
কলেজ রোডের শেষ মাথায় একটা আধা-ভাঙা বাড়ি, নাম ‘শিউলি নীড়’। এই বাড়ির নিচতলায় থাকে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র নাহিয়ান, সবাই ডাকে ‘নাহি’ নামে। হালকা পাতলা গড়ন, বুদ্ধিতে ঝাঁঝালো মরিচ। বয়স তেরো হলেও কথাবার্তায় যেন বিশ বছরের পুরনো মেজাজ!
নাহির সঙ্গী দু’জন। ইমরান আর শ্রেয়া। ইমরান একটাই শার্ট পরে তিনদিন স্কুলে গেলেও দুনিয়ার খবর জানে খবরের কাগজের থেকেও বেশি। শ্রেয়ার কথা বললে আলাদা করে বলতে হয়। চুলে সবসময় দুটো পেনসিল গোঁজা থাকে। যেকোনও সময় কেউ যদি অঙ্ক না পারে, পেনসিলটা টেনে বের করে শ্রেয়া বলে, ‘আমি করে দিই।’
এই তিনজন মিলে একটা ক্লাব খুলেছে, ‘স্লিপার গ্যাং গোয়েন্দা ক্লাব’। নামটা এসেছে- কারণ সবাই ক্লাসে স্লিপার পরে আসে।
বিকেলের দিকটা বেশ নিরীহ। নাহি বারান্দায় বসে চিপস খাচ্ছিল, হঠাৎ গেটের সামনে টিকটিক করে একটা শব্দ। নিচে নেমে দেখে- তিন তলার শম্পা আন্টি দাঁড়িয়ে, মুখ গম্ভীর।
‘নাহি, একটা ব্যাপার হয়েছে। তুমি গোয়েন্দা বলেই তো শোনালাম। আমাদের বাসার ট্যাক্সিডার্মি হরিণটা হারিয়ে গেছে!’
নাহি চোখ কুঁচকে বলে, ‘ট্যাক্সিডার্মি মানে?’
‘মানে, মরার পর সংরক্ষণ করা হরিণ। তোমার আঙ্কেলের শখে কেনা ছিল। জিনিসটার দাম পঁচিশ হাজার টাকা!’
এই কথা শুনেই ইমরান বলে ওঠে, ‘মরা হরিণ হারায় কিভাবে? ও তো নড়তে পারে না!’
শম্পা আন্টি বলেন, ‘কাল রাতে বারান্দায় ছিল। সকালে দেখি নাই।’
নাহি চিপসের টুকরো মুখে দিয়ে বলে, ‘মানে, চোর মরা হরিণ চুরি করেছে? বেশ মজার লাগছে।’
শ্রেয়া গম্ভীর, পেনসিল খুলে হাতে নেয়।
‘চুরি যেহেতু হয়েছে, রহস্যও আছে। কাজ শুরু করা যাক।’ বললো শ্রেয়া।
প্রথমেই তারা ওঠে তিনতলায়। শম্পা আন্টির বারান্দা ঘেঁষে আছে পরের বিল্ডিংয়ের দেয়াল, যেটা সিমেন্টের পুরোনো প্যাচে ভর্তি।
নাহি দেয়ালে আঙুল রাখে, ধুলা মোছে। ‘এখান দিয়ে কেউ আসা-যাওয়া করেছে। এটা পায়ে ঘষা দাগ।’
ইমরান মোবাইল দিয়ে ছবি তোলে। বলে, ‘এটা তো ঝুমঝুমি বিল্ডিং। ওই বাড়িতে তো একটাই ছেলে থাকে, তানভীর।’
শ্রেয়া বলে, ‘চলো, একবার কথা বলা যাক।’
তানভীর একাই থাকে, কারণ তার মা-বাবা বাইরে থাকেন বেশি। সে কম কথা বলে, তবে গেমিংয়ে ওস্তাদ। নাহি দরজায় নক করে, তানভীর দরজা খোলে, হাতজোড়া গেম কন্ট্রোলারে।
‘তুই কি কাল রাতে তিন তলায় গেছিলি?’ নাহি সরাসরি প্রশ্ন করে।
তানভীর কাঁধ ঝাঁকে- ‘না, কেন?’
শ্রেয়া বলে, ‘তোর দেয়ালের ধারে পায়ের দাগ।’
তানভীর বিরক্ত হয়ে বলে, ‘আমি সারা রাত অনলাইনে ছিলাম। তবে আমি কাল রাতে একটা ছায়া দেখেছিলাম জানালা দিয়ে।’
‘কী রকম?’ ইমরান আগ্রহে বলে।
‘ছায়াটা লম্বা ছিল, আর ওর পিঠে যেন কিছু ছিল। আমি ভাবছিলাম হ্যালুসিনেশন।’
রাতে নাহি, শ্রেয়া আর ইমরান ফের তদন্ত করতে বারান্দায় আসে। চাঁদের আলোয় নাহির চোখ পড়ে- একটা সাদা কিছু আটকে আছে পরের দেয়ালে।
‘ওইটা কি?’
শ্রেয়া পেনসিল দিয়ে দেখায়, ‘হরিণের লেজ!’
তারা নিচে নেমে দেয়াল টপকে পরের প্লটের ভেতর ঢুকে পড়ে। প্লটটা পরিত্যক্ত, কিন্তু হঠাৎ তারা দেখে, একটা হাফ ভাঙা শেডের নিচে হরিণটা দাঁড়িয়ে!
নাহি হেসে ফেলে। বলে, ‘চোর যদি হরিণ রেখে পালায়, তবে এটা চুরি না, এটা পরিকল্পনা।’
পরদিন সকালে তারা ফের শম্পা আন্টির কাছে যায়। হরিণ ফেরত দিয়ে বলে, ‘এটা কোনো চোর নেয়নি।’
‘তাহলে?’ শম্পা আন্টি চমকে ওঠেন।
নাহি হাসে। ‘আপনার ছেলে, যে হোস্টেলে থাকে, কালকে সে এসেছিল, আপনি না থাকায় হরিণ দেখে ভয় পেয়ে বারান্দা থেকে নামিয়ে পাশের প্লটে রাখে।’
‘তোমরা কীভাবে জানলে?’ আন্টি বিস্মিত।
ইমরান বলে, ‘দেয়ালে পায়ের ছাপের পাশেই চিপসের প্যাকেট ছিল, আপনার ছেলেরই পছন্দের চিপস।’
শ্রেয়া বলে, ‘আর হরিণের গলায় আপনার ছেলের নাম লেখা স্টিকার ছিল, ভুলে রেখে গেছে।’
শম্পা আন্টি মাথা নাড়েন। ‘বাহ! তোমরা তো আসলেই ছোট গোয়েন্দা!’
ক্লাব রুমে ফিরে ইমরান বলে, ‘এইটা তো চুরির কেস না, ভয় পাওয়ার কেস!’
নাহি হেসে বলে, ‘কিন্তু রহস্য তো ছিল! আর আমাদের ক্লাবের নাম তো ‘স্লিপার গ্যাং’। আমরাই শহরের একমাত্র গোয়েন্দা যারা স্লিপার পায়ে রহস্য ধরতে পারি!’
তিনজন হাই ফাইভ করে। শ্রেয়া বলে, ‘পরের কেস কার জানি!’
আর বারান্দার কোণে পড়ে থাকে সেই পুরনো হরিণ, চুপচাপ, গম্ভীর, আর হালকা চিপসের গন্ধে ঘেরা।
প্যানেল