ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আজ মহাসপ্তমী

উৎসবের আবহে শারদীয় দুর্গোৎসব শুরু

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ২৩:৪৬, ১ অক্টোবর ২০২২

উৎসবের আবহে শারদীয় দুর্গোৎসব শুরু

দুর্গাপূজা শুরুর মহাষষ্ঠীর দিনে সকাল সকাল মন্দিরে ভক্তবৃন্দের আগমন

রৌদ্রোজ্জ্বল দিনের অগ্রভাগে সম্পন্ন হয়েছে দেবীর বোধন অনুষ্ঠান। বেশ ভালই কেটেছে দেবীর অধিবাস-আমন্ত্রণ। ষষ্ঠীপূজার মধ্য দিয়ে শনিবার সূচিত হয়েছে পাঁচ দিনব্যাপী বাঙালীর শারদোৎসব দুর্গাপূজা। ঢাকের বাদ্য, শঙ্খ-উলুধ্বনি আর ভক্তকুলের আবাহনের মন্ত্রোচ্চারণে দেবী দুর্গার স্বর্গ থেকে মর্ত্যে আগমন ঘটেছে। পূজার মন্ত্রোচ্চারণ, মন্দিরে মন্দিরে ধূপ-ধুনোয় ভক্তদের নৃত্য আরতি, আর ঢাক-ঢোল, কাঁসর-মন্দিরার পাশাপাশি মাইকের আওয়াজে এখন মাতোয়ারা সারাদেশের পূজাম-পগুলো। দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনে দুর্গতিনাশিনীর আগমনে আনন্দে বিহ্বল বিশ্বের হিন্দু সম্প্রদায়।
ভক্তদের পূজা গ্রহণের জন্য দুর্গা দেবীর মর্ত্যে আগমনের পর শনিবার ষষ্ঠী তিথিতে ম-পে ম-পে দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গার অধিষ্ঠান হয়। ষষ্ঠীপূজার মধ্য দিয়েই মূলত শুরু হলো পাঁচদিনের দুর্গোৎসবের। মাতৃরূপে কৈলাশ ছেড়ে পিতৃগৃহে এসেছেন ত্রিনয়নী দেবী মা দুর্গা। ষষ্ঠী তিথিতে সকাল ৯টা ৫৭ মিনিটের মধ্যে ষষ্ঠ্যাদি কল্পারম্ভ ও ষষ্ঠীবিহিত পূজা শুরু হয়। এ সময় বেলতলা কিংবা বেলগাছের নিচে দেয়া হয় ষষ্ঠীপূজা। সন্ধ্যায় আমন্ত্রণ ও অধিবাস ছাড়াও সব ম-পে পুষ্পাঞ্জলি, প্রসাদ বিতরণ ও ভোগ-আরতির আয়োজন করা হয়। সন্ধ্যায় বিশেষ আলোকসজ্জাসহ অনেক ম-পে বিশেষ প্রার্থনা ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
কড়া নিরাপত্তায় দেবীর আগমনে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত পর্বের চাঞ্চল্য ও মুখরতার আবহে সারাদেশের ৩২ হাজারেরও বেশি ম-পে শুরু হয় দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা। নানা আলোকচ্ছটায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে পূজাম-পগুলো। প্রতিটি মন্দির-ম-প সেজেছে আপন সৌন্দর্যে। উৎসবের ™ি^তীয় দিনে আজ রবিবার মহাসপ্তমী। সকাল ৯টা ৫৭ মিনিটে ত্রিনয়নী দেবী দুর্গার চক্ষুদান, নবপত্রিকা প্রবেশ, স্থাপন, সপ্তম্যাদি কল্পারম্ভ ও সপ্তমীবিহীত পূজা শুরু হবে। পূজা শেষে অঞ্জলি প্রদান, প্রসাদ বিতরণ ও ভোগ-আরতির আয়োজন থাকবে। এভাবে আগামীকাল মহাষ্টমী ও কুমারী পূজা, মঙ্গলবার নবমী পূজা এবং পরদিন বুধবার দশমী পূজা ও প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে পাঁচ দিনব্যাপী দুর্গোৎসব।
দুর্গতিনাশিনী দুর্গা এসেছেন বিশ্ব শান্তির জন্য তথা সবার মঙ্গলের তরে। কিন্তু অসুরবিনাশিনী জগজ্জননী দেবী দুর্গা বাঙালীগৃহে আসেন অন্যভাবে। কৈলাশ ছেড়ে প্রতিবছর তিনি আসেন বাবার বাড়িতে কন্যা রূপে। দেবী দুর্গার সঙ্গে প্রতি শরতে মর্ত্যে আসেন লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশ। এই চালচিত্রে দেবাদিদেব শিবও বাদ যান না। লক্ষ্মী সমৃদ্ধি ও সরস্বতী জ্ঞানের প্রতীক। কার্তিক হচ্ছেন দেবসেনাপতি, শত্রুনাশকারী। আর গণেশ হচ্ছেন সর্বসিদ্ধিদাতা অর্থাৎ মানুষের কামনা পূরণকারী। বাঙালী হিন্দুরা যে কোন শুভ কাজে ইষ্টনাম হিসেবে দেবী দুর্গাকে স্মরণ করে থাকেন।
ধর্ম ও সংস্কৃতি ভিন্ন হলেও তা যে সার্বজনিন, তা শারদীয় দুর্গাপূজা এলে সহজে বোঝা যায়। শুধু শহর নয়, প্রত্যন্ত গ্রামেও শারদীয় দুর্গাপূজায় আনন্দের অন্ত নেই। সেখানকার মাইকে মাইকে ভেসে উঠে কীর্তন কিংবা পুরনো দিনের গানের সুর। ‘আজি শঙ্খে মঙ্গলগাও জননী এসেছে দ্বারে’ কিংবা ‘জাগো দুর্গা, জাগো দশভুজা জগজ্জননী মা’- এই আহ্বান যেন আকাশে-বাতাসে।

জ্ঞান-কর্ম ও নিদ্রার তিন গুণের আধারে দেবী মহামায়াকে বন্দনা করতে ভক্তপ্রাণে যেন আকুতির শেষ নেই। গ্রামের কোথাও পূজা উপলক্ষে চলছে রামায়ণ, অষ্টক, কবি ও যাত্রাগাণ। বিচিত্র পসরা সাজিয়ে বসেছে মেলা। নাড়ু, মুড়কি, খৈ-বাতাসা, কদমাসহ নানা জাতের মিষ্টির সমারোহ প্রতিটি বাড়িতে বাড়িতে। যার যতটুকু সাধ্য উৎসবের আনন্দ তার ততখানিই।

শনিবার পূজাম-পগুলো ঘুরে দেখা গেছে প্রায় একই দৃশ্য। পূজার সব প্রস্তুতি শেষ হয়েছে গত সকালেই। শেষ তুলির ছোঁয়াও শেষ হয়েছে প্রায় প্রতিটি ম-পে। শিল্পীর নিপুণ তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে দুর্গাদেবীসহ প্রতিমাগুলোকে। প্রতিটি ম-প সাজানো হয়েছে মনোলোভা সাজে। অনেক ম-পে দেবী দুর্গার আগমন ঘটনাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নিপুণ দক্ষতায়। বর্ণিল সাজ ও আলোকসজ্জায় সেজেছে পূজাম-প ও আশপাশের এলাকা। ছোট-বড় প্যান্ডেল, মঞ্চ, রং-বেরঙের ব্যানার-ফেস্টুন দিয়েও সাজানো হয়েছে ম-পগুলো। ম-পগুলোর প্রবেশদ্বারে নির্মাণ করা হয়েছে ছোট-বড় রং-বেরঙের তোরণ।
আনন্দমুখর পরিবেশের পাশাপাশি নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রতিটি ম-পে পুলিশ ও আনসারের পাশাপাশি কোথাও কোথাও নিযুক্ত করা হয় র‌্যাব সদস্যদেরও। সাদা পোশাকে গোয়েন্দা সদস্যদের ছিল সতর্ক প্রহরা। অনেক ম-পে বসানো হয়েছে আর্চওয়ে ও মেটাল ডিটেক্টর। তবে এতসব কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ছেদ ফেলেনি পূজার উৎসবমুখরতায়। নিরাপত্তা বাহিনীর উর্ধতন কর্মকর্তারা ঢাকেশ্বরী মন্দিরসহ বড় বড় পূজাম-পগুলো পরিদর্শন করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছেন।
শনিবার থেকে পূজা শুরু হলেও রাজধানীর পূজাম-পগুলোতে ভক্ত আর দর্শনার্থীদের ভিড় তেমন একট লক্ষ্য করা যায়নি। আয়োজকরা জানান, আজ মহাসপ্তমী থেকে দর্শনার্থীদের ভিড় বাড়তে থাকবে। আগামীকাল সোমবার মহাষ্টমী থেকেই জমে উঠবে উৎসব। ওই দিন থেকেই মূলত মন্দিরে, ম-পে ভক্ত ও দর্শনার্থীদের ঢল নামবে। ঢাকেশ^রী জাতীয় মন্দিরের মূল পূজাম-পের সামনে তৈরি করা হয়েছে বিশাল প্যান্ডেল। মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির তত্ত্বাবধানে পূজাম-প ও মন্দিরকে সাজানো হয়েছে নতুন রং ও সাজে। আলোকসজ্জায় সজ্জিত করে তোলা হয়েছে সমগ্র মন্দির ও সংলগ্ন এলাকাকে। দেবীর বোধন শেষে সন্ধ্যায় এখানে অনুষ্ঠিত হয় ভক্তিমূলক সঙ্গীতানুষ্ঠান।
এ ছাড়া রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠ পূজাম-প, রমনা কালীমন্দির ও আনন্দ্রময়ী আশ্রম, কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটের দুর্গাম-প, সিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়ি, গুলশান-বনানী সার্বজনীন পূজা ফাউন্ডেশন ম-প, রাজারবাগের বরোদেশ্বরী কালীমাতা মন্দির ও শ্মশান পূজাম-প, মিরপুর কেন্দ্রীয় মন্দির, জয়কালী রোডের রামসীতা মন্দির, পুরনো ঢাকার অভয়নগর দাস লেনের ভোলানন্দগিরি আশ্রম, রাধিকা বসাক লেন, নবেন্দ্র বসাক লেন, ঢাকেশ্বরী বাড়ি, শাঁখারিবাজার পান্নিটোলা, টিকাটুলির প্রণব মঠ, ঠাঠারিবাজার পঞ্চানন শিবমন্দির, সূত্রাপুরের ঋষিপাড়া গৌতম মন্দির, বনগ্রাম তরুণ সংসদ, ওয়ারি সার্বজনীন পূজাম-প, ফরাশগঞ্জ জমিদার বাড়ি, বিহারী লাল জিউ মন্দির, জগন্নাথ হল পূজাম-পসহ বিভিন্ন মন্দির ও ম-পে উৎসবমুখর পরিবেশে শুরু হয়েছে দুর্গাপূজা।
দুর্গাপূজা উপলক্ষে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের সকলের প্রতি আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়েছে বাংলাদেশের ভারতীয় হাইকমিশন। কমিশনের পক্ষ দেয়া শুভেচ্ছা বাণীতে বলা হয়, দুর্গাপূজা এমন একটি উৎসব, যা মন্দের ওপর ভালোর বিজয়ের প্রতীক। সামাজিক-সাংস্কৃতিক বন্ধনের অংশ, যা বাংলাদেশ ও ভারতকে আবদ্ধ করে।
ঢাবি উপাচার্যের শুভেচ্ছা ॥ বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার জানান, শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ সকলকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়েছেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ আখতারুজ্জামান। শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দফতর থেকে পাঠানো এক শুভেচ্ছা বার্তায় উপাচার্য সকলের সুখ, শান্তি, মঙ্গল ও সমৃদ্ধি কামনা করে বলেন, ‘দুর্গোৎসব বাঙালী হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব’।

×