.
বাংলাদেশী কূটনীতিকরা নারী ও মাদক কেলেঙ্কারি থেকে গৃহকর্মী নির্যাতনে জড়িয়ে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছেন। নিজের সুনামহানির পাশাপাশি গ্রেফতার হয়েছেন তাদের অনেকেই। কাজী আনারকলি নামের ২০ ব্যাচের পররাষ্ট্র ক্যাডারের আলোচিত কর্মকর্তা মাদকসহ ইন্দোনেশিায়াতে আটকের পর কূটনৈতিক পাড়াসহ সবখানেই চলছে আলোচনা ও সমালোচনার ঝড়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে কমিটি গঠন করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আনারকলিকে বেপরোয়া জীবনাচরণ মুখরোচক আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে।
চলতি মাসে ইন্দোনেশিয়ায় বাসভবনে মাদক রেখে আটক হয়ে দেশের সুনাম হারিয়েছেন কাজী আনারকলি যিনি ২০তম ব্যাচের পররাষ্ট্র ক্যাডারের কর্মকর্তা। প্রভাবশালী এই নারী কূটনীতিক আগে কিছু নারী কেলেঙ্কারির তদন্ত কমিটিতেও ছিলেন। তার বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক ও বেপরোয়া জীবন নিয়ে সর্বত্র রসালো আলাপ চলছে। সম্প্রতি নিজ বাসভবনে নাইজিরিয়ান এক নাগরিকের সঙ্গে মাদকসহ আটক হন কাজী আনারকলি। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, সেই নাইজিরিয়ান নাগরিকের সঙ্গে লিভ টুগেদারে ছিলেন তিনি। আগের কর্মস্থল যুক্তরাষ্ট্রের লস এ্যাঞ্জেলেস থেকেই এই নাইজিরিয়ানকে নিজের সঙ্গে রাখেন বাংলাদেশী এই নারী কূটনীতিক। বিবাহ বহির্ভূত অবৈধ সম্পর্ক ও মাদক নিয়েই আলোচনায় উঠে এসেছেন তিনি। এর আগেও তিনি একাধিক সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা থেকে ফেরত আনা কাজী আনারকলি তার বাসায় থাকা নাইজিরীয় যুবকের সঙ্গে লিভ টুগেদার করতেন। অবশ্য একই অভিযোগ তার বিরুদ্ধে আগেও ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকেই তাকে নিজের কাছে রাখতেন তিনি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, কাজী আনারকলি ২০০০ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে আবেদন করে চাকরি পান। ক্ষমতার পট পরিবর্তন হলে তিনি ২০০১-২০০৩ সালে মন্ত্রণালয়ের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট সহকারী সচিব (রাষ্ট্রাচার ভ্রমণ) হিসেবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সফরসঙ্গী হিসেবে বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেন এবং সে সময় প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার এডিসি বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর অফিসার হাসনাতের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর দফতরের সুপারিশে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আনারকলিকে যুক্তরাজ্যে একটি স্কলারশিপ দেয়। তখন আনারকলি স্বামী রেখে এবং প্রেমিক এডিসি হাসনাত তার স্ত্রী-সন্তান ও চাকরি রেখে একসঙ্গে লন্ডনে যান ও বিয়ে না করেই একসঙ্গে বসবাস করতে থাকেন।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসলে আনারকলির সঙ্গে বিএনপির সময় প্রভাবশালী এডিসি হাসনাতের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় এবং ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আনারকলির সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। গত ২০১২ সালে দেশে ফিরে এসে প্রায় দীর্ঘ চার বছর কাজী আনারকলি অত্যন্ত ক্ষমতাবান পরিচালক (প্রশাসন) হিসেবে কাজ করেন। ২০১৬ সালে কাজী আনারকলিকে যুক্তরাষ্ট্রের লস এ্যাঞ্জেলেসে ডেপুটি কনসাল জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দেয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ সময় তিনি একজন যুবক বয়সী পুরুষকে কাজের লোক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যান। পরে অবশ্য ওই যুবকের চাকরি চলে যায়। সেখানে কাজী আনারকলির সঙ্গে একজন নাইজিরীয় যুবকের সখ্যতা গড়ে ওঠে এবং বাংলাদেশী যুবকের চাকরি চলে যায়। তখন (২০১৭ সালে ) ওই যুবক স্টেট ডিপার্টমেন্টে গিয়ে নালিশ জানায় ও দাবি করে যে আমেরিকার ভিসার জন্য সে বিপুল পরিমাণ অর্থ আনারকলিকে দিয়েছে। তাকে সেখান থেকে সরিয়ে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় বাংলাদেশ দূতাবাসে উপরাষ্ট্রদূত হিসেবে পদায়ন করা হয়। আনারকলি সেখানে তার নাইজিরীয় বন্ধুকে নিয়ে যান এবং ২০১৭ থেকে দীর্ঘ পাঁচ বছর পর্যন্ত বিয়ে না করেই ওই নাইজিরীয় পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের অর্থে দূতাবাসের বাসভবনে লিভ টুগেদার করতে থাকেন।
অবশেষে গত জুলাইয়ে আনারকলি ও তার বন্ধু ইন্দোনেশীয় পুলিশের হাতে গ্রেফতার হলে মন্ত্রণালয় কাজী আনারকলিকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হয়।
আনারকলির আগেও বাংলাদেশের কূটনীতিকদের গৃহকর্মী নিযার্তনসহ বড় নারী কেলেঙ্কারিতে বেশি সুনামহানি হয়েছে। সর্বশেষ চলতি বছর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘অশ্লীল চ্যাটিং’ ও একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর কলকাতায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনের প্রথম সচিব (রাজনৈতিক) মোঃ সানিউল কাদেরকে প্রত্যাহার করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ২০১৮ সালের শুরুতে গুয়াহাটিতে বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে কর্মরত এক বাংলাদেশী কূটনীতিকের বিরুদ্ধেও অভিযোগ এলে তাকেও প্রত্যাহার করা হয়। ২০২০ সালে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক পরিচালকের বিরুদ্ধে জোরপূর্বক দৈহিক সম্পর্ক ও প্রতারণার অভিযোগ তোলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সাবেক শিক্ষার্থী। নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগে ২০১৪ সালে ইতালির বাণিজ্যিক শহর মিলানে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল পদে নিযুক্ত থাকা অবস্থায় মোঃ তাওহীদুল ইসলামকে দেশে ফিরতে হয়। তার বিরুদ্ধে মিশনেরই এক নারী সহকর্মী যৌন হয়রানির অভিযোগ এনেছিলেন। এ অভিযোগের তদন্ত কমিটিতে ছিলেন কাজী আনারকলি। এর আগের বছর অসদাচরণের জন্য সাবেক রাষ্ট্রদূত পর্যায়ের সিনিয়র কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরেও পাঠানো হয়েছে।
কিন্তু নিজ দূতাবাসের একজন মহিলা কর্মীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে টোকিও থেকে বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত এ কে এম মুজিবুর রহমানকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে। টোকিওর বাংলাদেশ মিশনের সাবেক সোশ্যাল সেক্রেটারি জাপানী তরুণী কিয়োকো তাকাহাসি তখন ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফ্যাক্স ও ইমেল বার্তায় রাষ্ট্রদূতের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আনেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেছেন, কাজী আনারকলি মাদকাসক্ত, রিহ্যাবে রেখে তাকে চিকিৎসা দেয়া প্রয়োজন। সাবেক রাষ্ট্রদূত ও পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালিউর রহমান বলেন, কূটনীতিকরা যেসব কেলেঙ্কারিতে জড়াচ্ছেন এটা উদ্বেগের বিষয়। কিন্তু তার থেকেও উদ্বেগের বিষয় বাংলাদেশী কূটনীতিককে তার বাসা থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া। এটা কঠোরভাবে ভিয়েনা কনভেনশনের লঙ্ঘন। বাংলাদেশী কূটনীতিকদের ক্ষেত্রে কেন বারবার এমন হচ্ছে তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। কোন আইনের লঙ্ঘন হলে বাংলাদেশকে জানাতে হবে, তা না করে কোন কূটনীতিককে অন্য দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বাসার বাইরে নিয়ে যাচ্ছে, এটা মেনে নেয়া যায় না।