ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দুই নেতার ঐতিহাসিক বৈঠক

কোরিয়ায় শান্তির সুবাতাস, পরমাণু অস্ত্রমুক্ত ঘোষণা

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ২৮ এপ্রিল ২০১৮

কোরিয়ায় শান্তির সুবাতাস, পরমাণু অস্ত্রমুক্ত ঘোষণা

নাজিম মাহমুদ ॥ সাড়ে ছয় দশকের অহি-নকুল সম্পর্কের অবসান ঘটিয়ে কোরীয় উপদ্বীপকে পরমাণু অস্ত্রমুক্ত করতে সম্মত হয়েছে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া। শুক্রবার দুই কোরিয়ার অসামরিক এলাকা পানমুনজমে এক ঐতিহাসিক বৈঠকে বসেন উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন ও দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে ইন। ১৯৫৩ সালে কোরীয় যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর এই প্রথম উত্তর কোরিয়ার কোন শীষ নেতা সামরিক রেখা অতিক্রম করে দক্ষিণ কোরিয়ার মাটিতে পা রাখেন। শুক্রবার স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে নয়টায় কিম জং উন হেঁটে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রবেশ করলে দক্ষিণের প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে ইন তাকে স্বাগত জানান। প্রথম দেখাতেই উভয়ে করমর্দন করেন। হাত মেলানোর পর উত্তরের নেতা কিম আপ্লুত হয়ে পড়েন। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, আজ থেকে নতুন ইতিহাসের সূচনা হলো। দক্ষিণের বিরুদ্ধে সকল হুমকি-ধমকির পরিবর্তে কিমের মুখে শোনা যায় শান্তির বার্তা। তিনি বলেন, আজ থেকেই শান্তির যুগ শুরু হলো। খবর বিবিসি, এএফপি ও আলজাজিরা অনলাইনের। এই বৈঠকে স্বাগত জানিয়ে বিশ্ব নেতারা বিবৃতি দিয়েছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প উভয় কোরিয়ার মধ্যে এ বৈঠক অনুষ্ঠানের জন্য চীনকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, শুক্রবারের এই বৈঠক আয়োজনে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং অনেক সহায়তা করেছেন। আমার বন্ধু শি জিন পিংয়ের এই সহযোগিতা ভুলে যাওয়ার মতো নয় বলে উল্লেখ করেন ট্রাম্প। একই সঙ্গে রাশিয়া ও ন্যাটো এই বৈঠককে স্বাগত জানায়। এছাড়া চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জাপান ও ব্রিটেন এই ঐতিহাসিক বৈঠকে স্বাগত জানিয়ে বিবৃতি দেয়। শুক্রবার দুই দফা পানজুমজমের পিস হাউসে কিম জং উন ও মুন জায়ে ইনের মধ্যে বৈঠক হয়। এই বৈঠকের উভয় দেশ একটি ঘোষণা দেয় যাকে পানজুমজম ঘোষণা বলা হচ্ছে। বৈঠকের পর এক বক্তৃতায় উত্তর কোরিয়ার নেতা বলেন, এ অঞ্চলের ‘দুর্ভাগ্যজনক ইতিহাসের’ পুনরাবৃত্তি যেন না হয়, সেজন্য দুই দেশের নেতাদের ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, এর মধ্যে অনেক প্রতিবন্ধকতা ও হতাশা থাকতে পারে। কিন্তু যন্ত্রণা ছাড়া বিজয় অর্জন করা যায় না। পানমুনজম ঘোষণায় দুই কোরিয়ার মধ্যকার ‘সহিংস কর্মকাণ্ড’ বন্ধ করা, আঞ্চলিক সামরিক উত্তেজনা কমাতে অস্ত্রের মজুদ কমিয়ে আনা, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে সঙ্গে নিয়ে ত্রিপক্ষীয় আলোচনা চালানো, কোরীয় যুদ্ধের কারণে বিভক্ত পরিবারগুলোর সদস্যদের পুনর্মিলনীর আয়োজন করা ও সীমান্তসংলগ্ন এলাকাকে ‘পিস জোন’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা হয়। বৈঠকের পর একই দিন বিকেলে দেশে ফিরে যান কিম জং উন। এর আগে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে-ইনকে উত্তর কোরিয়ায় সফরের আমন্ত্রণ জানান কিম। এ সময় দুই নেতা সীমান্তে বৃক্ষরোপণ করেন। মোট নয় সদস্যের প্রতিনিধিদল নিয়ে যান কিম। এই দলের সদস্য ছিলেন তার বোন কিম ইয়ো-জংও ছিলেন। ঐতিহাসিক এই বৈঠকে উত্তরের পারমাণবিক কর্মসূচী, পিয়ংইয়ং ও সিউলের সম্পর্কোন্নয়ন, অর্থনৈতিক সহযোগিতা ছাড়াও সম্ভাব্য শান্তি চুক্তি নিয়ে আলোচনা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছিল। দুই কোরিয়ার এই শীর্ষ সম্মেলনের আগে গত শনিবার এক ঘোষণায় কিম ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও পারমাণবিক পরীক্ষা কেন্দ্রের কাজ সাময়িক বন্ধের ঘোষণা দেন। মুন ও কিমের এই বৈঠকে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য শীর্ষ সম্মেলন নিয়েও আলোচনা হতে পারে বলে আভাস মিলেছে। মে মাসের শেষে বা জুনের শুরুতে ওই বৈঠকে কিম ও ট্রা¤েপর মুখোমুখি সাক্ষাতের সম্ভাবনা আছে। পিয়ংইয়ংয়ে ২০০০ ও ২০০৭ সালে দুই কোরিয়ার নেতৃবৃন্দের মধ্যে দুই দফা শীর্ষ বৈঠক হয়েছিল। যদিও সেসব বৈঠক আন্তঃকোরিয়া স¤পর্ক উন্নয়নে তেমন ফল বয়ে আনতে পারেনি। কিম জং উন উত্তরের শীর্ষ নেতা হওয়ার পর একের পর এক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ ও পারমাণবিক পরীক্ষা চালিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের উদ্বেগ বাড়ানো উত্তর কোরিয়ার ওপর জাতিসংঘসহ পশ্চিমা বিভিন্ন দেশের কড়া অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দক্ষিণ কোরিয়ার পিয়ংচ্যাংয়ে হওয়া শীতকালীন অলি¤িপকে উত্তরের প্রতিনিধিদলের অংশগ্রহণের পর থেকে দুই কোরিয়ার স¤পর্কে উন্নতির আভাস পাওয়া যায়। এরপর সিউলের প্রতিনিধিরা পিয়ংইয়ং গেলে দুই কোরিয়ার মধ্যে শীর্ষ সম্মেলনের প্রস্তুতি শুরু হয়। ওই প্রতিনিধি দলই পরে ওয়াশিংটনে গিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে কিমের আমন্ত্রণ পৌঁছে দেন। সবাইকে চমকে দিয়ে ট্রা¤প ওই আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিতে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন। ওই ধারাবাহিকতাতেই গত মাসের শেষদিকে সিআইএ পরিচালক মাইক পম্পেও উত্তর কোরিয়ায় গোপন সফর করে কিমের সঙ্গে দেখা করেন। ট্রাম্প-কিম সম্ভাব্য বৈঠক কোথায় হবে, সেখানে কি নিয়ে আলোচনা হবে তা নিয়ে এখনও নিশ্চিত কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। চোখে চশমা, মাও জে দঙ ঘরানার স্যুট পরা কিম ডিমিলিটারাইজ জোনে পৌঁছানোর পর দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানায় দক্ষিণ কোরিয়ার এক শিশু। ঐতিহ্যবাহী অনার গার্ডের সদস্যরা এরপর কিম ও মুনকে লাল গালিচায় নিয়ে আসেন। আলোচনা শুরুর আগে কিম পিস হাউসের গেস্ট বুকে শুভেচ্ছা বার্তা লেখেন।
×