ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

সয়াবিনের নির্ধারিত মূল্য কার্যকর হয়নি

ভোগ্যপণ্যের দাম কমানোর সুফল মিলছে না

এম শাহজাহান

প্রকাশিত: ২৩:১০, ৪ অক্টোবর ২০২২

ভোগ্যপণ্যের দাম কমানোর সুফল মিলছে না

সয়াবিনের নির্ধারিত মূল্য কার্যকর হয়নি

সয়াবিন তেলের দাম কমানো হলেও বাজারে এর কোন প্রভাব পড়েনি। ভোক্তাদের আগের দামেই কিনতে হচ্ছে সব ধরনের ভোজ্যতেল। শুধু সয়াবিন কেন-সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে আরেক অত্যাবশ্যকীয় পণ্য চিনি। প্রতিকেজি চিনিতে ৬ টাকা বেশি নিচ্ছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। একইভাবে আমদানিতে শুল্ক কমানো হলেও কমছে না চালের দাম। বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে-আটা, ময়দা ডিম ও মুরগি। ভরা মৌসুমে ইলিশের স্বাদ নিতেও অন্য বছরের তুলনায় ক্রেতাদের এবার বেশি টাকা গুনতে হচ্ছে।

পণ্যের দাম কমানোর সুফল পাচ্ছে না দেশের মানুষ। এ অবস্থায় নির্ধারিত দাম কার্যকর করতে বাজারে অভিযান পরিচালনা করবে সরকার। নিত্যপণ্যের বাজার তদারকি করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাজার মনিটরিং টিম এবং জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। এছাড়া সরকারী বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা থেকেও এ বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া হবে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।
জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও দেশে সেভাবে কমছে না সয়াবিন ও পামঅয়েলের দাম। এরপর যতটুকু কমানো হয়েছে তাও বাজারে কার্যকর হচ্ছে না। মূলত ভোজ্যতেলের আমদানিকারক ও মিলারদের কারসাজির কারণে বাজারে সয়াবিন ও পামঅয়েলের নির্ধারিত দাম কার্যকর হচ্ছে না। অথচ তিন স্তরে ভ্যাট কমানো হয়েছে ভোজ্যতেলের। সোমবার সয়াবিনের দাম আরেক দফা কমানো হয়েছে কিন্তু ঘোষণা অনুযায়ী মঙ্গলবার বাজারে তার কোন প্রভাব পড়েনি।

ক্রেতারা ভোজ্যতেল কিনেছেন আগের দামে। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, নতুন দামের তেল এখনও তারা পাননি। এমনকি নতুন দামের তেল সরবরাহ করেনি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা। দোকানে যেসব তেল রয়েছে সব আগের দামে কেনা। এ কারণে কম দামে বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না।
খিলগাঁও গোড়ান বাজারের মুদিপণ্যের ব্যবসায়ী আবিদ হাসান টিটু এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, তারা আগের দামেই তেল বিক্রি করছেন। দুএকদিনের মধ্যে যদি নতুন দামের তেল আসে তাহলে কম দামে বিক্রি করা সম্ভব হবে। ওই বাজারের আরও কয়েকটি দোকানে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, বোতলজাত ও খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে আগের মতো বেশি দামে। এমনকি খোলা পামঅয়েলও ক্রেতাকে বেশি দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে।

একই অবস্থা বিরাজ করছে খিলগাঁও সিটি কর্পোরেশন কাঁচাবাজারে। সেখানেও বেশিরভাগ মুদি দোকানদার নতুন দামে তেল বিক্রি করছে না। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি এক লিটারের বোতল ১৯২ এবং হাফ লিটারের ক্যান ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে। এছাড়া পাঁচ লিটারের ক্যান কিনতে একজন ভোক্তাকে গুনতে হচ্ছে ৯৪৫-৯৬০ টাকা পর্যন্ত। এছাড়া প্রতিলিটার পামঅয়েলের নির্ধারিত দাম ১৩২ টাকার চেয়ে বেশি মূল্যে বিক্রি হচ্ছে।

সয়াবিনের নির্ধারিত দাম কার্যকর না হওয়ায় এ নিয়ে নগরবাসী সাধারণ ভোক্তাদের অসন্তুষ্টি রয়েছে। মঙ্গলবার অনেক ক্রেতা বাজারে এসে নতুন দামের তেল না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। অনেককেই আবার হতাশা ব্যক্ত করতে দেখা গেছে। মুগদাপাড়া বড়বাজারে তেল কিনতে এসেছিলেন ওই এলাকার ব্যাংক কলোনির বাসিন্দা ও ব্যাংক কর্মকর্তা আকতার হোসেন। তিনি জানান, পত্রিকা ও টিভি দেখে কম দামে সয়াবিন কিনতে এসেছিলাম। কিন্তু নতুন দামে কেউ তেল বিক্রি করছে না। সবই দেখছি আগের দামে বিক্রি হচ্ছে।

ঢাকার কাপ্তানবাজারের ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, দুএকদিনের মধ্যে হয়তো নতুন দামে তেলের সরবরাহ বাড়বে। তখন ক্রেতারা কমদামে সয়াবিন কিনতে পারবেন। ওই বাজারের জামশেদ স্টোরের ম্যানেজার আব্দুল গনি মিয়া জনকণ্ঠকে বলেন, ক্রেতারা নতুন দামের তেল খোঁজ করছেন, কিন্তু আমরা দিতে পারছি না। মুদি দোকানদাররা প্রতিদিন তেল এনে বিক্রি করে। ফলে নতুন দামের তেল পাওয়া গেলেই বাজারে তার প্রভাব পড়বে। তবে পাইকারি ব্যবসায়ী বলছেন, মিলারদের কারসাজির কারণে তেলের দাম কমছে না।

খোলা সয়াবিন ও পামঅয়েলের বাজার এখন মোটামুটি স্থিতিশীল। কিন্তু সেই তুলনায় বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম অনেক বেশি। আন্তর্জাতিক বাজার পর্যবেক্ষণ করে দাম নির্ধারণ করা হলে সয়াবিন তেলের মূল্য আরও কমানোর সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সেটি হচ্ছে না মিলারদের কারণে। কারণ বোতলজাত সয়াবিনের ব্যবসা করছেন মিল মালিকরাই। এ কারণে বোতলজাত তেলের দাম সেভাবে কমছে না।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাজী মোহাম্মদ আলী ভুট্টো জনকণ্ঠকে বলেন, ভোজ্যতেল নিয়ে ব্যবসায়ীদের কিছু কারসাজি রয়েছে। কিন্তু কারা কারসাজির সঙ্গে জড়িত সেটা সরকারকেই খুঁজে বের করতে হবে। খোলা পামঅয়েল ও সয়াবিন নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কমদামে পাইকারি ব্যবসায়ীরা বিক্রি করছেন। অথচ বোতলজাত সয়াবিনের দাম সেভাবে কমানো হচ্ছে না। শুধু বোতলে ভরে বিক্রি করলেই অতিরিক্ত মুনাফা করতে হবে? এসব জায়গায় সরকারের তদারকি বাড়ানো প্রয়োজন।

এদিকে মিল মালিকদের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, নতুন দামের তেল সরবরাহ শুরু হয়েছে। অনেক ব্যবসায়ী ইতোমধ্যে সয়াবিন তেল পেয়েছেন। আশা করছি এখন থেকে ভোক্তারা কমদামে তেল কিনতে পারবেন। তবে সরকারী সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, মিল মালিকদের আগেই কিংবা মঙ্গলবার সকাল থেকেই খুচরা বাজারে নতুন দামের তেল সরবরাহ করা উচিত ছিল। হয়তো সরবরাহ ব্যবস্থায় ত্রুটির কারণে এমনটি হয়েছে।

তবে ঘোষণা হওয়ার পরও যারা সয়াবিন নতুন দামে বিক্রি করছে না তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেবে সরকার। তিনি জানান, শুধু ভোজ্যতেলই নয়, চিনি, চাল, ডিম এবং ব্রয়লার মুরগির দামও বেশি নেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিষয়গুলো সরকারের নজরে আসায় গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। শীঘ্রই বাজারে অভিযান পরিচালনা করবে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স এ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যাসোসিয়েশন সোমবার এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায় বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি ১৪ টাকা কমছে। প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৭৮ টাকা। আগের দাম ছিল ১৯২ টাকা। ওই বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়, সয়াবিন তেলে নতুন দর মঙ্গলবার থেকে কার্যকর হবে। ভোক্তাদের সুবিধার্থে ভোজ্যতেলের দাম লিটারপ্রতি ১৪ টাকা কমিয়ে পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে খোলা সয়াবিনের দাম কমেছে লিটারপ্রতি ১৭ টাকা।

সংগঠনটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের নতুন দাম হবে ১৫৮ টাকা। বর্তমানে বাজারে খোলা সয়াবিন প্রতিলিটার ১৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর ৫ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ৯৪৫ টাকা থেকে ৬৫ টাকা কমিয়ে করা হয়েছে ৮৮০ টাকা। তার মানে, বোতলজাত ৫ লিটার সয়াবিনে লিটারপ্রতি ১৩ টাকা কমেছে। বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমায় এর আগে গত ১৭ জুলাই সয়াবিন ও পাম তেলের দাম কমায় তেল বিপণনকারী কোম্পানিগুলো। এরপর গত ২৩ আগস্ট আবার সয়াবিনের দাম লিটারপ্রতি ৭ টাকা বৃদ্ধি করে। দেড় মাসের ব্যবধানে সেই দর কমানো হলো।
চিনির দাম বেশি নেয়া হচ্ছে ॥ বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, প্রতিকেজি চিনিতে এখনও ৬ টাকা বেশি নিচ্ছে ব্যবসায়ীরা। সরকার নির্ধারিত দাম কার্যকর হচ্ছে না। এরই মধ্যে আবার চিনির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে ব্যবসায়ীরা। বিক্রেতারা জানিয়েছেন, চিনি নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশিতে কিনতে হচ্ছে বলেই বিক্রি করতে হচ্ছে বেশি দামে। মঙ্গলবার রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিকেজি পরিশোধিত খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকায়।

আর পরিশোধিত প্যাকেটজাত চিনি বিক্রি হচ্ছে ৯৫ টাকায়। অথচ সরকারীভাবে দাম বেঁধে দেয়া হয়েছে ৮৪ ও ৮৯ টাকা। সেই হিসেবে, খোলা ও প্যাকেটজাত চিনির কেজিতে ৬ টাকা বেশি গুণতে হচ্ছে ক্রেতাদের। বাংলাদেশ ট্রেড এ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ২২ সেপ্টেম্বর এক প্রজ্ঞাপনে পাম সুপার খোলা, পরিশোধিত চিনি খোলা ও পরিশোধিত প্যাকেটজাত চিনির সর্বোচ্চ খুচরা দাম নির্ধারণ করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

এরই মধ্যে আবার চিনির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স এ্যাসোসিয়েশন। বাংলাদেশ ট্রেড এ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের উপপরিচালক মাহমুদুল হাসান জানিয়েছেন, কী যুক্তিতে দর বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছেন, সে বিষয়ে চিনি ব্যবসায়ী সমিতির কোন বক্তব্য জানা যায়নি।
অন্যদিকে মন্ত্রণালয়ের আমদানি ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য (আইআইটি) বিভাগের প্রধান একেএম আলী আহাদ খান জনকণ্ঠকে বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে যে মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে সেটা সবকিছু বিচার বিশ্লেষণ করেই করা হয়েছে। সুতরাং নতুন করে দাম বৃদ্ধির আগে আগের আদেশ পালন করতে হবে। ব্যবসায়ীদের নতুন প্রস্তাব নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেটা ট্যারিফ কমিশন খতিয়ে দেখবে।

এদিকে, দেশে চিনির মোট চাহিদার অধিকাংশই আমদানি করে মেটাতে হয়। দেশে বছরে ১৮ থেকে ২০ লাখ টন পরিশোধিত চিনির চাহিদা রয়েছে। রাষ্ট্রীয় চিনিকলগুলো থেকে আসে সর্বোচ্চ এক লাখ টনের মতো চিনি। বাকিটা পূরণ হয় আমদানি থেকে। এছাড়া শুল্ক কমানোর সুবিধা মিলছে না চালের বাজারেও। ভারত থেকে আমদানি হওয়া চালও এসেছে। আবার চালের বাজারে অস্থিরতার অভিযোগে ১৯ চাল ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে মামলাও করেছে প্রতিযোগিতা কমিশন।

সরকারের এত কিছু পদক্ষেপের পরও চালের দাম কমেনি। তবে দাম না কমলেও চালের বাজারের অস্থিরতা কিছুটা কমেছে। তবে বিক্রি হচ্ছে আগের মতো বেশি দামেই। প্রতিকেজি সরু মিনিকেট ও নাজিরশাইল চাল মানভেদে ৬৫-৮০, মাঝারি মানের পাইজাম ও লতা ৫৫-৬০ এবং মোটা মানের স্বর্ণা ও চায়না ইরি ৫৩-৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে।

×