
“নিহিলিজম” বা শূন্যতাবাদ—এটি এমন এক দর্শন, যা এই ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি জিনিসকে অর্থহীন বলে মনে করে। যারা এই দর্শন অনুসরণ করেন, তাদের বলা হয় “নিহিলিস্ট”। এই দর্শনের মূল ভিত্তি হলো—কোনো কিছুরই অন্তর্নিহিত অর্থ, উদ্দেশ্য বা মূল্য নেই।
নিহিলিস্টরা কোনো কিছুতেই বিশ্বাস করেন না—না জ্ঞানে, না কর্মে, না নিয়তিতে, না পুনর্জন্মে, না ঈশ্বরে, এমনকি নিজের অস্তিত্বেও নয়। তাদের কাছে এই সবকিছুই অর্থহীন এবং কোনো কিছুরই কোনো চূড়ান্ত মানে নেই।
সতর্কতা:
এই প্রবন্ধটি আপনাকে নিহিলিজমে অনুপ্রাণিত করার জন্য নয়, শুধুমাত্র তথ্য জানানোর উদ্দেশ্যে লেখা। একান্ত নিজ দায়িত্বে পড়বেন। প্রবন্ধটির বেশিরভাগ অংশই নেতিবাচক এবং এটি আপনার চিন্তার জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে। এটি পড়ার পর আপনি হয়তো আপনার সুন্দর ও স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন নিয়েও সন্দেহ করতে শুরু করতে পারেন। তাই এই দর্শনের গভীরে প্রবেশ করার আগে নিজেকে প্রশ্ন করুন—আপনি কি প্রস্তুত?
এই প্রবন্ধটি পড়ার পর স্বাভাবিকভাবেই মনে হতে পারে, এটি এক ধরনের বোকামি বা ভিত্তিহীন দর্শন। কিন্তু আপনি জেনে অবাক হবেন, নিহিলিস্টদের যুক্তিগুলোর জবাব দিতে গিয়ে বহু জ্ঞানী ও বিজ্ঞ ব্যক্তিও অনেক সময় ব্যর্থ হয়েছেন।
“নিহিলিজম” শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ “নিহিল” (Nihil) থেকে, যার অর্থ “কিছুই না” (Nothing)। এই দর্শন আমাদের জীবনের মৌলিক ভিত্তিগুলোকে নির্মমভাবে অস্বীকার করে। আর একারণেই, যখন আমরা এর যুক্তির মুখোমুখি হই, তখন নিজের এতদিনের বিশ্বাস ও ভাবনার উপরেই প্রশ্ন তুলতে শুরু করি। যদি আপনার বিশ্বাসের ভিত্তি দুর্বল হয়, তবে দর্শনের যুক্তি তা সহজেই ভেঙে দিতে পারে।
নিহিলিজম বলে যে ব্রহ্মাণ্ড, জীবন বা জ্ঞান এসবকিছুর কোনো অর্থ নেই। আমরা এসবে অর্থ খোঁজার চেষ্টা করি কারণ আমরা বোকা হয়ে থাকতে বেশি পছন্দ করি। এই কথাটি সত্য না মিথ্যে, তা নিজেকেই একবার প্রশ্ন করে দেখুন।
নিহিলিজমকে চরম হতাশাবাদ এবং সম্পূর্ণ সংশয়বাদ হিসেবেও দেখা হয়। যদিও এদের মধ্যে মিল রয়েছে, তবুও এই তিনটি বিষয় একে অপরের থেকে আলাদা। নিহিলিজমের বিভিন্ন শাখার মধ্যে প্রধান তিনটি হলো: অস্তিত্ববাদ নিহিলিজম, জ্ঞানতাত্ত্বিক নিহিলিজম, এবং নৈতিক নিহিলিজম।
১. অস্তিত্ববাদ নিহিলিজম
এই মতবাদ অনুযায়ী আমাদের জীবনের বা বেঁচে থাকার কোনো উদ্দেশ্য বা কারণ নেই। আমাদের অস্তিত্বের পেছনেও কোনো তাৎপর্য নেই। আমরা জীবনের অর্থ নিজেরাই তৈরি করি, যাতে আমরা অনুভব করতে পারি যে আমাদের অস্তিত্বের কোনো গুরুত্ব আছে। সত্যি বলতে গেলে, আমরা আছি কি নেই—তাতে এই বিশাল ব্রহ্মাণ্ডের কিছুই আসে যায় না।
দার্শনিক ডেভিড হিউম বলেছিলেন—ব্রহ্মাণ্ডের কাছে একজন মানুষ এবং একটি পোকার জীবনের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এই বিশাল ব্রহ্মাণ্ডের আকার ও বয়সের তুলনায় আমাদের জীবন কিছুই নয়। পৃথিবী আগেও চলছিল, আজও চলছে এবং ভবিষ্যতেও চলবে—আপনি থাকুন বা না থাকুন।
২. জ্ঞানতাত্ত্বিক নিহিলিজম
এই শাখা জ্ঞানের অস্তিত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। এর মতে, জ্ঞান বলে কিছু নেই। আর যদি থেকেও থাকে, তবে তা মানুষের উপলব্ধির বাইরে।
উদাহরণস্বরূপ, নিউটন মাধ্যাকর্ষণ শক্তি আবিষ্কার করেছিলেন। আমরা জানি পদার্থবিদ্যায় তার অবদান বিশাল। কিন্তু তিনি যদি তা না-ও করতেন, তাতে কি ব্রহ্মাণ্ডের কিছু যেত আসত? একদমই না। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি তো আগেও ছিল, আছে এবং থাকবে—আমরা কেবল সাম্প্রতিক অতীতে তা আবিষ্কার করেছি।
এই ব্রহ্মাণ্ড কত বড়, এর শুরু বা শেষ কোথায়—তা আমরা কিছুই জানি না। কয়েকশ কোটি বছর আগে তৈরি হওয়া এই মহাবিশ্বের তুলনায় আমাদের কয়েক হাজার বছরের অর্জিত জ্ঞান কতটুকু অর্থবহ? তাই এই দর্শন অনুযায়ী, আমাদের সমস্ত জ্ঞান অর্থহীন এক অহঙ্কার ছাড়া আর কিছুই নয়।
৩. নৈতিক নিহিলিজম
নৈতিকতা শব্দটি আমাদের সমাজের ভিত্তি—কিন্তু আসলে এর মানে কী? ভালো-মন্দের বিচার? ঠিক-ভুলের পার্থক্য?
ধরুন, A নামের একজন ব্যক্তি B নামের আরেকজনকে গুলি করে দিল। আপনি বলবেন—নৈতিকভাবে A ভুল করেছে।
এখন ভাবুন, B একজন সিরিয়াল কিলার এবং A তা জেনেই তাকে গুলি করেছে। এবার কে ঠিক? আপনি বলবেন—A ঠিক করেছে, কারণ সে একজন অপরাধীকে শাস্তি দিয়েছে।
কিন্তু যদি এমন হয়—A জানতই না যে B একজন সিরিয়াল কিলার? তখন কে ঠিক?
এই উদাহরণগুলো দেখায়—নৈতিকতা কোনো চূড়ান্ত বা সর্বজনস্বীকৃত সত্য নয়। এটি সময়, পরিস্থিতি এবং দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভরশীল। তাই নৈতিক নিহিলিজম বলে—নৈতিকতার কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই। এটি মানুষের তৈরি এক সামাজিক কল্পনা, যার মাধ্যমে মানুষ নিজের আচরণকে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করে।
আশাবাদী নিহিলিজম: অর্থহীনতার মধ্যেও মুক্তি
এই দর্শনের নেতিবাচক দিকের পাশাপাশি একটি ইতিবাচক শাখাও আছে, যাকে বলে "অপটিমিস্টিক নিহিলিজম" বা আশাবাদী শূন্যতাবাদ।
এর মূল বক্তব্য হলো—যেহেতু সবকিছুই অর্থহীন, তাই আপনার ভুল, অপমান, ব্যর্থতা—এসবও অর্থহীন। তাহলে চিন্তা কিসের?
না কোনো সামাজিক চাপ, না অতীতের যন্ত্রণা, না ভবিষ্যতের উদ্বেগ—আপনি বাঁচছেন কারণ আপনি বাঁচতে চান। এই জীবন আপনার, এবং আপনি ইচ্ছেমতো তা উপভোগ করতে পারেন।
তবে এর জন্য একটি কঠিন সত্য স্বীকার করতে হবে—
“You are not special.” (আপনি বিশেষ কেউ নন।)
আরও কঠিন সত্য—
“You are worthless.” (আপনার কোনো মূল্য নেই।)
এই কথাগুলো হজম করা কঠিন। আর সেজন্যই অনেকে নিহিলিজমকে এড়িয়ে চলে বা একে ভুল মনে করে।
কিন্তু একবার ভাবুন তো—যদি শেষে গিয়ে এই দর্শনটিই সত্যি হয়?
যদি আপনার জীবন, কষ্ট, আশা, সম্পর্ক, স্বপ্ন—সবই সত্যিই অর্থহীন হয়?
তখন কী হবে?
সানজানা