
আল্লারাখির বেতন থেকে জরিমানা কাটা যায়নি
এমন মাস খুব কমই গেছে, যে মাসে আল্লারাখির বেতন থেকে জরিমানা কাটা যায়নি। কখনো কখনো সে ছয় টাকার মধ্যে পাঁচ টাকা পেতো। সবকিছু সহ্য করে নিয়েছিল। এ নিয়ে পরিচ্ছন্নতা বিষয়ক ইন্সপেক্টর খয়রাত আলী খানের সামনে কখনো আসেনি। খান সাহেবের অধীনে শ-খানেক ঝাড়ুদার ছিল কিন্তু তিনি কখনো কারও বেতন কাটেনি, জরিমানা করেনি, না কাউকে তিরস্কার করেছেন কখনো। কিন্তু আল্লারাখি বারবার তার হাতে শাস্তি পেয়েছে। সে কাজে ফাঁকি দিত না। বেয়াদব ছিল না। আনাড়ি ছিল না। না দেখতে ছিল কুৎসিত। প্রচণ্ড শীতের মধ্যেও মাঝরাতে ঝাড়ু নিয়ে বেরিয়ে পড়তো। এবং নয়টা পর্যন্ত একই ভাবে সড়কে ঝাড়ু দিয়ে যেত। এরপরেও তার জরিমানা হয়ে যেত।
অথচ আল্লারাখির স্বামী হোসেনীও অবসর পেলে তার কাজ করে দিত। কিন্তু আল্লারাখির কপালই ছিল খারাপ। জরিমানা দিতেই হতো। যেদিন বেতন দেবার জন্য তলব করা হতো, ওইদিন সবার জন্য ছিল আনন্দের দিন অথচ আল্লারাখির জন্যে ছিল কান্নার দিন। ওইদিন তার মন যেন ক্রুশে ঝুলানো থাকতো। কে জানে আবার কত টাকা কাটা যায়? সে পরীক্ষার্থীদের মতো বারবার কত টাকা কাটা যেতে পারে, অনুমান করার চেষ্টা করতো।
ওই দিন পরিশ্রান্ত হয়ে একটু দম নেবার জন্য বসেছে, ঠিক সেই সময়েই ইন্সপেক্টর এসে হাজির।
সে শতবার বলেছে, ‘হুজুর, আমি আবার কাজ করবো।’ কিন্তু তিনি কোনো কথাই শোনেননি। তার খাতায় নাম নোট করে নিয়ে গেছে।
কিছুদিন পর আবার একই ঘটনা ঘটেছে। সে দোকান থেকে এক পয়সার মিষ্টি নিমকি কিনে খাচ্ছিল। ঠিক ওই সময় ইন্সপেক্টর কোত্থেকে এসে হাজির হলো আর তার নাম লিখে চলে গেল। কে জানে কোথায় লুকিয়ে থাকে? একটু পান থেকে চুন খসলেই ভূতের মতো এসে হাজির হয়। নাম তো মাত্র দুদিন লিখে নিয়েছে কিন্তু জরিমানা কয়দিনের করে, তা আল্লাহই জানে! আট আনা থেকে বেড়ে এক টাকা না হয়ে যায়।
সে মাথা নিচু করে বেতন আনতে যেত। তার পাওনা বেতন থেকে একটু বেশিই কাটা যেত।
আজকে বেতন দেবার দিন ছিল। এই মাসে তার দুধ পানকারী বাচ্চার কাশি এবং জ¦র ছিল। খুব শীত পড়েছিল। কিছুটা শীতের কারণে আর কিছুটা মেয়ের কান্নাকাটি, চিৎকারের কারণে রাতে বারবার জাগতে হয়েছিল তাকে। ফলে বেশ কয়েকদিনই কাজে আসতে দেরি হয়ে গেছে। ইন্সপেক্টর তার নাম লিখে নিয়ে গেছে। এবার বেতনের অর্ধেক টাকাই কাটা যাবে। অর্ধেক পেলেও ভাগ্য বলে মানবে। কে জানে, কত টাকা কেটেছে?
সে ভোরবেলা বাচ্চাকে কোলে করে ঝাড়ু নিয়ে রাস্তায় এসেছে। কিন্তু দুষ্টু মেয়ে কোল থেকে আর নামেনি। আল্লারাখি মেয়েকে বারবার ইন্সপেক্টর আসার ভয় দেখিয়েছে। বলেছে, ‘এখুনি এসে পড়বে। আমাকে তো মারবেই, তোর নাক-কানও কেটে দেবে।’ মেয়ে নিজের নাক-কান কাটতে রাজি হয়েছে তবু কোল থেকে নামতে রাজি হয়নি। ভয়-ডর দেখিয়ে, ধমক দিয়ে, আদর করে বলেও যখন লাভ হলো না তখন আল্লারাখি তাকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়েছে। মেয়ের কান্নাকাটি-চিৎকার শুনেও মন শক্ত করে ঝাড়ু দিতে শুরু করেছে। তারপরও সেই অভাগিনী এক জায়গায় বসে মন ভরে একটু কাঁদেওনি।
মেয়ে আল্লারাখির পেছন পেছন এসে শাড়ি ধরে টানতে লাগল, পা এসে জড়িয়ে ধরল তারপর মাটিতে শুয়ে পড়ল। আবার উঠে বসে কাঁদতে শুরু করল।
সে ঝাড়ু উঁচিয়ে ধরে বলল, ‘চুপ কর। নইলে ঝাড়ু দিয়ে পেটাবো। জীবন বেরিয়ে যাবে। মরার দারোগা এখুনি এসে পড়বে।’
পুরো কথা মুখ থেকে বেরও হয়নি, এমন সময় ইন্সপেক্টর খয়রাত আলী খান সামনে এসে সাইকেল থেকে নামল। আল্লারাখির রাগ কোথায় উড়ে গেল। বুক ধকধক করতে লাগল।
‘ও আমার খোদা, আবার সে এই কথা শুনে ফেলেনি তো! আমার চোখ কানা হয়ে গেছে। সামনে দিয়েই তো এলো। অথচ আমি দেখতেও পেলাম না। কে জানে, সে আজকে সাইকেলে করে আসবে? প্রতিদিন তো এক্কায় (এক ঘোড়ায় টানা গাড়ি) করে আসে।’ শরীরের রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেল। ঝাড়ু হাতে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল।
ইন্সপেক্টর ধমক দিয়ে বলল, ‘কাজ করতে বাচ্চা নিয়ে এসেছিস কেন? ওকে বাড়িতে রেখে আসতে পারলি না?
আল্লারাখি ভয়ে ভয়ে বলল, ‘হুজুর, ওর শরীর ভালো নেই। বাড়িতে কার কাছে রেখে আসবো?’
‘ওর কী হয়েছে?’
‘জ¦র এসেছে, হুজুর!’
‘আর তুই ওকে কোল থেকে নামিয়ে কাঁদাচ্ছিস। মরবি না কি যাবি?’
‘হুজুর, কোলে নিয়ে কিভাবে কাজ করব?’
‘ছুটি নিচ্ছিস না কেন?’
‘বেতন কাটা পড়বে, হুজুর। দিন যাবে কিভাবে তাহলে?’
‘ওকে কোলে নে। আর বাড়ি ফিরে যা। হোসেনী ফিরে এলে এখানে ঝাড়ু দেওয়ার জন্য পাঠিয়ে দিস।’
আল্লারাখি মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে ফিরে আসছিল। এমন সময় ইন্সপেক্টর জিজ্ঞেস করল, ‘আমাকে গালি দিচ্ছিলি কেন?’
এই কথা শুনে আল্লারাখির জীবন বেরিয়ে গেল। এখন কাটলেও কোনো রক্ত বেরুবে না শরীর থেকে। কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘না হুজুর, আমার চোখ কানা হয়ে যাবে, যদি তোমাকে গালি দেই।’
বলেই সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
॥ দুই ॥
সন্ধ্যার সময় হোসেনী আর আল্লারাখি দুজনেই বেতন আনতে চললো। আল্লারাখি অনেক উদাসী ছিল। হোসেনী তাকে সান্ত¡না দিয়ে বলল, ‘তুই এতো উদাসী কেন? বেতন থেকে জরিমান কাটবে না। দেখিস। তোর কসম কেটে বলছি, যদি কাটে তো আর কখনো মদ বা তাড়িও খাবো না। এক চুমুকও না।’
‘আমি ভয় পাচ্ছি বরখাস্ত না করে দেয়। আমার জিভ খসে পড়ুক। কী থেকে কী...’
‘বরখাস্ত করে দিলে দেবে। আল্লাহ তার ভালো করুক। এজন্য আর কত কাঁদবি!
‘তুমি আমাকে শুধু শুধু নিয়ে যাচ্ছো। সবাই হাসবে।’
‘বরখাস্ত করলে কি জিজ্ঞেস করবো না, কেন বরখাস্ত করলো? গালি দিতে কেউ শুনেছে? কেউ শোনেনি, অথচ যাকে খুশি বরখাস্ত করে দিচ্ছে, এটা কী ধরনের অন্যায়! কেউ যদি না শোনে তাহলে পঞ্চায়েতে অভিযোগ করব। প্রয়োজনে চৌধুরীর দরোজায় মাথা ঠুকে মরব।’
‘এমন একতা যদি থাকতোই, তাহলে কি দারোগা এত জরিমানা করতে পারতো?’
‘আরে পাগলী, রোগ যত বড় হয়, ওষুধ তার চেয়েও বড় হয়।’
তারপরেও আল্লারাখির মন শান্ত হলো না। মুখের ওপর বিষাদের ছায়া লেগেই রইল। ইন্সপেক্টর গালি শুনেও কেন বিগড়ে যায়নি, কেন সঙ্গে সঙ্গেই তাকে বরখাস্ত করে দিল না, এটাই সে বুঝতে পারছে না। বরং ইন্সপেক্টরকে কিছুটা দয়ালু মনে হয়েছিল। এই রহস্যও সে বুঝতে পারছে না। আর যে বিষয়টা আমরা বুঝতে পারি না, সেটাকেই আমরা ভীষণ ভয় করি। শুধু জরিমানা করার ইচ্ছে যদি হতো, তাহলে খাতায় তার নাম লিখে নিত। তাকে নিশ্চয় কাজ থেকে বের করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই জন্যই হয়তো কিছুটা দয়া দেখিয়েছে।
সে শুনেছে, যার ফাঁসির হুকুম হয়ে যায়, শেষ সময় তাকে মনের স্বাদ মিটিয়ে খেতে দেওয়া হয়। সে যার সঙ্গে দেখা করতে চায়, তার সঙ্গেই দেখা করার সুযোগ দেওয়া হয়। নিশ্চয় বরখাস্ত করবে। নিশ্চয়।
তারা মিউনিসিপ্যালিটির দপ্তরের সামনে এসে পড়েছে। ইতোমধ্যে অনেক ঝাড়ুদার এসে জমা হয়েছে। রং-বেরঙের কাপড় পরে। সেজেগুজে। পান-সিগারেটওয়ালাও চলে এসেছে। পাঠানদের একটি দলও এসে হাজির হয়েছে ধারের টাকা আদায় করার জন্য। তারা দুজনেও এসে দাঁড়াল।
বেতন দেওয়া শুরু হলো। প্রথমে মহিলাদের ডাকা হলো।
যার নাম ডাকা হতো, সে দৌড়ে গিয়ে হাজির হতো এবং টাকা নিয়ে ইন্সপেক্টরের জন্য দোয়া করতে করতে চলে আসতো।
চম্পার পরে সব সময় আল্লারাখির নাম ডাকা হতো। আজ আল্লারাখির নাম ডাকা হলো না। চম্পার পরে জহুরার নাম ডাকা হলো। আল্লারাখির নিচে ছিল তার নাম।
আল্লারাখি হতাশ চোখে হোসেনীর দিকে তাকালো। মেথরানীরা এটা দেখে কানাঘুষা শুরু করে দিল। আল্লারাখির মনে হলো বাড়ি ফিরে আসে। এই উপহাস আর সহ্য হচ্ছে না। যদি মাটি দুই ভাগ হয়ে যেত, তাহলে সে ওখানে ঢুকে পড়তো।
একের পর এক নাম ডাকা হতে লাগল।
আল্লারাখি সামনের গাছের দিকে তাকিয়ে রইল। কার নাম ডাকা হচ্ছে, কে যাচ্ছে, কে তার দিকে তাকাচ্ছে, কে তাকে দেখে হাসছেÑ এ নিয়ে তার আর কোনো মাথা ব্যথা নেই।
হঠাৎ তার নাম শুনে সে চমকে উঠলো।
আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো। নতুন বউয়ের মতো পা ফেলে এগিয়ে গেল। খাজাঞ্চি তার হাতে ছয় টাকা তুলে দিল।
খুব অবাক হলো সে। খাজাঞ্চির কোনো ভুল হচ্ছে না তো? এত বছর ধরে কখনো পুরো বেতন পায়নি। আর আজকে যদি অর্ধেক বেতনও পেতো, তাহলে সেটাকে ভাগ্য বলেই মানতো। সে ওখানে এক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে রইল। যদি খাজাঞ্চি টাকা ফিরে চায়।
যখন খাজাঞ্চি বলল, ‘এখনো দাঁড়িয়ে আছিস, যাচ্ছিস না কেন?’
তখন সে বলল, ‘এখানে তো পুরো বেতনই রয়েছে।’
খাজাঞ্চি অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো।
বলল, ‘তাহলে আর কী চাস, কম হয়েছে?’
‘কোনো জরিমানা নেই?’
‘না, এবার কোনো জরিমানা করা হয়নি।’
আল্লারাখি চলে এলো। কিন্তু তার মন প্রসন্ন হলো না। ইন্সপেক্টরকে অকারণে গালি দেওয়ার জন্য তার মন পুড়তে লাগল।