ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বেগম রোকেয়া দিবস আজ

সবখানেই এখন নারীর দৃপ্ত পদচারণা

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ২৩:২৯, ৮ ডিসেম্বর ২০২২; আপডেট: ১১:৪১, ৯ ডিসেম্বর ২০২২

সবখানেই এখন নারীর দৃপ্ত পদচারণা

বেগম রোকেয়া দিবস আজ

রান্না আর ঘর-গৃহস্থালিতেই যখন বন্দি ছিল নারীজীবন, তখনই আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন এক নারী। ঘরের কোণে আবদ্ধ জীবনে তিনি এনেছিলেন মুক্তির আলোকচ্ছটা। যে ধারা আজো বহমান। তার জ্বালিয়ে দেওয়া আলোর পথের যাত্রায় আজ সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছেছে অনেক নারী। দেশের সমস্ত কাজে এখন নারীর দৃপ্ত পদচারণা। চিকিৎসা, শিক্ষা, ব্যবসা, রাজনীতি, আমলাতন্ত্রসহ খেলাধুলায়ও সমানে ছড়াচ্ছেন দক্ষতার ছাপ।

আর তাদের উদ্বুদ্ধ করতে যে নারী আলোর মশালটা জ্বেলেছিলেন, তিনি বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। প্রায় দেড়শ’ বছর আগে দেশের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে জন্ম নেওয়া এই নারী বেরিয়ে এসেছিলেন জন্ম-জন্মাত্তরের অবরোধ ভেঙে। দেখিয়ে গেছেন নারী মুক্তির দিশা। তার লেখা ‘সুলাতানাস ড্রিমস’-এর মতোই যেন নারীদের আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন আজ সত্যি।

আর সেই নারীকে সম্মাননা জানাতে প্রতিবছর তার জন্ম এবং মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ৯ ডিসেম্বর পালন করা হয় বেগম রোকেয়া দিবস। প্রতিবছরের মতো এ বছরও নানা আয়োজনে আজ শুক্রবার দিবসটি পালন করা হচ্ছে।


দিবসটি উপলক্ষে প্রতিবছরের মতো এবারও সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে দেশজুড়ে নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন কর্মসূচি। বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আজ সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ দেশের পাঁচজন নারীর হাতে তুলে দেওয়া হবে ‘বেগম রোকেয়া পদক-২০২২’। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় জানায়, দিবসটি উদ্যাপন উপলক্ষে দেশব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।

এ সব কার্যক্রমের অংশ হিসেবে পাঁচ নারীকে এ সম্মাননা দেওয়া হচ্ছে। এ সম্মাননা পদক তুলে দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নারীশিক্ষায় অবদানের জন্য এ বছর সম্মাননা পাচ্ছেন ফরিদপুরের রহিমা খাতুন, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় চট্টগ্রামের অধ্যাপক কামরুন নাহার বেগম (অ্যাডভোকেট), নারীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখায় সাতক্ষীরার ফরিদা ইয়াসমিন, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে নারী জাগরণে অবদান রাখায় নড়াইলের ড. আফরোজা পারভীন এবং পল্লী উন্নয়নে অবদান রাখায় ঝিনাইদহের নাছিমা বেগম। পদকপ্রাপ্তরা ১৮ ক্যারেট মানের ২৫ গ্রাম সোনা দ্বারা নির্মিত একটি পদক, পদকের একটি রেপ্লিকা, নগদ চার লাখ টাকা এবং একটি সম্মাননাপত্র পাবেন।


বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. আয়েশা আক্তার জনকণ্ঠকে বলেন, একটা সময় আমাদের মেয়েরা পুরুষ চিকিৎসকের কাছে গর্ভকালীন সেবা নিতে অস্বীকৃতি জানাতেন। নারী চিকিৎসক ছিলেন হাতেগোনা কয়েকজন। কিন্তু আজ সেই অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসেছি আমরা।

শুধু রাজধানীই নয়, দেশের সব অঞ্চলেই চিকিৎসায় নারীরা যে অবদান রাখছেন, তা দেশ-বিদেশেও প্রশংসিত হয়েছে। বিশেষ করে করোনাকালে আমাদের চিকিৎসক-নার্সরা রোগীদের যে সেবা দিয়েছেন, তা আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসা লাভ করেছে। কিন্তু এ সব সম্ভব হতো না, যদি সেই ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে বেগম রোকেয়া আলোর প্রদীপটা জ্বালিয়ে না যেতেন।


একই কথা বলেন পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ড. রুবানা হক। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, একজন নারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হবেন- এটা অবিশ্বাস্য একটা শব্দ ছিল যুগের পর যুগ। সমাজের মানুষের বদ্ধ ধারণা ছিল নারীরা শুধু রান্না-ঘর-গৃহস্থালীর কাজই পার করে দেবেন জীবন। কিন্তু এখনকার চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। নারীরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন দেশের অন্যতম রপ্তানি খাত পোশাক শিল্পে। দেশ-বিদেশের ক্রেতাদের সঙ্গে সমানতালে প্রদর্শন করে যাচ্ছেন নিজের যোগ্যতা, যা ২০ বছর আগেও কল্পনা করতে পারত না কেউ।


১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুরের মিঠাপুকুর থানার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বেগম রোকেয়া। রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়েও তিনি নারী জাগরণের অগ্রদূতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন খ্যাতিমান বাঙালি সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক এই নারীর মৃত্যু হয় ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর। বাবা জহির উদ্দিন মুহম্মদ আবুল আলী হায়দার সাবের, মা রাহাতুন্নেছা চৌধুরানী।

বেগম রোকেয়ার ছিল দুই ভাই ও দুই বোন। বড় ভাই ইবরাহিম সাবের ছিলেন একজন প্রগতিশীল মানুষ। অগোচরে মোমের আলোয় বেগম রোকেয়া ও আরেক বোন করিমনুন্নেছাকে দিতেন বর্ণশিক্ষা। আর রোকেয়ার ছিল জানার ও শিক্ষার অদম্য আগ্রহ।


বেগম রোকেয়ার জীবনী পর্যালোচনায় জানা যায়, ১৮৯৬ সালে ১৬ বছর বয়সে বেগম রোকেয়ার বিয়ে হয় ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট খান বাহাদুর সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। রোকেয়া পেলেন আরেকজন প্রগতিশীল মানুষের সাহচার্য। বেগম রোকেয়ার লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ দেখে স্বামী সাখাওয়াত হোসেন তাকে সাহায্য করতে লাগলেন বাংলা ও ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে।

তার লেখালেখিতেও সাহায্য করতে লাগলেন। এই শিক্ষাই বেগম রোকেয়াকে ভাবতে শিখিয়েছিল সে সময়ের অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন জীবন, শিক্ষাহীন নারী সমাজের মুক্তির কথা। অশিক্ষার অন্ধকার থেকে কী করে তাদের টেনে তোলা যায়, সে ভাবনা থাকত তার। আর তাই তো তিনি স্বপ্ন দেখলেন একটি স্কুলের। যেখানে সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীরা লেখাপড়া শিখবে। আর তার এ স্বপ্নকে আরও বড় করে তোলেন তার স্বামী সাখাওয়াত হোসেন।

১৯০২ সালে ‘পিপাসা’ নামে একটি বাংলা গল্প লিখে বেগম রোকেয়ার সাহিত্য জগতে প্রবেশ। আর ১৯০৫ সালে রোকেয়া ইংরেজিতে লিখলেন তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘সুলতানাস ড্রিমস’। সাখাওয়াত হোসেন লেখাটি পড়ে অভিভূত হন এবং তাকে উৎসাহ দেন লেখাটি বই আকারে প্রকাশের জন্য। ১৯০৮ সালে ‘সুলতানাস ড্রিমস’ বই আকারে প্রকাশিত হয়।

পরবর্তীকালে বইটি বাংলায় ‘সুলতানার স্বপ্ন’ নামে রূপান্তরিত হয়ে প্রকাশিত হয়। এই বইটিকে বিশ্বের নারীবাদী সাহিত্যে একটি মাইলফলক হিসেবে গণ্য করা হয়। তার অন্য গ্রন্থগুলো হলো- ‘অবরোধবাসিনী’, ‘মতিচুর’, ‘পদ্মরাগ’। ১৯০৯ সালে সাখাওয়াত হোসেন খান মৃত্যুবরণ করেন। স্বামীর মৃত্যু তাকে অকাল বৈধব্য এনে দিলেও তার জ্ঞানস্পৃহা, মুক্তির আগ্রহ বন্ধ হলো না।

‘নারী শিক্ষার প্রসার ছাড়া নারী সমাজের মুক্তি নেই এবং সমাজের কোনো আশা নেই’ এই মূলমন্ত্রে বিশ্বাসী বেগম রোকেয়া সমাজের প্রবল প্রতাপের বাধা থেকে বেরিয়ে এসে নারী জাগরণে কাজ করে যান। সেই সঙ্গে তার আন্দোলনে যোগ হয় নারী সমাজের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম।


বেগম রোকেয়া দিবস উদ্্যাপন উপলক্ষে সমাজের নানা স্তরে অবদান রাখার জন্য ৫ জন নারীর হাতে আজ সম্মাননা পদক তুলে দেওয়া হবে। এ উপলক্ষে বুধবার আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির হাজার বছরের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বপ্ন পূরণের মাস।

স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বে আত্মপরিচয় লাভ করে বাঙালিরা এবং অর্জন করে নিজস্ব ভূখ- আর লাল সবুজের নিজস্ব পতাকা। ইন্দিরা আরও বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনাও নেতৃত্বে দেশে নারীর ক্ষমতায়নের শুরু। তিনি সংবিধানে নারী সম-অধিকার, মহান মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের বীরাঙ্গনা সম্মানে ভূষিত, চিকিৎসা ও পুনর্বাসন করেন। তাদের কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন।
‘রোকেয়া তার সময় থেকে অগ্রসর মানুষ ছিলেন’ ॥ রোকেয়া তার সময় থেকে অগ্রসর মানুষ ছিলেন। তার সাহিত্যকর্ম ও সক্রিয়তা নিবেদিত ছিল নারী মুক্তি তথা মানবমুক্তির বৃহত্তর স্বার্থে। তিনি নারীকে তার অধিকারের প্রশ্নে জাগ্রত করার সঙ্গে সঙ্গে পুরুষকেও জাগানোর চেষ্টা করেছেন, যেন নারীকে তার প্রাপ্য স্থান বুঝিয়ে দিতে পুরুষেরা কার্পণ্য না করে।

এ কারণে রোকেয়া যেমন তার সময়কালে ছিলেন অমূল্যায়িত তেমনি এখনো অনেকটা অনাবিষ্কৃত। রোকেয়াকে প্রকৃত মূল্যায়ন এবং আবিষ্কার করতে হলে তার চিন্তা ও কর্মের যথাযথ অনুসরণ করতে হবে। এভাবেই নারী জাগরণের অগ্রদূত রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে মূল্যায়ন করলেন কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক।


আজ শুক্রবার রোকেয়া দিবস উপলক্ষে বৃহস্পতিবার বাংলা একাডেমি আয়োজিত নারী জাগরণে রোকেয়া সাখাওয়াতের অবদান ও সাম্প্রতিক ভাবনা শীর্ষক একক বক্তৃৃতা করেন কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক। একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে অনুষ্ঠিত আলোচনায় সূচনা বক্তব্য দেন একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। সভাপতিত্ব করেন একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন।


মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেন, রোকেয়া নারী মুক্তির গান গেয়েছেন এবং একইসঙ্গে মানব সাম্যের কথা বলেছেন। তার যুগান্তকারী চিন্তা-ভাবনা, রচনা এবং লড়াই বাংলার নারীদের মুক্তির পথ অবারিত করেছে এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মানুষের মাঙ্গলিক সমাজ প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করেছে।

×