ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

নাগরিক দুর্ভোগ

ওয়াসার পানি নিয়ে সিন্ডিকেট

ইবরাহীম মাহমুদ আকাশ

প্রকাশিত: ২৩:৪৩, ২১ মার্চ ২০২৩

ওয়াসার পানি নিয়ে সিন্ডিকেট

রাজধানীর সবুজবাগ এলাকায় গত এক সপ্তাহ ধরে ওয়াসার পানির সমস্যা

রাজধানীর সবুজবাগ এলাকায় গত এক সপ্তাহ ধরে ওয়াসার পানির সমস্যা। লাইনে পানি না থাকায় মোটর দিয়েও পানি পাচ্ছিলেন না স্থানীয়রা। তাই ওয়াসার দুই গাড়ি পানির জন্য আবেদন করেন স্থানীয় বাসিন্দা মনির হোসেন। গত শনিবার তাকে ছোট এক গাড়ি পানি দেওয়া হয়। ছোট গাড়ির পানির মূল্য ৪০০ টাকা হলেও তার কাছ থেকে ৭০০ টাকা নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। এ ছাড়া বড় গাড়ির পানি ৬০০ টাকা হলেও নেওয়া হচ্ছে এক হাজার টাকা।

জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘ওয়াসার লাইনে সমস্যার কারণে সবুজবাগ ও বাসাবোসহ পুরো এলাকায় গত এক সপ্তাহ ধরে পানি নেই। মোটর ছাড়লে অল্প পানি আসে। যা দিয়ে কোনো কাজ করা যায় না। অনেক সময় পানি আসেই না। অনেকদিন থেকে এই সমস্যা। ওয়াসার পানির গাড়ির জন্য আবেদন করেও পাওয়া যায় না। দুই গাড়ি চাইলে এক গাড়ি পাওয়া যায়।’ আবার গাড়ি চালককে খুশি করতে হয়। তা না হলে ঠিকমতো পানি পাওয়া যায় না বলে জানান তিনি। 
এমন অভিযোগ রয়েছে উত্তরা ১ ও ৩ নম্বর সেক্টরসহ রাজধানীর অনেক এলাকায়। মতিঝিল এলাকার বাসিন্দা আলী আজম জনকণ্ঠকে বলেন, ‘মতিঝিল মুন হোটেল এলাকায় গত কয়েকদিন ধরে পানি সমস্যা। বাসা-বাড়িতে পানি নেই। তাই পানির গাড়ির জন্য আবেদন করেছি। সিরিয়াল বেশি থাকায় পানির গাড়ি পেতে দেরি হয়। আবার গাড়ি চালকদের বকশিস না দিলে গাড়ি ঠিকমতো পাওয়া যায় না।’ প্রতি বছর রোজার সময়ই পানি বেশি সমস্যা দেখা দেয় বলে জানান তিনি।

শহরের বিভিন্ন এলাকায় পানি সংকটকে কেন্দ্র করে ওয়াসার জোনগুলোতে গড়ে উঠেছে সিন্ডিকেট। দালাল এবং ওয়াসার কর্মীদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এসব সিন্ডিকেটের কাছে এলাকাবাসী জিম্মি হয়ে পড়েছে। দালালদের মাধ্যমে না গেলে ওয়াসার গাড়ির পানি  মেলে না। ফলে বাধ্য হয়ে দালাল ধরতে হয়। দালালদের মাধ্যমে পানিতে পেতে গুনতে হয় বাড়তি টাকা। আবার পানি  পাওয়ার পর ড্রাইভারকে দিতে হয় বকশিস। অন্যথায় পরের বার পানি পেতে দুর্ভোগে পড়তে হয়।

এলাকাভিত্তিক এই পাািন সংকটকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই সিন্ডিকেট ইচ্ছে করে পানির সমস্যা জিইয়ে রাখে। যাতে গ্রাহকের দুর্ভোগকে কাজে লাগিয়ে তাদের অবৈধ অর্থ উপার্জনের ব্যবসা জমজমাট থাকে। পানির গাড়িকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের মধ্যে কোটি কোটি টাকার অবৈধ লেনদেন হচ্ছে। কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেও দালালদের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায় না।     
এখন পানির বেশি সংকট দেখা দিয়েছে রাজধানীর সবুজবাগ, বাসাবো, মতিঝিল, যাত্রাবাড়ীর ধলপুর, সিটি পল্লী, উত্তরার ১ ও ৩ নম্বর সেক্টরে। এ ছাড়া মিরপুরের বিভিন্ন এলাকায়, শনিরআখড়া, শ্যামপুর, গেণ্ডারিয়া, আজিমপুর, মুগদা, জুরাইন, দনিয়া, মুরাদপুর, মাতুয়াইলসহ বিভিন্ন এলাকা পানি সমস্যা দীর্ঘদিনের। এসব এলাকায় সবচেয়ে বেশে দুর্ভোগ পোহাতে হয় নিম্ন আয়ের মানুষদের। তাদের দৈনন্দিন পানির চাহিদা মেটাতে সকালে গিয়ে লাইন ধরে পানি সংগ্রহ করতে হয়। এতে যেমন তাদের সময় অপচয় হয় তেমনি পরিশ্রম করতে হয়।

ঠিকমতো না পাওয়ায় লাইনে পানি না পাওয়া গেলেই এলাকার মানুষদের পানির দুর্ভোগ বেড়ে যায়। লাইনে পানি ওয়াসার পানির গাড়ির চাহিদা বেড়েছে। তার পরও পানির গাড়ি সহজে  মেলে না। ওয়াসার ১০টি আঞ্চলিক কার্যালয়ে পানির গাড়ির চাহিদা জানানো হলে পানির গাড়ি বাসায় আসার কথা। প্রতিটি ছয় হাজার লিটারের বড় গাড়ির পানির দাম ৬০০ টাকা ও ৩ হাজার লিটারের পানির গাড়ির ৪০০ টাকা। এ সব গাড়ি পেতে হলে দালাল ও গাড়ি চালকদের বকশিসসহ প্রায় ১০০০ টাকা চলে যায় বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেন। ৬ ফ্ল্যাটের একটি বাড়িতে প্রতি দিন পানির জন্য খরচ ৬ হাজার টাকা। এই হিসেবে একটি এলাকায় প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য হচ্ছে।  
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজধানীর মধ্য বাসাবোর এক বাসিন্দা জনকণ্ঠকে বলেন, ‘গত কয়েকদিন ধরে সবুজবাগ থানার পাশে মধ্য বাসাবো এলাকায় ওয়াসার লাইনে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। লাইনে পানি না থাকার বিষয়টি ওয়াসাকে জানানো হয়েছে। কিন্তু তারাও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। গত শুক্রবার থেকে এলাকায় পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। পানির গাড়ি চেয়েও পাওয়া যাচ্ছে না। গত বরিবার দুটি বড় পানির গাড়ির জন্য আবেদন করেছি। একটি ছোট গাড়ি দেওয়া হয়েছে। সাড়ে ৩ হাজার লিটার পানির গাড়ির দাম নিয়েছে ৬০০ টাকা।’    
ওয়াসার সূত্র জানায়, বর্তমানে ঢাকা ওয়াসার পানি সরবরাহের জন্য ৪৮টি গাড়ি ও ১৭টি ট্রাক্টর রয়েছে। এর অতি পুরনো হওয়ায় এর  মধ্যে ১০টি গাড়ির ইঞ্জিন বিকল হয়ে গেছে। সংকটকবলিত প্রতিটি অঞ্চলে প্রতিদিন গড়ে ১০০ গাড়ি পানির চাহিদা রয়েছে। ফলে চাহিদার এক-পঞ্চমাংশ চাহিদাও মেটানো যাচ্ছে না সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানান। জানতে চাইলে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী তাকসিম এ খান জনকণ্ঠকে বলেন, ‘গরম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পানির চাহিদা বাড়ছে। আরও বাড়বে, সেটা ট্যাকেল করার মতো সামর্থ্য আমাদের রয়েছে। ঢাকায় পানির চাহিদা প্রচুর ওঠানামা করে। শীতকালে পানির চাহিদা থাকে ২০০ থেকে ২১০ কোটি লিটার। শীতে মানুষ পানি ব্যবহার করে কম।    
রাজধানীর অনেক এলাকায় নতুন লাইন বসানোর পরেও ওয়াসার পানিতে আবর্জনা ও দুর্গন্ধ হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন স্থানীয়রা। এ বিষয়ে রাজধানীর উত্তর যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, ‘গত ৩-৪ মাস হলো উত্তর যাত্রাবাড়ীর শহীদ ফারুক সড়ক এলাকায় ওয়াসার নতুন লাইন বসানো হয়েছে। কিন্তু নতুন লাইন বসানোর পরেও দুর্গন্ধযুক্ত পানি আসছে।’ এ বিষয়ে ওয়াসার অফিসে অভিযোগ করা হলেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায় না বলে জানান তিনি।

এ বিষয়ে ওয়াসার উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম শহিদউদ্দীন জনকণ্ঠকে বলেন, ‘যাত্রাবাড়ী, জুরাইন ও ধলপুরসহ পুরো এলাকায় ওয়াসার নতুন লাইন বসানোর কাজ চলছে। এটা ২০১৬ সাল থেকে শুরু হয়েছে। বেশিরভাগ এলাকায় লাইন বসানো কাজ শেষ হয়েছে। চলতি বছর এই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।

×