ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ৩০ জুলাই ২০২৫, ১৫ শ্রাবণ ১৪৩২

সড়কপথে এশিয়া থেকে আমেরিকা? বৈপ্লবিক এক প্রকল্প বদলে দিতে পারে বিশ্ব

প্রকাশিত: ০৫:০৫, ৩০ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ০৫:০৬, ৩০ জুলাই ২০২৫

সড়কপথে এশিয়া থেকে আমেরিকা? বৈপ্লবিক এক প্রকল্প বদলে দিতে পারে বিশ্ব

ছবি: সংগৃহীত

এশিয়া ও আমেরিকার মধ্যে স্থলপথে কোনো সরাসরি সংযোগ নেই। দুই মহাদেশের মাঝখানে প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তাল জলরাশি থাকায় একে অপরের সঙ্গে ভূমিভিত্তিক যোগাযোগ একপ্রকার অসম্ভবই। কিন্তু ঠিক এই বাধাকে দূর করতেই সামনে এসেছে এক বৈপ্লবিক প্রকল্প, যার মাধ্যমে ইউরোপ থেকে শুরু করে রাশিয়ার ইউরোপীয় এবং এশীয় অংশ পেরিয়ে সরাসরি আমেরিকার আলাস্কা পর্যন্ত স্থলপথে সংযোগ স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে এশিয়া ও আমেরিকার মধ্যে পণ্য পরিবহন, ভ্রমণ এবং বাণিজ্যে ঘটবে ব্যাপক পরিবর্তন। বর্তমানে রাশিয়ার ভ্লাদিভোস্তক থেকে আমেরিকার আ্যাংকরেজ পর্যন্ত পণ্যবাহী জাহাজ চলাচলে সময় লাগে প্রায় ১১ দিন। তবে একটি আন্তঃমহাদেশীয় সড়ক ও রেলপথ তৈরি হলে সড়কপথে প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ যাত্রায় সময় লাগবে ১০ দিন এবং রেলপথে সময় লাগতে পারে গড়ে ১৬ দিন।

প্রকল্পটির অন্যতম প্রস্তাবক রাশিয়ার সড়ক নেটওয়ার্কের প্রধান ভ্লাদিমির ইয়াকুনিন জানান, ‘এটি কেবল রাশিয়াই নয়, সমগ্র এশিয়া এবং আমেরিকা মহাদেশের জন্য হবে যুগান্তকারী এক উদ্যোগ।’

কেন এই উদ্যোগ?

বিশ্বের সবচেয়ে বড় আমদানি-রপ্তানিকারক মহাদেশ এশিয়া। এখানকার চীন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক রেল ও সড়কপথ থাকলেও আমেরিকার সঙ্গে এখনও একমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থা হলো সমুদ্র বা আকাশপথ। চীন থেকে ইউরোপে যাওয়া রেললাইন যেমন ই-উ (Yiwu) থেকে মস্কো হয়ে লন্ডন পর্যন্ত বিস্তৃত, তেমনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে চীন পর্যন্ত বিস্তৃত সড়কপথও রয়েছে।

ছবি: সংগৃহীত

এমন পরিস্থিতিতে রাশিয়া প্রস্তাব করেছে এক উচ্চগতির মহাসড়ক এবং রেলপথ নির্মাণের, যা লন্ডন থেকে শুরু হয়ে ইউরোপ, রাশিয়া, সাইবেরিয়া ও বেরিং প্রণালী পেরিয়ে আমেরিকার আলাস্কা পর্যন্ত পৌঁছাবে।

বিশাল এই প্রকল্পের পাঁচটি প্রধান ধাপ:

১. ইউরোপীয় অংশ – লন্ডন থেকে জার্মানি হয়ে রাশিয়ার মস্কো পর্যন্ত।

২. রুশ-এশীয় অংশ – মস্কো থেকে একাতেরিনবার্গ ও সাইবেরিয়া পেরিয়ে তায়শি, ইমব্রাটস্ক পর্যন্ত।

৩. অন্যান্য এশীয় দেশের সংযোগ – চীন, মঙ্গোলিয়া, সিঙ্গাপুরসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে বিদ্যমান রেলপথের সংযুক্তি।

৪. আন্তঃমহাদেশীয় সংযোগ – রাশিয়ার ইয়াকুতস্ক অঞ্চল থেকে বেরিং প্রণালী পার হয়ে আলাস্কায় সেতু নির্মাণ।

৫. আমেরিকান অংশ – আলাস্কার ফেয়ারব্যাঙ্কস থেকে অ্যাঙ্কোরেজ হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ড পর্যন্ত রেল ও মহাসড়ক সম্প্রসারণ।

রাশিয়ার জন্য নতুন দিগন্ত

প্রকল্পটি রাশিয়ার জন্য শুধু বাণিজ্যিক সুবিধাই নয়, বরং ভৌগোলিক ভারসাম্য আনতে সহায়তা করবে। দেশটির মোট জনসংখ্যা ১৪ কোটির বেশি হলেও রাশিয়ার পূর্বাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা মাত্র ৮০ লাখ। অথচ পশ্চিমাঞ্চলে তুলনামূলক উন্নত অঞ্চলগুলোর অবকাঠামো চিলির তুলনায় অনেক উন্নত।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই রেলপথ ও মহাসড়ক নির্মাণের ফলে রাশিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় ইয়াকুতিয়া অঞ্চলে শিল্প, খনিজসম্পদ উত্তোলন, গ্যাস ও তেল সরবরাহের ক্ষেত্রেও বিপুল অগ্রগতি ঘটবে। ইতিমধ্যে সেখানে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ মূল্যবান ধাতুর ভাণ্ডার রয়েছে।

বেরিং প্রণালীতে সেতু: প্রযুক্তির নতুন চ্যালেঞ্জ

এই প্রকল্প বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো রাশিয়া ও আমেরিকার মাঝখানে থাকা বেরিং প্রণালী। এই অঞ্চলে দুটি দীর্ঘ সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে—একটি রাশিয়ার ইউলেন অঞ্চল থেকে ওইমায়াকন দ্বীপ পর্যন্ত, এবং দ্বিতীয়টি ওখান থেকে আলাস্কার মূল ভূখণ্ড পর্যন্ত, যার দৈর্ঘ্য হবে প্রায় ৮০ কিলোমিটার।

ছবি: সংগৃহীত

এই সেতুগুলোতে থাকবে পৃথক রেল ও সড়কপথ, এবং সম্ভবত পানির নিচে থাকবে গ্যাস ও তেলের পাইপলাইন, যেমনটি রাশিয়া ও জার্মানির মাঝে নর্ড স্ট্রিমে দেখা যায়।

ইউরেশিয়া ও আমেরিকার এক নতুন যোগাযোগ ব্যবস্থার সম্ভাবনা

চীন, মঙ্গোলিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে ইতিমধ্যে বিদ্যমান রেল সংযোগ থাকায় এই প্রকল্পের সাথে যুক্ত হওয়া অনেক সহজ হবে। ইউরোপে ইতোমধ্যে লন্ডন-মস্কো রেললাইন রয়েছে, যা ব্রাসেলস, বার্লিন, পোল্যান্ড, বেলারুশ হয়ে মস্কোতে পৌঁছায়।

আমেরিকান অংশে, আলাস্কার অ্যাঙ্কোরেজ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাকি অংশের সঙ্গে রেল সংযোগ তৈরির পরিকল্পনা ২০২০ সালেই ঘোষণা করা হয়েছে। "আলাস্কা টু আলবার্টা রেলওয়ে" নামের এক কোম্পানি এই প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে, যার মাধ্যমে উত্তর আমেরিকার কেন্দ্র থেকে এশিয়ার বাজারে পণ্য সরবরাহের সময় ও ব্যয় কমবে।

যদিও এই প্রকল্প বাস্তবায়নে বিপুল বিনিয়োগ ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রয়োজন, তবু বাস্তবায়িত হলে এটি বিশ্ব বাণিজ্যে আমূল পরিবর্তন আনবে। উন্নয়ন-প্রত্যাশী রাশিয়ার পূর্বাঞ্চল থেকে শুরু করে শিল্পোন্নত ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়ার মধ্যে গড়ে উঠবে এক অনন্য স্থলযোগাযোগের সেতুবন্ধন।

রাকিব

আরো পড়ুন  

×