বিশেষ প্রতিনিধি ॥ পূজার ঢাকে পড়ল কাঠি। দিকে দিকে এখন দেবীর বন্দনা। দেবী দুর্গার আগমনে চারদিকে চলছে আনন্দ আয়োজন। মণ্ডপে মণ্ডপে এখন আনন্দময়ীর আগমনী স্তুতি। থিমের অভিনবত্ব থেকে রকমারি আলোর সাজ- গোটা দেশ এখন বারোয়ারি শারদোৎসবে মতোয়ারা। তবে নিয়ম নিষ্ঠার ফাঁকি নেই এতটুকু। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনের অগ্রভাগে মঙ্গলবার ষষ্ঠীপূজা এবং সায়ংকালে দেবীর আমন্ত্রণ ও অধিবাস বেশ ভালই কেটেছে। ঘটপূজা শেষে আজ বুধবার মহাসপ্তমীতে শুরু হবে মূর্তিপূজা। চক্ষুদান করা হবে দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গার। খুলে যাবে দশপ্রহরণধারিনী ত্রিনয়নী দেবী দুর্গার অতল স্নিগ্ধ চোখের পলক। আর এই ষষ্ঠীপূজার মধ্য দিয়ে মঙ্গলবার থেকে সূচিত হয়েছে পাঁচ দিনব্যাপী বাঙালীর শারদোৎসব, দুর্গাপূজা। খগড়-কৃপাণ, চক্র-গদা, তীর-ধনুক আর ত্রিশূল হস্তে শক্তিরূপেন দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গা মহিষাসুর বধে ম-পে ম-পে ঠাঁই নিয়েছেন। ঢাকের বাদ্য, শঙ্খ আর উলুধ্বনি, আর ভক্তকুলের আবাহনের মন্ত্রোচ্চারণে দেবী দুর্গার স্বর্গ থেকে মর্ত্যে আগমন ঘটেছে। পূজার মন্ত্রোচ্চারণ, মন্দিরে মন্দিরে ধূপ-ধুনোয় ভক্তদের নৃত্য আরতি, আর ঢাক-ঢোল, কাঁসর-মন্দিরার পাশাপাশি মাইকের আওয়াজে এখন মাতোয়ারা সারাদেশের পূজামণ্ডপগুলো। আনন্দময়ীর আগমনী সুরে অনুরণিত এখন চারদিক। ভক্তদের পূজা গ্রহণের জন্য দুর্গা দেবীর মর্ত্যে আগমনের পর মঙ্গলবার ষষ্ঠীতিথিতে মণ্ডপে মণ্ডপে দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গার অধিষ্ঠান হয়। সকাল ৮টা ২৩ মিনিটের মধ্যে ছিল ষষ্ঠাদি কল্পারম্ভ। এ সময় বেলতলা কিংবা বেলগাছের নিচে দেয়া হয় ষষ্ঠীপূজা। দক্ষিণায়নের নিদ্রিত দেবী দুর্গার নিদ্রা ভাঙ্গার জন্য করা হয় বন্দনা পূজা। বিকেলে দেবীর আমন্ত্রণ ও অধিবাস ছাড়াও সব ম-পে পুষ্পাঞ্জলি, প্রসাদ বিতরণ ও ভোগ আরতির আয়োজন করা হয়। সন্ধ্যায় মন্দিরে মন্দিরে প্রার্থনা ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
শারদোৎসবের দ্বিতীয় দিনে আজ বুধবার মহাসপ্তমী। সকালে ত্রিণয়ণী দেবী দুর্গার চক্ষুদান করা হবে। এরপর সকালে বেল, ধান, কলা, মান, জয়ন্তীসহ নয়টি উদ্ভিদের সমন্বয়ে দেবী দুর্গার নয়টি রূপ একত্রে করে নবপত্রিকা প্রবেশ, স্থাপন, সপ্তমাদি কল্পারম্ভ ও সপ্তমীবিহিত পূজা অনুষ্ঠিত হবে। পূজা শেষে অঞ্জলি প্রদান, প্রসাদ বিতরণ ও ভোগ আরতির আয়োজন থাকবে। রাতে হবে আরতি। এভাবে উৎসব চলবে আগামী মঙ্গলবার প্রতিমা বিসর্জন পর্যন্ত। এভাবে কড়া নিরাপত্তায় দেবীর আগমনে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত পর্বের চাঞ্চল্য ও মুখরতার আবহে সারাদেশে শুরু হয়েছে দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা। নানা আলোকচ্ছটায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে পূজা ম-পগুলো। প্রতিটি মন্দির-মণ্ডপ সেজেছে আপন সৌন্দর্যে। থিমের অভিনবত্ব আর রকমারি আলোকসজ্জায় সাজে সাজানো হয়েছে একেকটি পূজামণ্ডপ। হিন্দুদের পাশাপাশি সব ধর্মের মানুষের যোগ দেয়ায় দুর্গোৎসব রূপ নিয়েছে সার্বজনীনতায়। সারাদেশের মন্দির ও পূজামণ্ডপে ঢাকের বাদ্য, শঙ্খ, উলুধ্বনীর শব্দে দেবী দুর্গার মত্যে আগমনের জানান দিচ্ছে। পূজার মন্ত্রোচ্চারণ, আরতি আর মাইকের আওয়াজে এখন মাতোয়ারা গোটা দেশের পূজাম-পগুলো।
ধর্ম ও সংস্কৃতি ভিন্ন হলেও তা যে সার্বজনীন তা শারদীয় দুর্গাপূজা এলে সহজে বুঝা যায়। শুধু শহর নয়, প্রত্যন্ত গ্রামেও শারদীয় দুর্গাপূজায় আনন্দের অন্ত নেই। সেখানকার মাইকে মাইকে ভেসে উঠে কীর্তন কিংবা পুরনো দিনের গানের সুর। ‘আজি শঙ্খে মঙ্গলগাঁও জননী এসেছে দ্বারে’ কিংবা ‘জাগো দুর্গা, জাগো দশভুজা জগৎ জননী মা’- এ আহ্বান যেন আকাশে-বাতাসে। জ্ঞান-কর্ম ও নিদ্রার তিন গুণের আঁধারে দেবী মহামায়াকে বন্দনা করতে ভক্তপ্রাণে যেন আকুতির শেষ নেই। গ্রামের কোথাও পূজা উপলক্ষে চলছে রামায়ণ, অষ্টক, কবি ও যাত্রাগান। বিচিত্র পসরা সাজিয়ে বসেছে মেলা। নাড়ু, মুড়কি, খৈ-বাতাসা, কদমাসহ নানা জাতের মিষ্টির সমারোহ প্রতিটি বাড়িতে বাড়িতে। যার যতটুকু সাধ্য উৎসবের আনন্দ তার ততখানিই।
মঙ্গলবার পূজামণ্ডপগুলো ঘুরে দেখা গেছে প্রায় একই দৃশ্য। পূজার সব প্রস্তুতি শেষ হয়েছে গত সকালেই। শেষ তুলির ছোঁয়াও শেষ হয়েছে প্রায় প্রতিটি মণ্ডপে। শিল্পীর নিপুণ তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে দুর্গাদেবীসহ প্রতিমাগুলোকে। প্রতিটি ম-প সাজানো হয়েছে মনলোভা সাজে। অনেক মণ্ডপে দেবী দুর্গার আগমন ঘটনাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নিপুণ দক্ষতায়। বর্ণিল সাজ ও আলোকসজ্জায় সেজেছে পূজামণ্ডপ ও আশপাশের এলাকা। ছোটবড় প্যান্ডেল, মঞ্চ, রং বেরঙের ব্যানার-ফেস্টুন দিয়েও সাজানো হয়েছে মণ্ডপগুলো। মণ্ডপগুলোর প্রবেশদ্বারে নির্মাণ করা হয়েছে ছোটবড় রং বেরঙের তোরণ।
আনন্দমুখর পরিবেশের পাশাপাশি নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রতিটি মণ্ডপে পুলিশ ও আনসারের পাশাপাশি কোথাও কোথাও নিযুক্ত করা হয়েছে র্যাব সদস্যদেরও। সাদা পোশাকে গোয়েন্দা সদস্যদের ছিল সতর্ক প্রহরা। অনেক মণ্ডপে বসানো হয়েছে আর্চওয়ে ও মেটাল ডিটেক্টর। তবে এতসব কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ছেদ ফেলেনি পূজার উৎসবমুখরতায়। নিরাপত্তা বাহিনীর উর্ধতন কর্মকর্তারা ঢাকেশ্বরী মন্দিরসহ বড় বড় পূজামণ্ডপগুলো পরিদর্শন করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছেন।
পূজা শুরু হলেও মঙ্গলবার রাজধানীর পূজামণ্ডপগুলোতে ভক্ত আর দর্শনার্থীদের ভিড় তেমন একট লক্ষ্য করা যায়নি। আয়োজকরা জানান, আজ মহাসপ্তমী থেকে দর্শনার্থীদের ভিড় বাড়তে থাকবে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার মহাষ্টমী থেকেই জমে উঠবে উৎসব।
তবে দৃষ্টিনন্দন ও আকর্ষণীয় সাজে এবার সজ্জিত করা হয়েছে গুলশান-বনানী সার্বজনীন পূজা উদযাপন পরিষদের আয়োজনে বনানী মাঠের পূজামণ্ডপ। মণ্ডপসহ পুরো প্রাঙ্গণ সাজানো হয়েছে বাহারি সাজে। আকর্ষণীয় প্রতিমার পাশাপাশি মণ্ডপসহ সংলগ্ন এলাকা বর্ণাঢ্য সাজে ও আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়েছে। এই পূজামণ্ডপে পূজার পাঁচদিনই বিশেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন ও কলাবাগান সার্বজনীন পূজামণ্ডপ সাজানো হয়েছে বর্ণিল ও আধুনিক নির্মাণশৈলী দিয়ে।