ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৩ মে ২০২৫, ৩০ বৈশাখ ১৪৩২

আমরা সবাই গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে গড়ে উঠি

শংকর লাল দাশ, গলাচিপা

প্রকাশিত: ২৩:৫৭, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

আমরা সবাই গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে গড়ে উঠি

.

মাত্র সতেরো বছরের কিশোর। এসএসসি পরীক্ষার্থী। অতটুকু বয়সেই এলাকায় এবং ভারতের সামরিক শিবিরে একাধিক প্রশিক্ষণ। নিয়মিত সেনাবাহিনীর অংশ হয়ে যাওয়া। ১৪১ জন দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা ও সেনা সদস্যের কোম্পানি কমান্ডারের দায়িত্ব পালন। সিলেটের শমশেরনগর এয়ারপোর্ট মুক্ত করাসহ অন্তত ২০টি সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং নিজ হাতে পাক হানাদারদের খতমের মতো অজস্র কৃতিত্ব যার ঝুলিতে, তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম সামসুদ্দিন। যিনি পটুয়াখালী অঞ্চলে সানু ঢালী নামেই বেশি পরিচিত।
আবুল কালাম সামসুদ্দিন ওরফে সানু ঢালীর বাড়ি প্রত্যন্ত অঞ্চল পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার গোলখালী ইউনিয়নের নলুয়াবাগী গ্রামে। পারিবারিকভাবে রাজনীতি সচেতন সানু ঢালী একাত্তরের উন্মাতাল দিনগুলোতে ছিলেন গলাচিপা সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী। জড়িত ছিলেন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে। একাত্তরের সাত মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের পরে অন্যান্য অঞ্চলের মতো পটুয়াখালীর গলাচিপা থানা সদরেও গড়ে ওঠে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শিবির। অন্যতম কনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে তিনিও সেই প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেন, যা অব্যাহত ছিল ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত। ওই দিন পটুয়াখালী জেলা সদর পাক হানাদারকবলিত হলে প্রশিক্ষণ শিবির ভেঙে যায়।
সানু ঢালীর ভাষায়, সেনাবাহিনীর সদস্য আবদুস সালামের নেতৃত্বে খালেক খলিফা, ডা. আবদুল মালেক, ফজলু মল্লিকসহ আমরা পাঁচজন পরের দিনই ভারতের উদ্দেশে গলাচিপা ত্যাগ করি। বাউফলের কালাইয়া, ভোলা, নোয়াখালী ও ফেনীর ছাগলনাইয়া দিয়ে পুরো চারদিন পেয়ে হেঁটে আগরতলা পৌঁছাই। সেখানে প্রথমে আমরা উদয়নগর প্রশিক্ষণ শিবিরে যোগ দেই। ভারতীয় সেনাবাহিনী সাতদিন প্রশিক্ষণ দিয়ে হাতে একটি গ্রেনেড ধরিয়ে আমাদের একটি গ্রুপের সঙ্গে সংযুক্ত করে বিদায় দেয়।
বিষয়টি মনোপূত না হওয়ায় আমরা সেখান থেকে বেরিয়ে অম্পিনগর প্রশিক্ষণ শিবিরে যোগ দেই। সেখানে এক মাস ১২ দিন ভারতীয় সেনাদের কঠোর তত্ত্বাবধানে আমাদের গেরিলা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আমরা সবাই একেকজন গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে গড়ে উঠি। আমাকে করা হয় কোম্পানি কমান্ডার। আমার অধীনে দেওয়া হয় সেনা সদস্যসহ ১৪১ বীর গেরিলা যোদ্ধাকে। আমাকে পটুয়াখালী অঞ্চলে যুদ্ধ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু পটুয়াখালী অঞ্চলে পাক হানাদারদের তৎপরতা কিছুটা কম থাকায় আমি সিলেট অঞ্চল বেছে নেই। যোগ দেই মেজর জিয়াউর রহমানের সেক্টরে। তখন আমার নেতৃত্বাধীন পুরো গ্রুপটিকে অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আমি নিয়মিত সেনাবাহিনীর সদস্য হয়ে যাই। সৈনিক হিসেবে আমার মাসিক বেতন ৭৫ টাকা। আমার গ্রুপটিকে মেঘালয়ে পাঠানো হয়। সেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে দীর্ঘ আড়াই মাস চলে আরও কঠোর প্রশিক্ষণ। এর পরে আমার গ্রুপটিকে কর্নেল আমিনুল হকের অধীনে নেওয়া হয়।
সানু ঢালীর গ্রুপটি জুলাই মাসের শেষের দিকে সিলেট, রংপুর ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে সরাসরি পাক হানাদের বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো যুদ্ধে তাকে অংশ নিতে হয়েছে। কোনো যুদ্ধে সদস্য হিসেবে। আবার কোনো যুদ্ধে কমান্ডার হিসেবে। আগস্ট থেকে শুরু করে ডিসেম্বর মাসের বিজয় লাভ করা পর্যন্ত আবুল কালাম সামসুদ্দিন অন্তত ২০টি সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। এর মধ্যে দুটি যুদ্ধের স্মৃতি আজো অমলিন, যার একটি ছিল সিলেটের শমশেরনগর এয়ারপোর্ট পাক হানাদারমুক্ত করা এবং অপরটি ছিল সিলেটের নকশি বিওপি পোস্টে আক্রমণ করা।
শমশেরনগর এয়ারপোর্ট দখলে নেওয়ার স্মৃতিচারণ করে সানু ঢালী বলেন, ওই যুদ্ধে আমরা বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম সাড়ে তিন হাজার। আমাদের সহযোগী ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রায় তিন হাজার সেনা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে শমশেরনগর বিমানবন্দরের এ যুদ্ধ একটি মাইলফলক হয়ে আছে। পাকিস্তানি সেনারা বিমানবন্দরের তিনটি রাস্তা দখল করে ছিল। তারাও সংখ্যায় ছিল কয়েক হাজার। ভারতীয় সেনাদের দায়িত্ব ছিল রাস্তুাগুলো দখলমুক্ত করা।
আমাদের পরিকল্পনা ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী যখন সরাসরি পাক হানাদারদের যুদ্ধে ব্যস্ত রাখবে, সেই ফাঁকে আমরা বিমানবন্দরের দখল নেব। কিন্তু যুদ্ধের এক পর্যায়ে পাক হানাদাররা অতর্কিতে যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে। এতে প্রচুর ভারতীয় সেনা প্রাণ হারান। বহু বীর মুক্তিযোদ্ধাও শহীদ হন। ভারতীয় সেনাবাহিনীও বাধ্য হয়ে যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে। কৈলাশনগর থেকে আসা ভারতীয় যুদ্ধবিমানের আক্রমণে পাক হানাদাররা দিশেহারা হয়ে পড়ে। দীর্ঘ চব্বিশ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে এ যুদ্ধ চলে। এক পর্যায়ে পাক হানাদাররা পিছু হটতে বাধ্য হয়। বিমানবন্দর আমাদের দখলে আসে।
দ্বিতীয় স্মরণীয় যুদ্ধের উল্লেখ করে সানু ঢালী বলেন, অক্টোবর মাসের শেষের দিকে সিলেটের নকশি বিওপি পোস্ট আক্রমণ এবং তা দখলে নেওয়া আমাদের জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এটি ছিল ভারত-বাংলাদেশের অন্যতম একটি সীমান্তবন্দর। মুক্তিযোদ্ধাদের চলাচল সুগম করার জন্য এ পোস্ট দখল করা ছিল আমাদের উদ্দেশ্য। কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে দিনের বেলা রেকি করার দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর। পোস্ট সংলগ্ন গ্রামটি ছিল একেবারে জনশূন্য। হানাদাররা গ্রামের একটি মানুষকেও জীবিত রাখেনি। এমনকি বাড়িঘর এবং গাছপালা পুড়ে-কেটে সাফ করে দিয়েছিল। কেবলমাত্র একটি তালগাছ দাঁড়িয়ে ছিল। সেটি লক্ষ্য করেই রাতে যুদ্ধ শুরু হয়।
হানাদাররা বিশাল লম্বা ট্রেঞ্চ কেটে ছিল, যা আমরা বুঝতে পারিনি। ওরা ট্রেঞ্চে ঢুকে অনেক দূর চলে যায়। এক পর্যায়ে ওদের অ্যাম্বুশে আমরা তিনদিক থেকে আটকে পড়ি। বাংলাদেশের সেনারা পরে আমাদের উদ্ধার করে। নইলে ওখানেই আমাদের মৃত্যু হতে পারত। এ যুদ্ধে আমি মেশিনগান চালাই। আমার সহকারী ছিলেন ইস্ট বেঙ্গল রাইফেলের সৈনিক আবদুল খালেক। পাকিস্তানিদের গুলিতে তার বুক ঝাঁঝরা হয়ে যায়। আমার চোখের সামনে তার মৃত্যু হয়। এ মৃত্যু আজো কাঁদায়। এ সব যুদ্ধে বহু পাকিস্তানি সেনা হত্যা করেছি। আবার চোখের সামনে অনেক সহযোদ্ধার মৃত্যু দেখেছি। তারপরও বিজয় হয়েছে, এটাই সারা জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন।
স্বাধীনতার পর সেনাবাহিনীতে সুযোগ পেলেও যাননি। পড়াশুনা শেষে আবুল কালাম সামসুদ্দিন ১৯৮১ সালে সোনালী ব্যাংকে যোগ দেন। ২০১২ সালে অবসর নেন। বড় ছেলে আসাদুজ্জামান সুজন বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী এবং ছোট ছেলে সানাউল হক সুমন স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন।
বর্তমানে ৬৯ বছর বয়সের আবুল কালাম সামসুদ্দিনের একটাই চাওয়া- যে আদর্শ এবং চেতনা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছি, সেই চেতনায় দেশ এগিয়ে চলুক। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বাস্তবায়ন হোক দেশের সর্বক্ষেত্রে।

 

×