তারা আদতে ছোট প্রতিষ্ঠান। আদতে মশা মেরে হাত লাল করার মতো আচরণ করেছে এনসিটিবি।

বিষয়ে পুস্তক প্রকাশক সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান বলেন, যে প্রতিষ্ঠান এক কোটির টেন্ডার দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে ৩০ লাখ বই দিতে পারেনি তাদের কিছু বলা হয়নি। কিন্তু যে প্রতিষ্ঠান বই ছাপানোর অর্ডার পেয়েছে তিন লাখ, এর মধ্যে যথাসময়ে ৩০ হাজার বই দিতে পারেনি তাকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এটি প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়।

বইয়ের ভুলত্রুটির বিষয়ে সতর্ক করা হলেও আদতে কোনো বিশেষ কিছু করছে না এনসিটিবি। বিষয়ে বিশেষ কোনো মনিটরিং টিম করা হয়নি। সার্বিক বিষয়ে এনসিটিবি চেয়ারম্যান ফরহাদুল ইসলাম বলেন, এবারও ভুল হবে। তবে আমরা ভুল কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি।

×