নতুন কোন গোধূলি নয়। সেই চির পরিচিত নিত্যদিনের ফেরীওয়ালাদের ‘চা গরম,’ ‘এই লাগবে ডিম’, ‘ঝাল মুড়ি’, ‘ঠান্ডা পানি’, ‘চানাচুর’ এর শব্দে স্টেশনটা মুখর। মাগরিবের আযান হয়ে গেছে। কমলাপুরের আকাশের এক কোনে শেষ লাল আভা মিলিয়ে যাচ্ছে। দুই নম্বর প্ল্যাটফরমে দাঁড়িয়ে আছে “ঈশা খাঁ” আন্তঃনগর ট্রেন। সড়ক যোগাযোগ ভাল হয়ে ওঠায় ট্রেনে এখন ভিড় কম। প্রায়ান্ধকার একটা সেকেন্ড ক্লাশ কম্পার্টমেন্টে ঢোকার প্রথম সিটে জানালার পাশে বসে আছে একজন যাত্রী। তার ডান পাশে আর কোন যাত্রী নেই। মাঝখানের সিটগুলোও খালি। উল্টা দিকের জানালার পাশের সিটগুলোতে আর জনাচারেক যাত্রী। প্রথম যাত্রীর মুখে দাড়ি। এতে আধুনিক নাস্তিকতার কোন চিহ্ন নেই। অনেকটা স্বচ্ছলতার অভাবে দাড়ি রাখার মত। তার শার্টটি চায়নিজ হলেও প্যান্টের ভেতর ইন-করে পড়া নয়। প্যান্টের পায়ের কাছে পেছনটা ছেঁড়া। ওতে ইস্ত্রী নেই। এখন অগ্রহায়ণ। যে নীল জ্যাকেটটা লোকটি পড়ে আছে তা বঙ্গবাজারের। একান্ত সস্তা। লোকটির নাম মাজুমিস্ত্রি। বংশ বোঝা গেলেও এসব নামের কোন অর্থ নেই। আরবী, বাংলা, তুর্কী বা ফরাসী কোন শব্দ নয় এটি। ইংরেজ আলীর মতো আর কি। মাজু পেশায় এখন একজন স্ট্যাম্পভেন্ডর কাম দলিল লেখক। অধিকাংশ মানুষের বোধের অদম্য এবং দার্শনিক জটিলতা রয়েছে, মাজু সেগুলোতে খুব স্বচ্ছন্দ। মাজু এখন জমি জমা সংক্রান্ত একটা বিশেষ কাজে ঘোড়াশাল যাচ্ছে। গার্ডের হুইসেলের তীব্র শব্দ পাওয়া গেল। ট্রেন ছেড়ে দিল। এখন আস্তে চলছে। আধা মিনিটের মধ্যে গতি একটু বাড়ল। একদিকে প্ল্যাটফরম। আলোয় ভরা। উল্টাদিকে দরজার বাইরে নিচু জায়গা। ওখানে অন্ধকার। ওদিক দিয়ে যাত্রী ওঠা নামা তেমন একটা করে না। এমন সময় হঠাৎ একজন লোক ওদিক থেকে ট্রেনে উঠে পড়ল। সে কমপার্টমেন্টের দিকে পিঠ দিয়ে কি একটা জিনিস ধরে ট্রেনে উঠাচ্ছে। দ্বিতীয় একজন লোক নিচ থেকে সেটা ঠেলে দিচ্ছে। একটা লম্বা কাপড়ের বস্তার মতো কিছু মাজুর পাশে রেখে লোকটা কিছুক্ষণ দাঁড়াল। স্বাভাবিক, ধীর স্থির ভঙ্গি করে। যেন বিশ্রাম নিচ্ছে ভারী জিনিসটা তোলার খাটনি দূূর করতে। দ্বিতীয় লোকটাকে মাজু দেখতে পায়নি। ট্রেনের গতি এখন বেশ বেড়ে গেছে। আউটার সিগন্যাল পার হচ্ছে। কোন কোন যাত্রী ট্রেন ছাড়ার পর এভাবে উঠে থাকে। মাজু লোকটার মুখ চোখ ভাল করে দেখার আগেই লোকটা আচমকা সিঁড়ির হ্যান্ডেল ধরে প্রায় লাফ দিয়ে ট্রেন থেকে নিচে নেমে গেল। অন্যান্য যাত্রীরা বিষয়টা খেয়াল করেনি। তারা তাকিয়েছিল প্ল্যাটফরমের দিকে। ট্রেন এখন ফুল স্পিডে এগিয়ে চলছে। মাজু ট্রেনে চড়ে বটে কিন্তু এরকম দৃশ্যের সামনে কখনো পড়েনি। ও বস্তাটার দিকে তাকাল। ওটা ওর সিটের পাশে ডান দিকে ঠেস দিয়ে দাঁড় করানো ছিল এতক্ষণ। ঝাঁকুনি এবং মাধ্যাকর্ষণের টানে ওটা এখন কাত হয়ে গেছে। ছালার বস্তার ব্যবহার এখন কম। পলিথিন বা প্লাস্টিকের দোর্দণ্ড প্রতাপ মাল ভরার কাজে। মাজু এবার ভাল করে তাকিয়ে দেখল সারের বস্তায় ভরা জিনিসটাকে। এখন বস্তাটা মাজুর উরুর উপর এসে পড়েছে। রীতিমত ওজন লাগছে ওর। মাজু বিস্ময় আর বিরক্তি ভরা মন নিয়ে বস্তাটা ধরে ওর থেকে দূরে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করল। বেশ ভারী। মাজু গ্রামের মানুষ, স্বাস্থ্যবান এবং পরিশ্রমী। তাও কাজটা করতে কষ্ট হলো। মাজু ভাবার চেষ্টা করল ব্যাপারটা কি হতে পারে। চল্লিশ মিনিটের আগে ট্রেনটা থামার কোন সম্ভাবনা নেই। ওদিকের যাত্রীরা নিজেদের মধ্যে কি যেন আলাপ করছে। ট্রেন এখন টঙ্গীস্থ স্টেশনের দিকে যাচ্ছে। মাজুর মনে হলো ভেজা একটা কিছু ওর ক্ষয়ে যাওয়া রাবারের চপ্পলের নিচে এসে আস্তে আস্তে জমা হচ্ছে। কেমন একটা গন্ধও যেন নাকে এসে লাগছে। নানা শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে ঝগড়া, তর্ক, বিতর্ক এমনকি ধাওয়া পাল্টাধাওয়ার ঘটনার সঙ্গে মাজু একেবারে অপরিচিত নয়। সে খবরের কাগজও মাঝে মধ্যে পড়ে থাকে। অস্বস্তিকর গন্ধটা বেড়ে চলছে। সেই সঙ্গে মাজু কেমন যেন একটা ঝামেলার গন্ধ পেল। ও এবার নিশ্চিত হলো এই ভেজা বস্তুটা মনুষ্য রস এবং গন্ধটা লাশের। গন্তব্য এখনো দূরে। ওর সঙ্গে মুঠোফোন আছে। ট্রেন এই স্টেশনে থামে কিনা মাজুর জানা নেই। লোহার দরজা দুদিক থেকে শক্ত করে লাগানো। কি করবে ভাবতে ভাবতে ট্রেনের গতি কমে এলো। টঙ্গী জংশন। মাজু উঠে দাঁড়াল। দরজা খুলবে। ঠিক করল প্ল্যাটফরম নয়, উল্টো দিক দিয়ে ও নেমে যাবে ওদিকটায় অন্ধকার।
উঠে দাঁড়িয়ে দরজায় হাত দিল মাজু। সঙ্গে সঙ্গে হাতে টর্চ কাঁধে রাইফেল এবং বাঁশির হুঁইসেল বাজিয়ে তিনজন খাকি ইউনিফরমধারী সিঁড়ি বেয়ে কমপার্টমেন্টে উঠে পড়েছে। এদের চেহারাই বলে দেয় এরা কারা। নানা অভদ্রজনের সঙ্গে গভীর রাতে দীর্ঘদিন চলাফেরার ফলে এদের চেহারা দুর্ধর্ষ এবং ভাষা হয়ে উঠে অন্যরকম। এরা রেল পুলিশ। যাত্রীদের দিকে সরাসরি টর্চ ফেলে এদের দলনেতা বলল, ‘সাবধান, কেউ নামবে না। এর মধ্যে বস্তার উপর তার টর্চের আলো এসে পড়েছে। সে বলল, ‘এই মাল কার? মাজু কিছু বলার আগেই তাকে সে বলল, ‘‘বস্তায় কি আছে। ‘খোল’ সার্চ করুম’’। কথায় তার কর্তৃত্ব এবং কুমিল্লার উচ্চারণ সুষ্পষ্ট। ‘ মাজু বলল, ‘ বস্তা আমার না। এই সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।’ ‘কাহিনী আর গল্প পরে বানাইও। অন্য কারো লগে, আমাগো লগে না।’ এর মধ্যে পেছনের দুজন কনস্টেবল মাজুর অনিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নিয়েছে। গভীর রাতে এরা রেল ডাকাতদের সঙ্গে গুলি বিনিময় করে এবং কখনো কখনো এনকাউন্টারে অংশ নিয়ে থাকে। এর মধ্যে দলনেতা তার মোবাইলে কারো সঙ্গে কথা বলে। ট্রেন এখানে পাঁচ মিনিট থামে। যাত্রী উঠানামা করছে না এই কামরায়। মাজু বলে, ‘দেহেন, ঐ যে প্যাসেঞ্জার গো জিগান। এই বস্তা আমার কিনা।’ বস্তাডা দুইজন লোকে এইখানে রাখছে ট্রেন ছাড়ার পরে। রাইখাই তারা নাইমা গেছে।’ দলনেতা গাড়ির যাত্রীদেরকে কথাটা জিজ্ঞেস করল। তারা বিষয়টা ঘটার সময় লক্ষ্য করেনি। নাকি খাকি পোশাকের সঙ্গে ঝামেলায় জড়াতে চায় না বলে তা বোঝা গেল না। তবে তারা বলল, তারা বিষয়টা সম্পর্কে কিছু জানে না, কিছু দেখেনি। অতএব, হিন্দি সিনেমার মতই দলনেতা মাজুকে বলল, ‘যা কিছু বলবে থানায় বলবে।’
মাজুর দুর্বল যুক্তি, সামান্য অর্থ এবং পসারহীন উকিলের ওকালতির সামনে এবং রাষ্ট্রপক্ষের প্রবল উপস্থিতিতে আদালতে যা প্রমাণ হলো তা নিম্নরূপ:
ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এবং অসদুদ্দেশ্যে মানুষ হত্যা আলামত নিশ্চিহ্ন করার জন্য লাশ গুম প্রচেষ্টা। মাজুর কোনো সাক্ষী নেই, রাষ্ট্রপক্ষেরও চাক্ষুস সাক্ষী নেই। কিন্তু চোরাই মালের মতই লাশ তো সঙ্গে পাওয়া গেছে। বস্তায় পাওয়া গেছে দু’হাতের চিহ্ন। আইন তাই প্রমাণ করল ‘ঘটনার পারিপার্শ্বিকতায় মাজু দুটি অভিযোগেই দোষী প্রমাণিত হলো। বিচারক তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারলেন যে, তার সামনের আসামীটি যে চোখে কথা বলছে, তাতে পাপ বা অপরাধবোধ নেই। কিন্তু তদন্ত রিপোর্ট, চার্জশীট, সাক্ষ্য, প্রমাণ এবং আইনের ধারাসমূহ জলজ্যান্ত। অনেক মামলার এমনি ঘটনার পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যে বিচার হয়েছে এবং আসামী শাস্তি পেয়েছে এমন প্রেসিডেন্সের সংখ্যা বিরল নয়। ওগুলো তিনি অগ্রাহ্য করবেন কি করে? রায় পড়ে শুনে বলা হলো আসামী ইচ্ছে করলে এত দিনের মধ্যে আপীল করতে পারে। এই কাজটিতে জড়িত সময় এবং অর্থের পরিমাণ মাজুর শ্রেণীর মানুষের কাছে অসীম এবং একটি দুর্ভেদ্য তমিস্রা। হতবিহ্বল মাজু বুঝতে পারল না এই নাটক কি করে হলো? কে সাজাল? সে বলল, এই উল্টোস্রোতে যাওয়ার সামর্থ্য তার নেই। কিন্তু এখন নানা মানবাধিকার সংস্থা এসব বিষয়ে কাজ করছে। রাজী হলে তারা সহায়তা করতে এগিয়ে আসে। মাজু সম্মত হলো। চার বছরের রথ যাত্রায় ভিন্ন ফল পাওয়া গেল না। শাস্তি-মৃত্যুদণ্ড বহাল। কিন্তু বিচারক মাজুর কাছে জানতে চাইলেন সে অনুতপ্ত হবে কিনা এবং তার শেষ ইচ্ছা কি? মাজু বলল, ‘যদিও প্রমাণ করতে পারি নাই যে, আমি এই মামলায় কোনো পক্ষ না। এইটা সম্পূর্ণ কাকতালীয় যে, লাশটা আমার সঙ্গে পাওয়া গেছে। আমি নির্দোষ। তবে স্যার ‘একটা কথা আছে।’ বিচারক বললেন, ‘বল, কি তোমার কথা?’ ‘স্যার, অনেক বছর আগে একটা জমি কিনছিলাম অনেক কষ্টের টাকা দিয়া। বায়না করার পর লোকটা আমারে আর জমিডা বুঝাইয়া দেয় না। খালি ঘুরাইতাছে। আইজ কাইল কইরা। আমার গ্রামের কাছের ঘটনা। আমি তারে একদিন ধরলাম। আশেপাশে কেউ ছিল না। তারে কইলাম জমি বুঝাইয়া দিতে, নাইলে টাকা ফেরত দিতে। হে উল্টা গালিগালাজ কইরা কইল, মুরদ থাকলে আমি যেন টাকা তার থনে ফিরত লই। আমি নাকি তার থিকা টাকা জমি কিছুই পাই না। গ্রামে এরকম ঘটনা হরহামেশাই হয়। জমি কম মানুষ বেশী। আমার মেজাজ গেল গরম হইয়া। আর ঐদিন আমি তৈরী আছিলাম। কোমর থেকা ছুরি বাইর কইরা অর সিনায় বহাইয়া দিলাম আঁতকা। ও এতটা ভাবতে পারে নাই। লোকটা চিক্কর দিবার অবসর পাইল না। ঐখানেই মারা গেল। আমি লোকটারে একটু দূরে মাটিতে পুঁতলাম। ঘটনা কেউ দেখে নাই, শুনে নাই। কোনো সাক্ষী নাই। কেউ আমারে সন্দেহ করে নাই। দশ বছর আগের ঘটনা। আমারে আজ পর্যন্ত পুলিশ খুঁজে নাই। কাজটা যে অন্যায় করছি, তাতে সন্দেহ নাই। আপনারা বিশ্বাস করবেন না জানি। তবে খোদার কসম কইরা কইতাছি, আজকের মামলার কোনো কিছুই আমি জানি না। তয় মনে হইতাছে আল্লাহর বিচার একভাবে হইয়া যায়। দশ বছর আগের ঐ অপরাধের শাস্তি মনে হয় আইজকা পাইলাম। মাজুর বক্তব্যে আদালতে একটি নাটকীয় আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সবাই মনোযোগ দিয়ে মাজু মিস্ত্রির কথা শুনছিল। তবে তা ক্ষণিক। সাক্ষ্য আইনে আল্লাহ বা খোদাকে তলব করার বা জিজ্ঞাসাবাদ করার কোনো বিধান নেই। বিচারক আসামীকে যথা স্থানে নিয়ে যাবার আদেশ দেন।
নির্দোষ, তবে
শীর্ষ সংবাদ: