কবিতা
ইয়ামিন, প্রিয়পুত্র আমার
শাহীন রেজা
এপিসি’র উপর থেকে নিথর দেহটা যখন ধানের বস্তার মত টেনে হিঁচড়ে ফেলে দেয়া হলো তখনও তোমার দেহে প্রাণ ছিলো। তুমি ঠোঁট নাড়ছিলে একফোঁটা পানির জন্য। হে আমার সন্তান, কী ব্যর্থ পিতা আমি, মৃত্যুর নির্মমতায় ছটফট তোমার মুখে তুলে দিতে পারিনি এক বিন্দুটুকুও। ইয়ামিন, প্রিয়পুত্র আমার, ক্ষমা করে দিও। কমফোর্টারের ভিতরে শীতঘুমে আচ্ছন্ন আমরা বুঝতেই পারিনি আমাদের সন্তানেরা তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য কি ভাবে পেতে দিচ্ছে বুক বুলেটের সামনে। না তখন তো রাত নয় রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিন শাসন করছে পৃথিবী, পাখি উড়ছে, ফুলে ফুলে প্রজাপতি, রক্তের ঘ্রাণ শুকে শুকে একদল মৌপিঁপড়া গোয়েন্দার মত হানা দিচ্ছে মৃতদেহের পাশে।
প্রিয়পুত্র, আমরা তোমাকে বেঁধে রাখতে পারিনি, দিতে পারিনি সুন্দর এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা। যে বৈষম্যের তীব্র ছোবল তোমাদের হৃদয়কে রক্তাক্ত করেছিল, সেই ছোবলের পেছনে লুকিয়ে থাকা রক্তলোভী হায়েনারা আরও রক্তাক্ত করে অন্যদের মত তোমাকেও কেড়ে নিলো চূড়ান্ত ভাবে। না আমি আর কাঁদবো না। প্রিয়তম পুত্রের জন্য অশ্রুকে অস্ত্র বানিয়ে তাক করবো ফ্যাসিবাদী ওদের দিকে। আমাদের ঘৃণায় নিশ্চিত ধ্বংস হবে ওরা, ওদের প্রেতাত্মারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে পৃথিবী থেকে।
** এজাহার
ফারুক ওয়াসিফ
কী দেশে এলাম!
প্রহারের পরে রক্ত জমে নীল,
মেয়েটির গায়ে কালশিটে দাগ
তরুণ শরীরে কালশিরা,
আকাশে আকাশে ঝলকায় বিদ্যুৎ
তবু জেনে রেখো মহারাণী
যদি ফিনকি দিয়ে রক্ত নামে ফের
প্রতিশোধের দাদন তুলবে সময়।
আমরা পারিনি, পরে যারা আছে তারা
তিল তিল শুধে নেবে বকেয়া বিচার;
এই দেশে শিশু ফের জন্ম দেব বলে,
আমাদের হতে হবে মায়ের মতন
ব্যথার পাঁজর থেকে দিতে হবে চাপ;
হতে হবে বিশুদ্ধ কঠিন, সরলতা ভোর।
হাজির হয়েছি সোনা, রক্তাক্ত শিয়রে তোর
ঝড়ের তরঙ্গে পাখি
আয় তোরা আগুনের ¯্রােত
তোমার আমার দেখা, রক্তমিতা,
সে মিছিলে হোক।
** বাংলাদেশটা আজ কারাগার
ইমরান মাহফুজ
[গণগ্রেফতারের প্রতিবাদে]
কতোজনকে করবে আটক তুমি?
কতোজনকে ভরবে কারাগারে?
এই জনগণ উঠলে পরে ফুঁসে
রাজপথে রোজ সহ¯্রগুণ বাড়ে।
থানা-হাজত নেইকো কোথাও ঠাঁই
কারাগারে উপচে পড়া ভিড়।
স্বৈরাচারের আসন যখন টলে
তখন সে হয় আগ্রাসী-অস্থির।
শেষ ছোবলে আগ্রাসী-আক্রোশে
জনগণকে বন্দি করতে চায়।
একটিবারও ভাবে না কী হবে
গণেশ ঠাকুর উল্টে যদি যায়।
কারাগারের সংখ্যা কত দেশে?
চৌদ্দ কোটির ঠাঁই কি হবে তাতে?
বাংলাদেশটা আজকে কারাগার
ভীত সরকার গণগ্রেফতারে মাতে।
দেশবাসীকে বন্দি করে রাখো
লাঞ্ছিত হোক সংবিধানের পাতা।
চৌদ্দ কোটি জেলের ভেতর থাকুক
বাইরে থাকুক পুত্র এবং মাতা।
** কারফিউয়ে কালো ক্যারাভান
মারুফ রায়হান
কারফিউয়ে কালো ক্যারাভান চলেছে অলিগলি মাড়িয়ে
নিñিদ্র অন্ধকারে হিসহিস ঘর্ঘর শব্দ তুলে, শেষরাতে
কে তার চালক, কোন পাতকী, গন্তব্য পিশাচ-ফাঁড়িতে
কান্নাক্যারাভানে করুণ তরুণ, রক্তদাগ সুরহারা এ¯্রাজে
কত রক্ত পেলে বল, রক্তিম হবে কাক্সিক্ষত গোলাপ
কত প্রাণ হলে বলিদান থেমে যাবে মায়ের বিলাপ
জুলাই ফুরোয়, বল, কবে হবে শেষ অঞ্জলি অশেষ
স্বপ্নভস্ম-ভূমে আরও একবার স্বপ্ন দ্যাখে বাংলাদেশ।
** সিচুয়েশন নরমাল
শেরিফ ফারুকী
সিচুয়েশন নরমাল, একদম নরমাল
শুধু তিন রাস্তার মোড়ে কয়েকটা মৃত লোক
গাদাগাদি করে পড়ে আছে।
তরকারির ভ্যানটায় আরো কয়েকটা
মানুষ আছে, ওরা কাতরাচ্ছে।
মোড়ের চা দোকানটায় এখনো একটা লোক
আড়মোড়া ভেঙে বসে আছে।
ওর গা থেকে রক্তের একটা কালচে
ধারা নেমে শুকিয়ে গেছে।
আজিমপুরে অল্প কিছু বেওয়ারিশ লাশ
দাফন ছাড়া সিচুয়েশন একদম নরমাল।
অল্প কয়েকটা লোককে পোড়ানোও হয়েছে।
এসব নিয়ে অতো আলাপের কিছু নেই।
বরং শোনেন,
যে ছেলেটা বুলেট বুকে নেওয়ার জন্য
রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেল,
ও ড্রাগ অ্যাডিক্ট ছিল।
ড্রাগ অ্যাডিক্ট তো মতিউরও ছিল,
নইলে কেউ বিমান নিয়ে নিজ দেশে
পালিয়ে আসার সাহস করে?
সব শালায় ড্রাগ অ্যাডিক্ট, সবকয়টা।
এই কয়টা লোক ঝামেলা করছে শুধু,
আর ঝামেলা করছে লাশগুলো।
এর বাইরে সিচুয়েশন নরমাল, একদম নরমাল।
** ভোজসভা বিষয়ক
মিলু শামস
বিরক্ত কোর নাÑ
আমরা ভোজসভায় বসেছি
জরুরি জনগুরুত্বপূর্ণ;
ভোজসভা জনগুরুত্বপূর্ণ হয় না
তোমায় কে বলেছে?
আমরা চাষাভুষার সন্তান হলেও
নিখাঁদ ইংলিশ এবং মার্কিন
দু’পদ্ধতির টেবল ম্যানারসে
ভোজন-রস আস্বাদন করতে শিখেছি
সুতরাং একটি ‘বাংলা’ ভোজসভাকে
আদি রূপ অক্ষুণœ রেখে
কীভাবে ব্যাকরণসিদ্ধ করতে হয়
তা নিয়ে এখন আমাদের
মাথা ঘামাতে হয় না।
তার ওপর এটিকেট বজায় রাখার প্রতি
একদল মার্জিত ট্রেনারের সতর্ক দৃষ্টি এবং সার্বক্ষণিক
নিগূঢ় পর্যবেক্ষণ রয়েছে
রয়েছে প্রশিক্ষিত বেয়ারা ও শেফ;
তাই প্রতিটি ভোজসভা অনায়াসে
হয়ে ওঠে ফ্রুুটফুল, নিখুঁত।
সুতরাং ভোজসভা জরুরি জনগুরুত্বপূর্ণ হয় কিনা
অথবা এর আগে এ ধরনের
শাব্দিক বিশেষণ গ্রহণযোগ্য কিনা
সে প্রশ্ন অবান্তর।
শব্দের ছেঁদো ব্যাখ্যা নিয়ে
ঘ্যান ঘ্যান কোর নাÑ
ওসব অভিধানে আছে, দেখে নাও।
এখন ভোজসভায় আছি
বিরক্ত কোর না।