ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আলোচনার শীর্ষে টিলাগড় ॥ দুই আসামি রিমান্ডে

প্রকাশিত: ২২:৫৩, ১ অক্টোবর ২০২০

আলোচনার শীর্ষে টিলাগড় ॥ দুই আসামি রিমান্ডে

স্টাফ রিপোর্টার, সিলেট অফিস ॥ সিলেট এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে স্বামীকে আটকে স্ত্রীকে গণধর্ষণ মামলার এজাহাভুক্ত আসামি তারেকুল ইসলাম তারেককে পাঁচ দিনের ও অপর আসামি মাহফুজুর রহমান মাসুমকে ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। ধর্ষণ ঘটনার প্রতিবাদে দোষীদের শাস্তির দাবিতে বিভিন্ন সংগঠন বুধবার মানববন্ধন কর্মসূচী পালন করেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক সামাজিক সংগঠন নিন্দা প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছে। গৃহবধূ ধর্ষণের ঘটনার পর নগরীর টিলাগড় এলাকা এখন আলোচনার শীর্ষে। নগরবাসীর কাছে সন্ত্রাসী কর্মকা-ের জন্য এই এলাকাটি সর্বাধিক পরিচিত। আলোচনায় সামনে চলে এসেছে বিগত ৩০/৩৫ বছর যাবত চলে আসা খুন হত্যা রাহাজানির ঘটনাপঞ্জি। সবার দৃষ্টি এখন গত শুক্রবারে ঘটে যাওয়া গৃহবধূ গণধর্ষণের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের দিকে। বুধবার বিকেলে মহানগরের শাহপরাণ থানা-পুলিশ তারেককে সিলেটের চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করলে পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে বিচারক আবুল কাশেমের আদালত। গত মঙ্গলবার তারেকুল ইসলাম তারেককে সুনামগঞ্জের দিরাই থেকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-৯। আদালত সূত্র জানায়, রিমান্ড শুনানিকালে আসামি তারেকের পক্ষেও কোন আইনজীবী শুনানিতে অংশ নেননি। তবে বাদীপক্ষে স্বপ্রণোদিত হয়ে শতাধিক আইনজীবী অংশ নেন। বুধবার দুপুরে শাহপরাণ থানা পুলিশ মাহফুজুর রহমান মাসুমকে সিলেট চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে রিমান্ডের আবেদন করলে আদালত ৫দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। চাঞ্চল্যকর এই ধর্ষণ মামলায় গ্রেফতার হওয়া এজাহারভুক্ত ছয় আসমির সকলকেই পাঁচদিন করে রিমান্ডে পেল পুলিশ। এছাড়া সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার হওয়া আরও দুজনকেও ৫ দিন করে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। আদালতে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে মাহফুজ। সে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকলেও এ ঘটনায় জড়িত নয় বলে আদালতে দাবি করেছেন। নিজেকে নির্দোষ দাবি করে মাহফুজ আদালতকে বলেছে ফোনে খবর পেয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে আমি ছাত্রাবাসে গিয়েছিলাম। তবে ধর্ষণের ঘটনার সঙ্গে আমি জড়িত নই। তদন্ত কমিটি ॥ প্রায় ১৪৪ একরের এমসি কলেজে আয়তন অনুযায়ী নিরাপত্তা ব্যবস্থা যথেষ্ট নেই। এছাড়াও অপ্রতুল সীমানা প্রাচীর, আলোর স্বল্পতার বিষয়টিও নিরাপত্তার ব্যাঘাত ঘটেছে। এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে ধর্ষণের ঘটনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) শহিদুল কবির চৌধুরী এমনটি বলেছেন। এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মঙ্গলবার তদন্ত কমিটির সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন। দুইদিন সিলেটে থেকে বিভিন্নজনের সঙ্গে আলাপের পর বুধবার রাতেই তারা ঢাকায় ফিরে গেছেন। বৃহস্পতিবার মন্ত্রণালয়ে প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করবে তদন্ত দল। সিলেট ছাড়ার আগে বুধবার সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে শহিদুল কবির চৌধুরী এসব কথা বলেন। করেনাকালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ছাত্রাবাস খোলা রাখার নির্দেশনা দেয়নি উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ছাত্রাবাস বন্ধ রাখার নির্দেশনা দিয়েছে। এই সময়ে ছাত্রাবাস খোলা রাখার সুযোগ নেই। এ বিষয়টি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হবে জানান তিনি। এছাড়াও হোস্টেলের কক্ষে অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়টিও তারা অবগত হয়েছেন বলেও জানান তিনি। শহিদুল কবির চৌধুরী আরও বলেন, তদন্ত কমিটি পুলিশ, কলেজ প্রশাসন, নির্যাতিতা নারী ও তার স্বামীর সঙ্গেও কথা বলেছেন। তারা মূলতঃ এ ঘটনায় প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের ভূমিকা ও অবস্থান বিষয়ে তদন্ত করছেন বলেও জানান তিনি। খুন রাহাজানি নিত্য নৈমিত্তিক বিষয় ॥ সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজ এলাকায় রাজনীতির নামে সন্ত্রাসী কর্মকা-কে ঘিরে খুন হত্যা রাহাজানি নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। টিলা সমতল নিয়ে মনোরম পরিবেশে টিলাগড়ের এই এলাকায় সাধারণ মানুষের উপস্থিতির সুযোগে ছিনতাই চাঁদাবাজির ঘটনাও ঘটছে অহরহ। ছাত্র রাজনীতির নামে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে অস্ত্রের মহড়া ও সংঘর্ষের ঘটনায় এলাকার জনজীবন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় মানুষ আতঙ্কে দিন যাপন করেন। সিলেট নগরীর একটি আতঙ্কগ্রস্ত এলাকার নাম টিলাগড়। সিলেট এমসি কলেজ, সরকারী কলেজ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের মতো বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবস্থান এই এলাকায়। এলাকাটি একটি শিক্ষা প্রসারের আদর্শ অঞ্চল হওয়ার কথা সেটি হয়ে ওঠেছে সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য। একের পর এক অপরাধ কর্মকা- ঘটে চলছে এই এলাকায়। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ বিরোধে বেশ কয়েকটি হত্যাকা-ও ঘটেছে এখানে। বিভিন্ন ঘটনার পর জড়িত কয়েকজন গ্রেফতার হলেও আড়ালেই থেকে যান এই অপরাধীদের প্রশ্রয়দাতারা। ছাত্রলীগের এই সন্ত্রাসীদের কারা মদদ দেন তাদের খোঁজে বের করার কোন উদ্যোগ নেয়া হয় না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা আওয়ামী লীগেরের পক্ষ থেকেও এ ব্যাপারে কোন উদ্যোগ নেই। ফলে দিন দিন আরও বেপেরোয়া হয়ে ওঠেছে অপরাধীরা। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় ছাত্রাবাসের ভেতরে ধর্ষণের খবর পেয়ে ছাত্রাবাসে হাজির হয়ে সরকারদলীয় কয়েকজন নেতা বিষয়টি সমঝোতার মাধ্যমে শেষ করার চেষ্টা চালান বলে অভিযোগ উঠেছে। সে রাতে নির্যাতিত দম্পতির সহায়তায় প্রথম এগিয়ে আসেন টিলাগড় এলাকার বাসিন্দা ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মিহিরগুহ চৌধুরী (বাবলা চৌধুরী)। সমঝোতার চেষ্টার বিষয়ে তিনি বলেন, ওই রাতে পুলিশ আসার আগেই মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক দেবাংশু দাশ মিঠু ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা জাহাঙ্গীর আলম ছাত্রাবাসে হাজির হন। তারা প্রথমে সমঝোতার চেষ্টা চালান। বাবলা চৌধুরী বলেন, পুলিশের আগেই তারা কিভাবে এ ঘটনার খবর পেলেন ? নিশ্চয়ই অপরাধীরা তাদের জানিয়েছে। অপরাধীরা তাদের অনুসারী না হলে তাদের জানাবে কেন? এ ব্যাপারে জাহাঙ্গীর আলম এমন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধের কারণে আমার দলেরই কিছু লোক আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করছে। ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্তদের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই দাবি করে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের কঠোর শাস্তি দাবি আমিও জানাচ্ছি। অভিযুক্তদের প্রশ্রয়দাতা হিসেবে আলোচনায় এসেছে ছাত্রলীগ নেতা নাজমুল ইসলামের নামও। নাজমুল জেলা ছাত্রলীগের বিগত কমিটির সদস্য। তিনি আগামী কমিটির সভাপতি প্রার্থী। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্র জানিয়েছে, অভিযুক্তরা আত্মগোপনে যাওয়ার পরও একাধিকবার নাজমুলের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে। তবে এমন অভিযোগ অস্বীকার করে নাজমুল হোসেন বলেন, অভিযুক্তদের আমি চিনি। তবে এমন ঘটনা যারাই ঘটাক আমি তাদের শাস্তি চাই। তাদের প্রশ্রয় দেয়ার প্রশ্নই আসে না। এমসি কলেজের ছাত্রাবাসের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের অপকর্মের স্থল ২০৫ নম্বর কক্ষ। এই কক্ষ হচ্ছে সব অপরাধের হেডকোয়ার্টার। সন্ধ্যা নামলেই এই কক্ষেই ছুটে আসতো বখাটে ছাত্রলীগ কর্মীরা। মাদক সেবনসহ অশ্লীল কর্মকা- হতো এই কক্ষে। সবই দেখত আশপাশের শিক্ষার্থীরা। কিন্তু কেউ কোন প্রতিবাদ করতে সাহস পেত না । এমনকি ফিরেও চাইত না এই কক্ষের দিকে। ওখানে যা হতো সব যেন বৈধ। সিলেট এমসি কলেজের শতবর্ষী ছাত্রাবাস। ৮ বছর আগে এই ছাত্রাবাসটি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। এরপর সরকারের তরফ থেকে এমসি’র এই ছাত্রাবাসকে আগের আদলেই পুনঃনির্মাণ করা হয়। এখনও নির্মাণাধীন ওই ভবন। তবে চার বছর আগে থেকেই এমসি কলেজ কর্তৃপক্ষ হলের দু’তলা এবং তিন তলায় ছাত্র তুলেছে। প্রতি তলায় বসবাস করেন ৩৬ জন ছাত্র। নিচে ডাইনিং। চতুর্থ তলাটি এখনও নির্মাণাধীন। ছাত্ররা বসবাস করলেও নবনির্মিত হলের বাইরে এখনও বিদ্যুতায়ন হয়নি। সন্ধ্যা নামলেই অন্ধকার হয়ে পড়ে এলাকা। হলের নিচ তলা থেকে দু’তলায় উঠলেই বাম পাশে পড়ে আলোচিত ২০৫ নম্বর কক্ষ। এই কক্ষই ছাত্রলীগের কর্মী শাহ মাহবুবুর রহমান রনির। তার নামেই এই হলটি বরাদ্দ। গত বছর সে এমসি কলেজ থেকে মাস্টার্স পাস করলেও হলের ওই রুম ছাড়েনি। এখনও রুমটি তার নামেই বরাদ্দ। জোরপূর্বক কক্ষটি দখল করে অপরাধ আস্তানায় পরিণত করেছে সে। তার ভয়ে তটস্থ থাকেন হলের অন্য ছাত্ররা। বছর দু’এক আগে ওই কক্ষে এক ছাত্রকে নিয়ে টর্চার করা হয়েছিল। এরপর থেকে রনির কক্ষটি সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে টর্চার সেল হিসাবে পরিচিত। হলে বসবাসকারী কয়েকজন ছাত্র জানিয়েছেন, মার্চ মাস থেকে হল বন্ধ। কিন্তু শাহ রনি তার কক্ষেই বসবাস করছিল। তার জন্য খোলা ছিল হলের ডাইনিংও। মার্চ থেকে হল সুপাররা থাকেন না। এ কারণে হলের নিয়ন্ত্রণ করে সে। কলেজ কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে কোন কথা বলে না। বরং তারা যেসব কর্মকা- করে সব যেনো বৈধ। ২০৫ নম্বরে সব সময় আড্ডা দিতো রনি, সাইফুর, রবিউলসহ সব ধর্ষণ মামলার আসামিরা। তারা ওই কক্ষে বসেই ইয়াবাসহ নানা ধরনের মাদক সেবন করত। আড্ডা চিৎকার হৈ চৈ যখন যা ইচ্ছা তাই চলত। সন্ধ্যার পর মাঝে মধ্যে তারা হলের বাইরে খোলা জায়গায় অবস্থান নিত। অন্ধকার এলাকার ফাঁকা স্থানে বসে তারা মাদক সেবন করত। পাশেই বালুচর, টিলাগড়। ওখান থেকে ছাত্রলীগের বখাটে কর্মীরা যেত। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি গঠন ॥ স্টাফ রিপোর্টার, গাজীপুর থেকে জানান, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সিলেটের ঐতিহ্যবাহী মুরারি চাঁদ (এমসি) কলেজের ছাত্রাবাসে সংগঠিত গণধর্ষণের ঘটনায় সরেজমিন পরিদর্শনপূর্বক দায়দায়িত্ব নিরূপণের জন্য বুধবার কমিটি গঠন করেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেট আঞ্চলিক কেন্দ্রের পরিচালক ড. মোঃ গোলাম রাব্বানীকে এক সদস্য বিশিষ্ট এ কমিটির সদস্য করা হয়েছে। কমিটিকে ৫ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদনের আলোকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
×