ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চট্টগ্রাম নৌবাণিজ্য দপ্তর ও শিপিং অফিসে অডিট আপত্তি

নৌযানের মূল্য কম দেখানোয় ক্ষতি ১১০ কোটি টাকা

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস

প্রকাশিত: ২৩:০৮, ৯ ডিসেম্বর ২০২২

নৌযানের মূল্য কম দেখানোয় ক্ষতি ১১০ কোটি টাকা

,

চট্টগ্রামে নৌ বাণিজ্য অধিদপ্তরে লাগামহীন দুর্নীতি অব্যাহত রয়েছে। কোনোভাবেই দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। বিভিন্ন নৌযানের রেজিস্ট্রেশন, সার্ভে ও ফিটনেস প্রদানে জালিয়াতির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ খাতেও অনিয়ম দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাম্প্রতিক এ দপ্তরের দুর্নীতি নিয়ে সরকারি অডিট আপত্তিতেও অনুরূপ চিত্র পরিলক্ষিত হয়েছে। চলতি বছরে দাখিলকৃত অডিট আপত্তিতে দেখা যায়, এর আগের তিন বছর দুর্নীতির পরিমাণ ১৭ কোটি টাকারও বেশি। দপ্তরের প্রিন্সিপাল অফিসারের নামে সরকারি বাসা বরাদ্দ থেকেও বেতনের সঙ্গে বাসা ভাড়া নেওয়ায় সরকারি ক্ষতির পরিমাণ ১৮ লাখ টাকার ওপরে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নৌ বাণিজ্য দপ্তরের প্রিন্সিপাল অফিসারের বাংলো মেরিন হাউস তার নামেই বরাদ্দ এবং তার মূল বেতনের ৪০ ভাগ কর্তনযোগ্য। বিধি অনুযায়ী, বাসায় না উঠলেও বাড়ি ভাড়া কর্তন করা হয়। যেহেতু সরকারি উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সরকারি বাসভবন ইয়ার মার্ক করা, সেহেতু এক্ষেত্রে কোনো ব্যত্যয় ঘটার কথা নয়। অথচ, এ দপ্তরের প্রিন্সিপাল অফিসার নিজ বাসভবনে না থেকে বাড়ি ভাড়া গ্রহণের প্রমাণ উঠেছে অডিটে। গত মার্চ মাসে এ সংক্রান্ত অডিট আপত্তিতে ক্ষতির পরিমাণ দেখানো হয়েছে ১৮ লাখেরও বেশি। জানা গেছে, উক্ত প্রিন্সিপাল অফিসার যিনি বর্তমানে শিপিং অফিসে যোগ দিয়েছেন তিনি দায়িত্ব পালনকালে ঢাকায় থাকতেন। কিন্তু এ সংক্রান্তে কোনো ডিক্লারেশন দেননি। প্রায় চার একর জমির ওপর চট্টগ্রামের সরকারি এ বাস ভবনটি বর্তমানে একজন নটিক্যাল সার্ভেয়ার ও অপর একজন অ্যাকাউন্টস অফিসার থাকেন। গত আড়াই বছর যাবত এ দুই কর্মকর্তা কোনো বাসা ভাড়া দেন না। রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তার জন্য নিয়োগকৃত দুজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারি উক্ত বাসভবনে অবস্থান করে এবং তাদের বাসা ভাড়া কর্তন করা হয়।
অডিট আপত্তির অনিয়মে হালনাগাদ হিসাব করলে দেখা যাবে, প্রিন্সিপাল অফিসারসহ অন্য দুই কর্মকর্তা বাংলোতে থেকেও সরকারি অর্থের ক্ষতি করেছেন ৩০ লাখ টাকারও বেশি। অডিট রিপোর্টে অন্য এক আপত্তিতে দেখা যায়, নৌযান নির্মাণ সুপারভিশন ফি’র ওপর আয়কর সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে সরকারি অর্থের ক্ষতিসাধন করা হয়েছে ৪০ লাখ টাকারও বেশি। একইভাবে সুপারভিশন ফিস কম আদায় করায় রাজস্ব ক্ষতির পরিমাণ ১ কোটি ৬০ লাখ টাকারও বেশি। এ ব্যাপারে এই দপ্তরের একটি সূত্র জানায়, ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১৭৫০টি ফিশিং ও কার্গোবোট রেজিস্ট্রেশন হয়েছে। এসব নৌযানের রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া দেখভাল করে থাকে একজন অফিস সহকারী, যিনি আগে ছিলেন পিয়ন পদে। একেকটি নৌযানের বাজারমূল্য প্রায় দেড় কোটি টাকার মতো হলেও পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা দেখিয়ে রাজস্ব আদায় করা হয়েছে। এতে রাজস্ব ও ভ্যাট আদায়ে ১১০ কোটি টাকারও বেশি রাজস্বের ক্ষতি হয়েছে। আর সুপারভিশন ফিস আদায়ে ব্যর্থতার পরিমাণ ১ কোটি ৬০ লাখ টাকারও বেশি।
অডিট রিপোর্টে আরেক আপত্তিতে দেখা যায়, প্রকল্পের মাধ্যমে আমদানিকৃত বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের ৬ জাহাজ থেকে রেজিস্ট্রেশন ও সুপারভিশন ফিস আদায়ে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৫ লাখ টাকা।
শিপিং অফিসে অনিয়ম
এদিকে, চট্টগ্রামে অবস্থিত শিপিং অফিসেও অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। চট্টগ্রাম বন্দরে আগত বিদেশী সমুদ্রগামী জাহাজের ইনওয়ার্ড ক্লিয়ারেন্স দিতে শিপিং অফিসে রহস্যজনক বিলম্বের ঘটনা ঘটছে, যা শিপিং মহলকে আতঙ্কে রেখেছে। এ ব্যাপারে চট্টগ্রামের শিপিং অফিসে মাস্টারের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সম্প্রতি একটি রেফ্রিজারেটর কার্গো ভেসেল ক্লিয়ারেন্স প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত অজ্ঞাত কারণে আটকে রাখার ঘটনা ঘটে। স্পেশালাইজড এ জাহাজটি দৈনিক ৬ হাজার মার্কিন ডলারহারে লোকসান গুনছে এবং একইসঙ্গে লাইট ভিউজ ও অন্যান্য ফিস বাবদ সরকারও বিপুল অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে।
সূত্র জানিয়েছে, শিপিং অধ্যাদেশ অনুযায়ী বন্দরে আগত ফিশিং জাহাজের ইনওয়ার্ড ক্লিয়ারেন্সের ক্ষেত্রে কিছু শর্ত থাকলেও অন্যান্য জাহাজের ক্ষেত্রে তা নেই। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী জানিয়েছেন, যোগ্যতার অভাবে চট্টগ্রাম শিপিং অফিসে নানা গর্হিত কাজ চলছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, চট্টগ্রাম বন্দরে বছরে তিন হাজারেরও বেশি বিদেশগামী জাহাজের আগমন ঘটে। টনেজভেদে ইনওয়ার্ড ও আউটওয়ার্ড ক্লিয়ারেন্স নিতে একটি জাহাজ ৫ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত কর দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে সরকারের আয় বছরে সাড়ে ৪শ’ কোটি টাকার ওপরে। এ প্রক্রিয়ায় অনৈতিক ব্যত্যয় ঘটলে সরকারের বিপুল রাজস্বহানি ঘটে থাকে।

 

 

 

×