ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

আগামী গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ সমস্যা হবে না

কেটে যাবে জ্বালানি সংকট

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ০০:১৪, ৩ ডিসেম্বর ২০২২

কেটে যাবে জ্বালানি সংকট

.

করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে জ্বালানি খাতে কঠিন এক সময় পার করছে পুরো বিশ্ব। উচ্চ মূল্যের জ্বালানি কিনতে দিশাহারা অবস্থায় পড়েছে বিশ্বের বাঘা বাঘা দেশগুলোও। এই চ্যালেঞ্জের মধ্যে যেতে হচ্ছে বাংলাদেশকেও। তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ সব খাতেই বিরাজ করছে তীব্র সংকট। তবে নতুন বছরে এ সংকট কেটে যাওয়ার আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। রয়েছে এর যুতসই যুক্তিও। গ্যাসের সংকট কাটাতে দেশের অভ্যন্তরের কূপগুলো নতুন করে খননের পাশাপাশি নতুন নতুন কূপ খননে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। পাশাপাশি পাওয়া গেছে নতুন বাজারও। প্রচলিত বাজারের বাইরে সম্পূর্ণ নতুন একটি দেশ থেকে আসতে যাচ্ছে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি)। যার সব প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত। ওই দেশের পাশাপাশি অন্য আরেকটি দেশ থেকেও গ্যাস আনার জন্য জোর চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার।

বিদ্যুতেও রয়েছে সুখবর। রামপালসহ অভ্যন্তরের কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নতুন ইউনিটগুলোও উৎপাদন শুরু করেছে। এ মাসেই আসার কথা রয়েছে ভারতের আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎ। ফলে আসছে গ্রীষ্মে বিদ্যুতের সংকট হবে না বলে দৃঢ় বিশ্বাস বিদ্যুৎ বিভাগের। তেলের জন্যও পাওয়া গেছে নতুন বাজার। প্রচলিত বাজারের বাইরে ভারত থেকে পাইপলাইনে তেল আসার প্রক্রিয়া প্রায় সম্পন্ন। নতুন বাজার থেকেও তেল আসার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন বিপিসি। এতসব সম্ভাবনার বিপরীতে নতুন বছর যে জ্বালানির জন্য সুখবরই বয়ে আনবে তা নিয়ে দ্বিমত পোষণ করছেন খোদ সমালোচনাকারিরাও।
গ্যাসের যত সম্ভাবনা ॥ বিশ্বব্যাপী জ্বালানির বাজারে সাম্প্রতিক অস্থিরতার মারাত্মক প্রভাব পড়েছে দেশে। বেড়েছে সব ধরনের জ্বালানি তেলের মূল্য। মোট চাহিদার তুলনায় ৮০০ থেকে ১০০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসেরও সংকট রয়েছে। ফলে বাধ্য হয়েই চাহিদা মেটাতে উচ্চ মূল্যে আমদানি করতে হচ্ছে এলএনজি। কিন্তু বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও অবহেলিত অবস্থায়ই ছিল দেশীয় কূপগুলো। কিন্তু সাম্প্রতিক সংকটে নড়েচড়ে বসে বাপেক্স ও পেট্রোবাংলা। দেশীয় কূপগুলোতে গ্যাস অনুসন্ধান, উন্নয়ন ও ওয়ার্কওভারে নেওয়া হয় ব্যাপক পরিকল্পনা। পেট্রোবাংলা আগেই জানিয়েছিল, চলতি বছরের শেষ ৪ মাসসহ আগামী ৩ বছরে দেশজুড়ে অন্তত ৪৬টি কূপে অনুসন্ধান, উন্নয়ন এবং ওয়ার্কওভারের কাজ পরিচালনা করা হবে। এসব বিষয়ে বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী জনকণ্ঠকে বলেন, দেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি সংকট নিরসনের লক্ষ্যে দেশীয় জ্বালানির উৎস অনুসন্ধানে কাজ করছে সরকার। এ লক্ষ্যে ২০২২-২০২৫ সময়কালের মধ্যে বাপেক্স-পেট্রোবাংলা মোট ৪৬টি অনুসন্ধান, উন্নয়ন ও ওয়ার্কওভার কূপ খননের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এরই অংশ হিসেবে বাপেক্স কর্তৃক শ্রীকাইল নর্থ # ১এ অনুসন্ধান কূপ খননের কাজ শুরু করে ইতোমধ্যে ১৮২ মিটার খনন কাজ সম্পন্ন হয়েছে। খনন সংশ্লিষ্ট মালামাল ও তৃতীয় পক্ষীয় সেবা সংগ্রহপূর্বক শনিবার থেকে কূপ খননের ২য় পর্যায়ের কার্যক্রম শুরু করা হচ্ছে। এ প্রকল্পের আওতায় পর্যায়ক্রমে আরও ২টি মূল্যায়ন কাম উন্নয়ন কূপ সুন্দলপুর-৩ ও বেগমগঞ্জ-৪ খনন করা হবে। শুধু তাই নয় সিলেটের বিয়ানিবাজারে পরিত্যক্ত একটি কূপে নতুন করে গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে। কূপের তিন হাজার ৪৫৪ মিটার গভীর থেকে পরীক্ষা করে গ্যাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এতে এখন গ্যাসের চাপ রয়েছে তিন হাজার ১০০ পিএসআই। একইভাবে ভোলায় মোট ১২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলনযোগ্য রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এর মধ্যে ৬৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে ভোলায়। এর বাইরে উদ্বৃত্ত হিসেবে রয়ে যাবে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস।

এই গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে বরিশালে আনার প্রাথমিক পরিকল্পনা থাকলেও তা বর্তমানে এলএনজি করে জাতীয় গ্রিডে আনার প্রক্রিয়া চলছে বলে তিনি জানান। একইভাবে সিলেটের বিয়ানীবাজার-১, ৫, ৩ এ নতুন করে খনন কাজ চলছে। বিয়ানীবাজার-১ কূপটির তিন হাজার ৪৫০ মিটার গভীর থেকে ৩৫ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হয়। এরপর ২০১৬ সাল থেকে কূপটি পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। গত ১০ সেপ্টেম্বর থেকে কূপটিতে নতুন করে ওয়ার্কওভার (পুনর্খনন) শুরু করে বাপেক্স। একইভাবে শ্রীকাইল নর্থ-১এ এবং ২টি মূল্যায়ন কাম উন্নয়ন কূপ (সুন্দলপুর-৩ ও বেগমগঞ্জ-৪  (ওয়েস্ট) খনন প্রকল্পের কাজও চলমান। শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলায়ও গ্যাস পাওয়া গেছে। সেখানেও চলছে খনন কাজ।
এদিকে সাম্প্রতিক বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সংকটে চাহিদা থাকলেও কাতার চুক্তির বাইরে বাংলাদেশকে এলএনজি দিতে রাজি হয়নি। স্পট মার্কেটে চড়া মূল্যে ভর্তুকি দিয়ে গ্যাস কেনাও বন্ধ করে সরকার। বিদ্যুৎ সংকট কাটাতে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্রগুলোও চলে পুরোদমে। ফলে শিল্প, আবাসিক, বাণিজ্যিক সব খাতেই গ্যাস সংকটে দিশাহারা অবস্থায় কাটাতে থাকে জ্বালানি বিভাগ। জ্বালানি বিভাগ বলছে, বর্তমানে কাতার থেকে বার্ষিক ১.৮ থেকে ২.৫ মিলিয়ন টন এলএনজি আমদানির চুক্তি রয়েছে বাংলাদেশের। ২০১৭ সাল থেকে ১৫ বছর মেয়াদি চুক্তির আওতায় কাতার থেকে এলএনজি আমদানি করে আসছে বাংলাদেশ। কাতারের রাশ লাফান লিকুফাইড ন্যাচারাল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে ওই চুক্তির আওতায় বার্ষিক ১.৮ থেকে ২.৫ মিলিয়ন টন এলএনজি পাওয়ার কথা বাংলাদেশের। সাইড লেটার চুক্তির মাধ্যমে এর অতিরিক্ত হিসেবে বছরে আরও ১ মিলিয়ন টন এলএনজি আমদানির জন্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় এর আগে প্রস্তাব দিয়েছিল, কিন্তু কাতার তাতে সাড়া দেয়নি।

তবে স্বস্তি মিলে সম্প্রতি ব্রুনাইয়ের সুলতানের বাংলাদেশ সফরে। এ সময় দেশটি থেকে গ্যাস পাওয়ার আশ্বাস পাওয়া যায়। সম্প্রতি চূড়ান্ত হয়েছে এর আমদানি প্রক্রিয়া। জ্বালানি বিভাগ বলছে, আগামী বছরের শুরুতেই দেশটি থেকে এলএনজি আমদানি শুরু হতে পারে। ব্রুনাই সফররত বাংলাদেশী প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করার বিষয়েও ইতোমধ্যে চূড়ান্ত আলোচনা হয়েছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানিয়েছেন, দেশটি থেকে বছরে অন্তত দেড় মিলিয়ন টন এলএনজি আমদানি করবে বাংলাদেশ। চুক্তিটি হবে ১০ থেকে ১৫ বছর মেয়াদি।
শুধু তাই নয় বাংলাদেশকে বাণিজ্যিকভাবে এলএনজি সরবরাহ করতে রাজি হয়েছে সৌদি আরবও। দেশটির উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক শেষে সম্প্রতি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, সৌদি আরবের কাছ থেকে বাংলাদেশ এলএনজি কিনতে চাইলে তারা বাংলাদেশকে এলএনজি সরবরাহ করতে আগ্রহ জানিয়েছে। আগামী বছরের শুরুতে সৌদি যুবরাজের বাংলাদেশে সফরের সম্ভাবনা রয়েছে জানিয়ে ইআরডি বলছে, তখনই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হতে পারে। যদি এসব উৎস থেকে গ্যাস ঠিকঠাকভাবে পাওয়া যায় তা হলে সাম্প্রতিক সংকট অনেকটাই কেটে যাওয়ার আশা করছে জ্বালানি বিভাগ।
রামপাল, আদানিসহ নতুন বছরে যোগ হতে পারে রূপপুরের বিদ্যুৎ ॥ বিশ্বব্যাপী মূল্যবৃদ্ধিজনিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ প্রথম ধাক্কাটা খায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে। উচ্চ মূল্যে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ করে দেওয়ায় তেলভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্রগুলোরও উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে চাহিদার তুলনায় প্রায় অর্ধেক বিদ্যুৎ উৎপাদনের কারণে সারাদেশ পড়ে লোডশেডিংয়ের কবলে। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে লোডশেডিংয়ের পাশাপাশি অফিস-আদালতের সময়সূচি কমানোসহ স্কুল-কলেজের ছুটিও কমানো হয়। কিন্তু তার পরও অক্টোবর পর্যন্ত বেসামাল অবস্থাই বিরাজ করে বিদ্যুৎ খাতে। তবে নভেম্বর থেকে বিদ্যুতের চাহিদা কমায় কমতে থাকে লোডশেডিংও। কিন্তু শীত গেলে কি হবে এই চিন্তায় যারা উদ্বিগ্ন তাদের জন্য সুখবর দিচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ। জানিয়েছে, নতুন বছরে রামপাল, আদানিসহ দেশের অভ্যন্তরের বেশ কয়েকটি বিদ্যুতকেন্দ্র নতুন উৎপাদন শুরু করবে। ফলে আসন্ন গ্রীষ্মে থাকবে না এ রকম সংকট।
ইতোমধ্যে রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু করেছে জানিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, গত মাসে এই কেন্দ্রে ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে। এর ঠিক দুই দিন পরই সর্বোচ্চ সক্ষমতায় ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে যায় কেন্দ্রটি। ডিসেম্বরেই জাতীয় গ্রিডে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে কেন্দ্রটি। এ বিষয়ে বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের প্রকল্প পরিচালক সুভাষ চন্দ্র পান্ডে বলেন, পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ উৎপাদন পর্যায়ক্রমে বাড়ছে। সঞ্চালন লাইনের কাজ শেষ না হওয়ায় প্রথম দিকে প্রথম ইউনিটের ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খুলনা অঞ্চলে সরবরাহ করা হলেও ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ এটি জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে। এ লক্ষ্যে সঞ্চালন লাইনও প্রায় প্রস্তুত জানিয়ে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন জনকণ্ঠকে বলেন, পায়রা বিদ্যুতকেন্দ্রের একটি ইউনিট চালিয়ে যে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় তা সরাসরি চলে যায় গোপালগঞ্জে। সেখান থেকে বিতরণ হয় তাদের সাবস্টেশনে। মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, বরিশাল, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, রাজবাড়ী ও কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা পর্যন্ত এই বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। আমরা আশা করেছিলাম সেপ্টেম্বরের মধ্যেই এই সঞ্চালন লাইনটি প্রস্তুত হয়ে যাবে। ফলে এখান থেকে বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করতে পারব। কিন্তু তা হয়নি। তবে কাজ প্রায় শেষ। আশা করছি চলতি মাসেই এখান পায়রা, রামপালের বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ করা সম্ভব হবে।
এদিকে আগামী ১৬ ডিসেম্বর ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যের গোড্ডা জেলার ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্রের তৈরি বিদ্যুৎ দেশের গ্রিডে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে জানিয়ে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক বলেন, আপাতত বিদ্যুতকেন্দ্রটির একটি ইউনিট চালু হচ্ছে।

আগামী  মাসের শুরুতেই পূর্ণাঙ্গভাবে বাণিজ্যিক উৎপাদন এবং বিতরণে দেশের প্রথম তাপভিত্তিক রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্র। যা থেকে দৈনিক অন্তত ৭০০ থেকে ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। একইভাবে ভারতের আদানি গ্রুপেরও প্রায় ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে ১৬ ডিসেম্বর। চুক্তি অনুযায়ী মূল্যেই দুই কেন্দ্র থেকে পাওয়া যাবে প্রায় ১৫শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এরই মাঝে শনিবার রাতে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করেছে আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানির নতুন বিদ্যুতকেন্দ্র। এখান থেকে জাতীয় গ্রিডে প্রতিদিন যোগ হচ্ছে ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। বিদ্যুতের এই বাড়তি উৎপাদন এবং সরবরাহের কারণে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্রগুলোর ওপর চাপ কমবে। বরং এই গ্যাস শিল্প কারখানাগুলোতে সরবরাহ করে চলমান সংকট মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আমরা মনে করছি।

চলতি শীত মৌসুমে বিদ্যুতের চাহিদা না থাকা সত্ত্বেও এই বিদ্যুৎ আনা হবে কেন এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, দেখেন বিশ্বব্যাপী গ্যাসের দাম ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার কারণে আমাদের উচ্চ মূল্যে কেনা গ্যাস দিয়েই গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্রগুলো চালাতে হচ্ছে। যদি এই বিদ্যুৎ আসে তা হলে চাহিদার একটা বড় অংশ এর মাধ্যমেই পূরণ হয়ে যাবে। ফলে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখলেও চলবে। এতে করে শিল্পে বাড়তি গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হবে। এভাবে চললে বিদ্যুৎ খাতে আপাত স্বস্তির খবরই বলে দাবি করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
তেলের বাজারেও সুখবর ॥ বিশ্ব বাজারে তেলের জন্য হাহাকার। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে চড়া দামে পরিশোধিত-অপরিশোধিত তেল কিনতে হচ্ছে বিশ্ববাসীকে। এমন অবস্থায় দেশের তেলের বাজারে কিছুটা হলেও সুসময় আসবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। আর এর কারণ ভারত-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপ লাইন। এই পাইপ লাইন দিয়ে ভারত থেকে সরাসরি পরিশোধিত তেল (ডিজেল) আসবে দিনাজপুরের পার্বতীপুর ডিপোতে। এতে করে পূরণ হবে উত্তরবঙ্গের ১৬ জেলার মানুষের তেলের চাহিদা। বিশেষ করে অন্যান্য আমদানিজাত তেল পার্বতীপুর ডিপোতে পৌঁছাতে যেখানে প্রায় ১ মাস সময় লাগে সেখানে মাত্র কয়েক ঘণ্টা সময় লাগবে ভারত থেকে এই ডিপোতে তেল আসতে। সেখান থেকে উত্তরের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ হবে এ তেল। এতে কমে যাবে পরিবহন ব্যয়। মোট ১৩১.৫ কিলোমিটার পাইপ লাইনের মধ্যে কাজ শেষ হয়ে গেছে ১৩০ কিলোমিটার পাইপ লাইনের। এখন চলছে নদীর উপরের কাজ। যা এ মাসেই শেষ হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। সব ঠিক থাকলে নতুন বছরের শুরুর দিকেই পার্বতীপুর ডিপোতে এসে পৌঁছাবে ভারতের তেল। প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ আড়াই লাখ টনের মতো ডিজেল আমদানি করবে। পরের বছরগুলোতে তা ৪ থেকে ৫ লাখ টন পর্যন্ত বাড়বে। চুক্তির অধীনে সরবরাহ শুরু হওয়ার দিন থেকে ১৫ বছরের জন্য ভারত থেকে ডিজেল কিনবে বাংলাদেশ। বর্তমানে লুমালীগড় রিফাইনারি লিমিটেড থেকে পশ্চিমবঙ্গ রেলওয়ের মাধ্যমে প্রতি মাসে প্রায় দুই হাজার ২০০ টন ডিজেল আমদানি করে বিপিসি। ২০১৭ সাল থেকে ট্রেনে করে আসছে এ তেল।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) বলছে, বর্তমানে জ্বালানি তেল আনার ক্ষেত্রে প্রতি ব্যারেলে (১৫৯ লিটার) গড়ে ১০ ডলার প্রিমিয়াম (জাহাজ ভাড়াসহ অন্য খরচ) দিতে হয় বিপিসিকে। তবে ভারত থেকে আনার ক্ষেত্রে এটি আট ডলার হতে পারে। প্রতি ব্যারেলে দুই ডলার কমলে প্রতি এক লাখ টনে প্রায় ১৫ লাখ ডলার সাশ্রয় করা সম্ভব। তাই ভারত থেকে আমদানি হলে বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় হবে।
শুধু ভারত নয় সৌদি আরব, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া চীনের মতো তেলের প্রচলিত বাজারের বাইরে আরও ব্রুনাই থেকেও এলএনজির পাশাপাশি তেল আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে জানিয়ে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) এবিএম আজাদ জনকণ্ঠকে বলেন, ইতোমধ্যে নতুন বছরের তেল আমদানির জন্য আমরা সরবরাহকারীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করে দিয়েছি। ৫০ শতাংশ যেহেতু জিটুজি ভিত্তিতে আসবে তাই আমরা সরকারিভাবেই যোগাযোগ করছি। আর ৫০ শতাংশ টেন্ডারে আনার যে প্রক্রিয়া তাও শুরু হয়েছে। তবে আশার খবর যেটা সেটা হচ্ছে সম্প্রতি এলএনজি আনার জন্য ব্রুনাই সফরের সময় আমরা দেশটি থেকে তেল আনার ব্যাপারে কথা বলেছি। তারা আগ্রহ দেখিয়েছে। সব ঠিকঠাক থাকলে দেশটি থেকে তেলও আসতে পারে।
বেসরকারিভাবে জ্বালানি আমদানির সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে সরকার ॥ এদিকে বেসরকারিভাবে জ্বালানি আমদানির সিদ্ধান্ত নিতে চাইছে সরকার। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট জ্বালানি সংকট নিরসনে এমন উদ্যোগ সরকার নিচ্ছে। এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে জ্বালানি বিভাগকে নির্দেশনাও দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এতে যদিও কিছুট নৈরাজ্য তৈরি হবে, কিন্তু জ্বালানির নতুন নতুন বাজার খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনাও তৈরি হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কি বলছেন বিশেষজ্ঞরা : সাম্প্রতিক জ্বালানির যে সংকটকালীন সময় দেশ পার করছে এ নিয়ে সমালোচনা হয়েছে সব মহলে। তবে সব ছাপিয়ে পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়েছে জানিয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম জনকণ্ঠকে বলেন, তেল-গ্যাস-বিদ্যুতে নেয়া এসব উদ্যোগ যদি বাস্তবায়িত হয় তা হলে নতুন বছরে এ খাতগুলোতে ভিন্ন পরিস্থিতি আশা করতেই পারি।
তবে শুধু পরিকল্পনা নয় বরং বাস্তবায়নের সদিচ্ছাও থাকা জরুরি বলে মন্তব্য করেছেন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, আমরা সব সময় দেখি সরকারের শুভ ইচ্ছাগুলো এক শ্রেণির অশুভ লোকের জন্য ব্যর্থতায় পর্যবেসিত হয়। তারই খেসারত গত কয়েক মাস আমরা দিয়েছি। তাই যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নে সদিচ্ছার পাশাপাশি সৎ ইচ্ছাও জরুরি।

 

×