ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১

খুতবায় জঙ্গীবাদে উস্কানি দিলে ইমামের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা

জঙ্গী ঠেকাতে নজরদারি বাড়ছে মসজিদ ও মাদ্রাসায়

প্রকাশিত: ০৪:৫৫, ৬ ডিসেম্বর ২০১৫

 জঙ্গী ঠেকাতে নজরদারি বাড়ছে মসজিদ ও মাদ্রাসায়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দেশে জঙ্গীবাদের বিস্তার ঠেকাতে নতুন করে কাজ শুরু করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন গঠিত জঙ্গীবাদ প্রতিরোধ ও প্রতিকার বিষয়ক বিশেষ সেলটি। তারই ধারাবাহিকতায় সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি মনিটরিংয়ের আওতায় আনা হয়েছে দেশের তালিকাভুক্ত মসজিদ, মাদ্রাসা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। যেসব ইমাম শুক্রবার খুতবার আগে জঙ্গীবাদ বিষয়ক উস্কানিমূলক বক্তব্য দেবেন, তাদের বিরুদ্ধে আইন মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে। এজন্য মসজিদগুলোতে প্রতি শুক্রবার একজন করে গোয়েন্দা মনিটরিং করছেন। শুধু মসজিদ নয়, প্রতিটি সেক্টরেই চলছে এমন নজরদারি। জঙ্গীবাদের বিস্তার রোধে গৃহীত পদক্ষেপের অংশ হিসেবে শনিবার পুলিশ সদর দফতরে ‘জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে ইসলামের ভূমিকা : বাংলাদেশ প্রেক্ষিত’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় ওলামা-মাশায়েখদের আলোচনায় ইসলামের দৃষ্টিতে জঙ্গীবাদ, ওলামা ও মাশায়েখদের করণীয়, পুলিশের সঙ্গে ওলামা ও মাশায়েখদের সমন্বয় বিষয়ক বিস্তারিত আলোচনা ও করণীয় বিষয়ক বিস্তারিত আলোচনা হয়। সভায় পুলিশ মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক, অতিরিক্ত আইজিপি মোঃ মঈন রহমান চৌধুরী, অতিরিক্ত আইজিপি মোঃ আবুল কাশেম, আলেম ওলামা ও ইসলামী চিন্তাবিদদের মধ্যে মাওলানা শাহ সূফি সৈয়দ মুহাম্মদ বাহাদুর শাহ মোজাদ্দেদী, ড. আলহাজ মাওলানা আ ন ম মাহবুবুর রহমান, ড. আল্লামা আবদুল্লাহ আল মারুফ, মাওলানা কফিল উদ্দিন সরকার সালেহী, ড. এএসএম বোরহান উদ্দিন, আলহাজ মাওলানা এসএম ফরিদ উদ্দিন, আলহাজ মাওলানা মোশারফ হোসাইন হেলালীসহ বহু আলেম ওলামা ও পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সভা শেষে পুলিশ মহাপরিদর্শক একেএম শহীদূল হক বলেন, প্রতি শুক্রবার পবিত্র জুমার নামাজের সময় রাজধানীসহ শহরের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি মসজিদে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) একজন করে সদস্য মোতায়েনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ইমামরা তাদের বক্তব্য ও খুতবায় জঙ্গীবাদের বিষয় নিয়ে কোন উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন কি-না সে বিষয়টি মনিটরিং করতেই এমন ব্যবস্থা। যেসব ইমাম জঙ্গীবাদের বিষয়ে উস্কানিমূলক বক্তব্য দেবেন, তাদের বিষয়ে আইন মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। তরুণ যুবকদের শান্তির ধর্ম ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে জঙ্গীবাদের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এর সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। কওমি ও আলিয়া মাদ্রাসার সরকারী সনদ দেয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সরকারকে বিষয়টি জানানো হবে। পিস টিভি বন্ধের যৌক্তিক কারণ থাকলে অবশ্যই তথ্য মন্ত্রণালয় সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। পুলিশপ্রধান বলেন, বোমা মারা, গুলি করা, মুসলমান হয়ে মুসলমানকে হত্যা করা ইসলাম ধর্মের মূল চেতনার পরিপন্থী। ইসলাম ধর্মে এগুলো জঘন্য অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত। ভিন্নধর্মাবলম্বী বিদেশী শক্তির অর্থ, অস্ত্র এবং উত্থানে বিভ্রান্ত হয়ে বিপথগামী কিছু তরুণ ইসলাম ধর্মের নাম জড়িয়ে সন্ত্রাস ও অশান্তি সৃষ্টি করছে, যা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ। এ দেশের আলেমসমাজকে ইসলামের শান্তির বাণী তুলে ধরে এদের মুখোশ খুলে দিতে হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কঠোর পদক্ষেপে এবং সাধারণ জনগণের অংশীদারিত্বে এদের এখনই প্রতিহত করতে হবে। অনেকে পবিত্র কোরান ও ইসলাম ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে জঙ্গীবাদ সৃষ্টির চেষ্টা করছে। এমন কর্মকা- ইসলাম ও দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। ইসলামের প্রকৃত বার্তা মানুষের কাছে তুলে ধরে জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে হবে। ২১ জঙ্গীর ফাঁসি কার্যকরের বিষয়ে তিনি বলেন, মামলাগুলো আপীল বিভাগে রয়েছে। বিচার বিভাগ স্বাধীন। আদালতের অনুমতি অনুযায়ী আইন মোতাবেক সঠিক সময়ে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে। অনুষ্ঠানে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বোর্ড অব গবর্নর গোলাম মাওলা নকশাবন্দী বলেন, যারা জঙ্গীবাদে যুক্ত তারা গোপনে বোমা মেরে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করছে। মসজিদের ইমামদের খুতবা রেকর্ড করা ও ইমামদের নামের তালিকা করা দরকার। আহলে সুন্নত আল জামাতের সভাপতি সৈয়দ বাহাদুর শাহ মোজাদ্দেদী বলেন, ইহুদী ও মার্কিনীদের সঙ্গে আইএসের সম্পর্ক রয়েছে। এদের মাধ্যমেই তারা বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ করতে চায়। কওমি ও আলিয়া মাদ্রাসার মাধ্যমে দেশে জঙ্গীবাদের উত্থান হচ্ছে। এদের বিষয়ে সঠিক তদারকি প্রয়োজন। মাওলানা কামাল উদ্দিন আজহারী বলেন, একজন মুসলমান হয়ে অন্য মুসলমানকে হত্যা করা কুফরি। মুফতি হালিম সিরাজী বলেন, যারা বিদেশীদের হত্যা করেছে তারা কোরান-হাদিস থেকে অনেক দূরের বাসিন্দা। অধ্যক্ষ মাওলানা কফিল উদ্দিন সরকার ছালেহী বলেন, ইসলাম অন্য কোন ধর্মাবলম্বীর প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশ করে না বরং তাদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখায়। আলহাজ মাওলানা এসএম ফরিদ উদ্দিন জানান, পবিত্র কোরানে মহান আল্লাহ বলেছেন, পৃথিবীতে তোমরা সন্ত্রাস করো না। মানুষকে ভালবেসে, ভালবাসা দিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখানে জঙ্গীবাদের কোন স্থান নেই। ড. আলহাজ মাওলানা আ ন ম মাহবুবুর রহমান বলেন, কিছু লোক বিদেশী টাকায় ইসলাম সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর প্রচারণা চালাচ্ছে। মিলাদ মাহফিলকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। কোরান-হাসিদের আলোকে জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে হবে। জিহাদ ও জঙ্গীবাদের মধ্যে যে পার্থক্য আছে তা তুলে ধরতে হবে। মাওলানা শাহ সূফি সৈয়দ মুহাম্মদ বাহাদুর শাহ বলেন, ইসলাম শান্তি, সহমর্মিতা ও সৌহার্দ্যরে ধর্ম। একটি মহল বিভ্রান্তি ছড়িয়ে জঙ্গীবাদ সৃষ্টি করছে। তারাই ইসলামের শত্রু। যারা পল্টনে বলেছেন, বাংলা হবে আফগান আমরা হব তালেবান’- তারাই জঙ্গী। মাওলানা খাজা আরিফুর রহমান বলেন, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা জঙ্গী ও খারেজীদের চরিত্র। ওলামা-মাশায়েখদের যুক্ত না করে জঙ্গীবাদ দমন করা কঠিন হবে। মসজিদে জুমার খুতবায় জঙ্গীবিরোধী বার্তা দিতে হবে। পুলিশের বিশেষ শাখার প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী বলেন, ওলামা-মাশায়েখরা বিভ্রান্তির হাত থেকে ফেরাতে মানুষকে সহায়তা করতে পারেন। আজকের সভার সুপারিশগুলো জঙ্গীবাদ নির্মূলের কৌশল হিসেবে প্রয়োগ করা হবে। ডিএমপি কমিশনার মোঃ আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, জঙ্গীবাদ দমনে পুলিশ কঠোর অবস্থানে রয়েছে। জঙ্গী কার্যক্রম প্রতিহত করার জন্য আমরা জোর তৎপরতা অব্যাহত রেখেছি। যারা ইসলামের নামে ইহুদী-নাসারাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চায় তাদের প্রতিহত করতে হবে। প্রসঙ্গত, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা লাভের পর ২০০৯ সালের প্রথম দিকেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন জঙ্গীবাদ প্রতিরোধ ও প্রতিকার বিষয়ক একটি বিশেষ সেল গঠন করে। শিক্ষা, স্থানীয় সরকার, ধর্ম ও তথ্যসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ছাড়াও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের মহাপরিচালক, অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর, পুলিশ, র‌্যাবসহ সকল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রধানদের সেলের সদস্য করা হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে ঢাকা, ঢাকার বাইরের জেলা, উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ের মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে জঙ্গীবাদবিরোধী প্রচারণা চালানো হয় কি-না তা মনিটরিং করে যাচ্ছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র-শিক্ষক সমাবেশে বা অন্য কোন অনুষ্ঠানে জঙ্গীবিরোধী সচেতনতা সৃষ্টি করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর তরফ থেকে বক্তব্য দেয়ার রীতি চালু করা হয়। মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে এ্যাসেম্বলি ক্লাসের আগে স্ব স্ব প্রতিষ্ঠান কর্তৃক শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে জঙ্গীবাদবিরোধী বক্তব্য দেয়ার রীতি চালু করা হয়েছে। পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতে কোন জঙ্গী সংগঠনের বিস্তার ঘটতে না পারে এজন্য প্রতিষ্ঠানের প্রধান এবং সকল গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয় করে তদারকি চলছে। নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুমতি, স্বীকৃতি নবায়ন ও শাখা অনুমোদনের ক্ষেত্রে জঙ্গীবাদবিরোধী কার্যক্রম চালানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জঙ্গীবাদবিরোধী কার্যক্রম না চালালে ওই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুমোদন বাতিল করার কথা বলা হয়েছে। শ্রেণীকক্ষের পাঠদান গাইডে জঙ্গীবাদবিরোধী দিকনির্দেশনা রাখা হয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের পাঠ্যপুস্তকেও জঙ্গীবাদবিরোধী কারিকুলাম অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া চালু আছে। অভিযোগ রয়েছে, এসব প্রক্রিয়া মনিটরিংয়ের অভাবে পুরোপুরি বাস্তবায়িত হচ্ছে না। তথ্য মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে জঙ্গীবাদের নেতিবাচক দিক তুলে ধরে ডকুমেন্টারি, নাটিকা, শর্ট ফিল্ম, বিজ্ঞাপনচিত্র, ভিডিও ক্লিপ প্রস্তুত ও বিভিন্ন মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার চালানোর কথা। নতুন মিডিয়ার অনুমোদন দেয়ার ক্ষেত্রে জঙ্গীবাদবিরোধী প্রচারণা চালানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এছাড়া পুলিশ, র‌্যাব ও কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মাধ্যমে মাঠপর্যায়ে জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়াতে পুলিশের সংশ্লিষ্ট সব ইউনিট কাজ করে যাচ্ছে। দেশের প্রায় অর্ধলাখ কওমি মাদ্রাসা, জঙ্গী সংগঠন, সন্দেহভাজন রাজনৈতিক দল, ব্যাংক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সরকারী-বেসরকারী প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে জঙ্গীবাদবিরোধী প্রচারণা ও গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধির কথা রয়েছে। জঙ্গী সংগঠনগুলোর অর্থায়নের অনুসন্ধান করে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। জঙ্গীবাদের অর্থায়ন করার দায়ে কেন্দ্র্রীয় ব্যাংক কয়েকটি বেসরকারী ব্যাংকের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করেছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন ১০ সদস্যের একটি মনিটরিং সেল গঠন করেছে। সেলের সদস্যরা প্রতি শুক্রবার বিভিন্ন মসজিদে উপস্থিত থেকে জুমার নামাজের প্রাক্কালে ইমাম খুতবা পড়ার আগে জঙ্গীবাদবিরোধী বক্তব্য দেন কি-না তা মনিটরিং করছেন।
×