
ছবি: সংগৃহীত
নতুন এক গবেষণায় উঠে এসেছে গুরুত্বপূর্ণ এক তথ্য—প্রকৃতির অনেক প্রাণীর দেহে রয়েছে টিক বা উকুনজাতীয় কীট প্রতিরোধের স্বাভাবিক ক্ষমতা। এটি শুধু প্রাণীদের স্বস্তি দেয় না, বরং ভবিষ্যতে উন্নত টিক প্রতিরোধী টিকা তৈরির পথও দেখাতে পারে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটির এনটোমলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জেব ওয়েন। গবেষণার ফলাফল কৃষক, বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপক এবং সাধারণ পরিবারদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে—বিশেষ করে যারা টিকের কারণে নানা সমস্যার মুখোমুখি হন।
কম টিক মানেই নিরাপদ প্রাণী
টিক বিভিন্ন জীবনচক্রে রক্ত পান করে এবং এর মাধ্যমে বিভিন্ন রোগ ছড়ায়—যেমন রকি মাউন্টেন স্পটেড ফিভার ও লাইম ডিজিজ। টিকের আধিক্য এসব রোগের বিস্তারে বড় ভূমিকা রাখে।
এছাড়া টিক প্রাণীদের বিরক্ত করে তোলে। গরু বা বন্যপ্রাণীরা বারবার চুলকানো, চাটানো কিংবা ঘষা দেওয়ার মাধ্যমে সময় ও শক্তি নষ্ট করে ফেলে, যা তাদের স্বাভাবিক আচরণ ও স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে। এমনকি কিছু টিকের কামড়ে ‘রেড মিট অ্যালার্জি’ পর্যন্ত হতে পারে, যার ফলে গরুর মাংস বা শুকরের মাংস খাওয়ার পর মানুষের শরীরে মারাত্মক অ্যালার্জি দেখা দিতে পারে।
কামড়ের পর প্রতিরোধ তৈরি
গবেষকরা খেয়াল করেছেন, হরিণ ইঁদুর, খরগোশ এবং গরুর শরীরে টিক কামড়ানোর পর এক ধরনের প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি হয়। প্রথমবার কামড়ানোর পর প্রাণীর ইমিউন সিস্টেম টিকের লালার নির্দিষ্ট উপাদান চিনে ফেলে এবং পরবর্তী কামড়ে দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখায়।
ফলাফল অনুযায়ী, আগেরবার কামড় খাওয়া প্রাণীদের দেহে ২৩ শতাংশ কম টিক প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় পৌঁছাতে পেরেছে, আর স্ত্রী টিকগুলো গড়ে ৩২ শতাংশ কম ডিম দিয়েছে।
প্রজন্মজুড়ে প্রভাব ফেলে এই প্রতিরোধ
গবেষকরা কম্পিউটার মডেল ব্যবহার করে দেখেছেন, যদি প্রাণীর একটি গোষ্ঠী প্রতিরোধশীল হয়ে ওঠে, তাহলে পুরো অঞ্চলের টিক সংখ্যা ৬৮ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। এমনকি একবারের কামড়ের পরও এই প্রতিরোধ গড়ে উঠতে পারে, যদিও প্রকৃতিতে এটি কত দ্রুত তৈরি হয় এবং কতদিন স্থায়ী থাকে—তা এখনো গবেষণার বিষয়।
গবাদিপশুর প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি
গবেষণায় দেখা গেছে, গরুর মতো বড় প্রাণীদের মধ্যে টিক প্রতিরোধ শক্তি তুলনামূলকভাবে বেশি। এতে শুধু টিকের সংখ্যা কমে না, টিকের প্রজনন ক্ষমতাও হ্রাস পায়। ফলে খামারে কিংবা বনজ পরিবেশে প্রাণীরা অপেক্ষাকৃত বেশি স্বস্তিতে থাকে এবং রক্তক্ষরণ, চুলকানি বা মানসিক চাপ থেকে রক্ষা পায়।
টিকা তৈরির নতুন সম্ভাবনা
এই গবেষণা ভবিষ্যতের টিক প্রতিরোধী টিকা তৈরির নতুন দিক দেখাতে পারে। যদিও এ পর্যন্ত যেসব টিকা তৈরি হয়েছে, সেগুলো নির্দিষ্ট কিছু টিক ও প্রাণীর ওপরই সীমাবদ্ধ ছিল।
অধ্যাপক জেব ওয়েন বলেন, “একটি প্রাণীর জীবনের পুরো চক্র ধরলে টিকের ওপর এর প্রভাব বিশাল। এই গবেষণা আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখায়—কেন কখনো টিকের আধিক্য বাড়ে আবার কখনো কমে যায়।”
আরও গবেষণার প্রয়োজন
গবেষকরা বলছেন, প্রতিরোধ শক্তি তৈরি হয় ঠিক কোন উপাদানে—তা এখনো পরিষ্কার নয়। পরিবেশের তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, আবাসস্থলের ধরন—এসবও টিকের বিস্তারে বড় ভূমিকা রাখে। ভবিষ্যতের গবেষণায় দেখা যেতে পারে, একটি কামড়ই কি প্রতিরোধ তৈরি করতে যথেষ্ট, নাকি বহুবার কামড় খাওয়ার প্রয়োজন হয়।
এমন তথ্য livestock (গবাদিপশু) ব্যবস্থাপনায় সাহায্য করতে পারে। প্রতিরোধ কতদিন স্থায়ী হয়—তা বোঝা গেলে খামারিদের জন্য তা হবে দারুণ সহায়ক।
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণেও উপকার
কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, বন্যপ্রাণীদের মধ্যে যদি প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো যায়, তাহলে সংরক্ষণ কার্যক্রমেও তা ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এতে প্রাণীদের টিক-বাহিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমবে এবং টিক জনসংখ্যাও হ্রাস পাবে।
এখনো সাবধানতা জরুরি
যদিও গবেষণা আশাজাগানিয়া, ব্যক্তিগত সতর্কতা এখনো সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। সঠিক পোশাক পরা, শরীর ও পশুপাখিকে নিয়মিত টিক পরীক্ষা করা এবং পরিবেশ পরিষ্কার রাখা—এসব টিক নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক জার্নাল Ticks and Tick-Borne Diseases-এ।
আসিফ