ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

দেশের ৯০ ভাগ উন্নয়ন হয় এখন নিজস্ব অর্থে ;###;বর্তমান সরকার ব্যবসাবান্ধব

স্বনির্ভর দেশ গড়তে জনগণকে ট্যাক্স দিতে বললেন প্রধানমন্ত্রী ॥ হাত পাতব না

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ৩১ জানুয়ারি ২০১৬

স্বনির্ভর দেশ গড়তে জনগণকে ট্যাক্স দিতে বললেন প্রধানমন্ত্রী ॥ হাত পাতব না

মোয়াজ্জেমুল হক/হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশের উন্নয়নের ৯০ শতাংশ কাজ এখন নিজেদের অর্থে হচ্ছে। আমরা উন্নয়ন করব। কিন্তু কারও কাছে হাত পাততে পারব না। তাই দেশের উন্নয়ন কার্যক্রম চালিয়ে নিতে তিনি ব্যবসায়ীদের সময়মতো ট্যাক্স প্রদানের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার ব্যবসা ও বাণিজ্যবান্ধব সরকার। তবে আমরা ব্যবসা করি না। ব্যবসা আপনারাই করবেন, আমরা পরিবেশ সৃষ্টি করে দেব। তিনি ব্যবসায়ীদের প্রতি উৎপাদন বহুমুখীকরণ ও বহির্বিশ্বে নতুন নতুন বাজার অনুসন্ধানের জন্য আহ্বান জানান। শনিবার বিকেলে নগরীর আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির নিজস্ব অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত দেশের প্রথম ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, আমরা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করছি। এ সেতু নির্মাণকে আমরা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। এ নির্মাণ কাজ বহির্বিশ্বে দেশের মর্যাদাকে সম্মুন্নত করেছে। রাজস্ব হিসেবে প্রাপ্ত অর্থ দেশের উন্নয়ন কাজে ব্যয় হচ্ছে। বর্তমান সরকারের একমাত্র লক্ষ্য দেশের উন্নয়ন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের উদ্বোধন চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের জন্য একটি গর্বের বিষয়। বিশ্বের বহু বড় বড় শহরের ন্যায় চট্টগ্রামেও ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার প্রতিষ্ঠা হলো। বাংলাদেশ উন্নত দেশের কাতারে শামিল হওয়ার ক্ষেত্রে আরও একধাপ এগিয়ে গেল। তিনি বলেন, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার যে কোন দেশের জন্য অর্থনীতির সমৃদ্ধির প্রতীক। এই সেন্টারে দেশের সকল রফতানি পণ্য একই ছাদের নিচে প্রদর্শনের যে ব্যবস্থা রয়েছে তা একথায় অসাধারণ। বিদেশীরা এখানে এসে আমাদের পণ্যের গুণগত মান সম্পর্কে জানতে পারবে, যা দেশের রফতানি বৃদ্ধি করবে। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম ব্যবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রে শত শত বছরের ঐতিহ্যের অধিকারী। আরব, চীন, পর্তুগীজ স্প্যানিশ ও ব্রিটিশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বণিকরা চট্টগ্রামে এসে বাণিজ্য করেছেন। এর ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জন্য আমাদের বাণিজ্য সম্পর্ক বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত চিটাগং চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি এই শহরের বাণিজ্যিক ঐতিহ্যের বাণিজ্যিক অংশীদার। তিনি বলেন, ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে চট্টগ্রামের গুরুত্ব অপরিসীম। পৃথবীর অত্যন্ত সম্ভাবনাময় দুটি অর্থনৈতিক জোট সার্ক এবং আশিয়ানের সংযোগস্থল এই চট্টগ্রাম। তাই আঞ্চলিক যোগাযোগ উন্নয়নের ক্ষেত্রে এবং অর্থনেতিক কর্মকা- সম্প্রসারণে এই শহরের গুরুত্ব অত্যধিক। প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত সাত বছরে এ সরকার চট্টগ্রামে নতুন নতুন সড়ক ও ফ্লাইওভার নির্মাণসহ এই নগরীর যোগাযোগ ও অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়ন করেছে। ঢাকা-চট্টগ্রামের হাইওয়ের চারলেনের কাজ শেষ হয়েছে। এই হাইওয়েকে ৮ লেনে উন্নীত করার কাজও শুরু করা হবে। বর্তমান সরকারের উদ্যোগে কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ করা হচ্ছে। যাতে কর্ণফুলীর দুই পাড়ে সাংহাইয়ের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ হিসেবে গড়ে তোলা যায়। চট্টগ্রাম বন্দর প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ বন্দর এ বছর ২০ লাখ টিইউইএস কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে। বর্তমান সরকার বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ৬ কি.মি. বে-টার্মিালের কাজ শুরু করতে যাচ্ছে। চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে এ সরকার মহেশখালিতে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এছাড়া ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে গ্যাস আনা যায় কিনা তা নিয়েও আলোচনা করা হবে। মহেশখালি থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত মূল পাইপ লাইন বসানোর দরপত্রের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এছাড়াও মহেশখালিতে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে। বন্দর সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের মাধ্যমে শিল্পায়নের লক্ষ্যে সরকার মীরসরাইয়ে একটি এবং আনোয়ারায় দুটি স্পেশাল ইকোনমিক জোন স্থাপনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, শুধু চট্টগ্রাম নয়, এ সরকার গত সাত বছরে দেশব্যাপী যে উন্নয়ন করেছে তা ইতোপূর্বে কোন সরকার করতে পারেনি। তিনি বলেন, উন্নয়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আমরা যে উন্নয়ন শুরু করেছিলাম পরবর্তী বিএনপি-জামায়াত সরকার সে ধারাবাহিকতা বজায় রাখেনি। বাংলাদেশ আজ তলাবিহীন ঝুড়ি নয়। আমরা আমাদের ভাগ্য নিজেরাই পরিবর্তন করছি। বর্তমানে এদেশ থেকে ৭২৯টি পণ্য বিশ্বের ১৯২টি দেশে রফতানি হচ্ছে। রফতানি আয় বৃদ্ধি পেয়ে ৩২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। আর রিজার্ভ পৌঁছেছে ২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের উপরে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, যোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি বিভেদমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে এ সরকার অঙ্গীকারাবদ্ধ। আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। বিদেশে চাল রফতানি করছি। আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩১৪ মার্কিন ডলারে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। দারিদ্রের হার কমেছে। সরকার ১২৩ ভাগ পর্যন্ত বেতন বৃদ্ধি করেছে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম। স্বাগত বক্তব্য রাখেন সাবেক সভাপতি ও শতবর্ষ উদযাপন পরিষদের চেয়ারম্যান এমএ লতিফ এমপি। বক্তব্য রাখেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন-পূর্তমন্ত্রী, ভূমিপ্রতিমন্ত্রী, চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যগণ, সিটি মেয়র, এফবিসিসিআই সভাপতি, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ এবং বিভিন্ন ট্রেডবডির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সরকারী- বেসরকারী কর্মকর্তাবৃন্দ। উল্লেখ্য, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে বিভিন্ন তলায় রয়েছে এক্সিভিশন হল, সুইমিং পুল, ট্রেড ইনস্টিটিউট, আইটি জোন, পাঁচ তারকা হোটেল, কনভেনশন হল, কনফারেন্স সেন্টার, টেম্পোরারি এ্যান্ড পারমান্যান্ট এক্সিভিশন হল, ৪শ’ গাড়ির ধারণক্ষমতাসম্পন্ন তিনটি বেজমেন্ট কার পার্কিং, ব্যাংক, শপ, ফুডকোর্ট, হেলিপ্যাডসহ বিশ্বমানের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা। ২৯৮ ফুট উচ্চতার এ ভবনটি চট্টগ্রামের সর্বোচ্চ ভবন। এ ভবনটি নির্মাণ করতে নিউইয়র্কভিত্তিক ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার্স এ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হতে হয়েছে বাংলাদেশকে। বর্তমানে বিশ্বের ৯১টি দেশে ৩৩০টি ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার একটি নেটওয়ার্কে যুক্ত। আওয়ামী লীগ মানেই উন্নয়ন ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ মানেই উন্নয়ন। এ দল সরকারে এলে দেশ ও জাতির উন্নয়ন হয়। আর বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকলে কোন উন্নয়ন হয় না। বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এলে লুটপাট আর দুর্নীতি মানিলন্ডারিং হয়। তারা এতিমদের টাকা মেরে খায়। শনিবার চট্টগ্রামে নব প্রতিষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু এভিন্যু’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। শেখ হাসিনা বলেন, তার দল ক্ষমতায় গেলে জনগণ কিছু পায়। বাংলাদেশ একমাত্র দেশ যেখানে শতভাগ বেতন বাড়ানো হয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যে আমরা এদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করব। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ প্রতিষ্ঠা করব। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ অর্থনৈতিক মুক্তি এনে দেবে জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করা হবে। ৫ হাজার কোটি টাকার ৬ প্রকল্পের উদ্বোধন ॥ শনিবার সকালে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে সেনাবাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কুচকাওয়াজ ও পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে যোগদান শেষে প্রধানমন্ত্রী দিনব্যাপী ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করেন। সেনাবাহিনীর অনুষ্ঠান শেষে তিনি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার ৬টি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। চউক গৃহীত প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার টাইগার পাস থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ১ হাজার ৭শ’ কোটি টাকার পতেঙ্গা থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত চিটাগাং সিটি আউটার রিং রোড প্রকল্প, ১৭২ কোটি টাকার বায়েজিদ থেকে ফৌজদার হাট পর্যন্ত লুপ রোডের নির্মাণ কাজ, ৪৫ কোটি টাকায় বাস্তবায়িত বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউ, ৫৮ কোটি টাকায় নির্মিত কদমতলী ওভারপাস এবং ১ কোটি ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে কুয়াইশ এলাকায় নির্মিত দেশের সবচেয়ে উঁচু বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল। এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, পূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন, চউক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম, সাবেক মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগ সভাপতি আলহাজ এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী প্রমুখ। এসব অনুষ্ঠানের উদ্বোধন শেষে তিনি নগরীর আগ্রাবাদে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাওয়ার সময় সড়কের দু’পাশে হাজার হাজার জনতা তাঁকে সংবর্ধনা প্রদান করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী হাত নেড়ে সংবর্ধনার জবাব দেন। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের উদ্বোধন ঘোষণা করে বক্তব্য প্রদান শেষে প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রাম ছেড়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়ে যান।
×