ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

গল্প ॥ নিখোঁজ পাণ্ডুলিপি

আহমেদ আব্বাস

প্রকাশিত: ২২:১৩, ১৮ এপ্রিল ২০২৪; আপডেট: ২২:১৬, ১৮ এপ্রিল ২০২৪

গল্প ॥ নিখোঁজ পাণ্ডুলিপি

নিখোঁজ পাণ্ডুলিপি

শ্রাবণের এক নিঃশেষিত বিষণ্ণ দুপুর। চারদিকে যেন গুমোট, ভ্যাপসা এক নিদাঘ উষ্ণতা ছড়িয়ে আছে। কিন্তু কোথাও রোদের প্রদীপ্ত দ্যুতি নেই কিংবা বৃষ্টিবিন্দুর ছিটেফোঁটা। এক অনুজ্জ্বল আলোয় ছায়াময় বাতাবরণ। আর গাছের পাতারাও অনড়, নিতান্ত নিঝুম, নিশ্চল। মনে হয় ক্রোধে একেবারে স্থাণু হয়ে আছে, ধর্মঘটি যানবাহনের মতো। মাঝে মাঝে দু’একটা বাস ট্রাক ছুটে চলে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা দিয়ে মেহেরপুর থেকে কুষ্টিয়ার দিকে।

আর আমি বিমুগ্ধ চোখে মার ক্লান্তিহীন শ্রমে তৈরি ফুলবাগানের দিকে চেয়ে থাকি। বেগুনি ছোঁয়া গোলাপি রঙে নিজকে সাজিয়ে রঙ্গন গাছটি পথচারীদের মনোযোগ হরণ করতে চাইছে। আর মাধবিলতা বাসায় প্রবেশপথের দুপাশে বেপরোয়াভাবে ছেয়ে গেছে, যাতে গেট দিয়ে ঢুকতে সবার মাথা নুইয়ে তাকে অভিবাদন জানাতে হয়। মাথা নিচু করেই আগত উত্তুঙ্গ লোকটিকে ডোরবেলে হাত রাখতে হয়। আঙুলের চাপে ঘণ্টাধ্বনি বেজে উঠলে পেয়ারা গাছের নিষণ্ণ কাক দুটি কা-কা শব্দে উড়ে পালায়।

দরজা খুলে ড্রয়িংরুমে তাকে বসতে দিই। আমি একটু আধটু বাংলায় লেখালেখি করি জেনে খবর নিয়ে তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। আশির দশকের গ্র্যাজুয়েট সনেট আলি। ছোট সীমান্ত জেলা শহরটির একটি সরকারি ব্যাংকে মুনশিগিরির কাজ করেন। আর একটু সময় পেলে সবকিছু ভুলে অতি মনোযোগ দিয়ে কবিতা লেখেন। এক ব্যাংক ম্যানেজারের বিদায় বেলায় তার উদ্দেশ্যে সনেটের ন্যায় একটি ১৪ লাইনের প্রশস্তিমূলক কবিতা লিখে পাঠ করেন। বিদায়ী ব্যাংকার প্রসঙ্গক্রমে বলেন, ‘সাবিত সাহেব একজন অসাধারণ সনেটিয়ার।’ 
নবাগত উত্তরসূরি যোগদানের পর থেকেই তাকে সনেট সাহেব বলেই সন্বোধন করতেন। কাল পরিক্রমায় কারও কারও কাছে সেটা হয়ে ওঠে সনেট আলি। তারপর থেকে কবিতা লেখার যুক্তিতে সাবিত আলি নামটা অনেকটা আড়ালে পড়ে এখন সারা শহরময় সনেট সাহেব কিংবা সনেট আলি। ভদ্রলোক কিছুটা ক্ষীণকায় হলেও বেশ দীর্ঘাকার, চোখদুটো কোটরাগত হলেও তাতে বাজপাখির ন্যায় শ্যেনদৃষ্টি। বয়স তার পঞ্চাশের কোটায়। মার্কেটে কিংবা সভ্যসমাজে মেশার জন্য বাইরে বেরোলেই তার পায়ে থাকে ক্যাম্বিসের জুতো।
কবি হিসেবে তিনি এলাকায় ব্যাপক পরিচিত। এবং এই বয়সেও ফেসবুকে কবিতা লিখে বিপুল সমাদৃত। প্রায়শ তিনি দিনের সেরা কবি হিসেবে ফেসবুকে রঙিন ক্রেস্টের ইমেজ গ্রহণ করেন। কখনো কখনো তিনি একইভাবে সপ্তাহ কিংবা মাসের সেরা কবি নির্বাচিত হন। আবার তিনি প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারত থেকেও মাঝেমধ্যে পুরস্কার নিয়ে আসেন। ফেসবুকে তার কবিতার সাত হাজার ফলোয়ার রয়েেেছ। যে কোনো কবিতা ফেসবুকে পোস্ট করামাত্র লাইক আর ভিউ হুরহুর করে বেড়ে যায়।
দমবন্ধ গরমে ফ্যানের বাতাসও ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে। ঘর্মাক্ত না হলেও শরীর অস্বস্তিতে অবসন্ন হয়ে পড়ে। তবু সনেট আলি সাহেবকে সাদরে সম্ভাষণ জানাই। অল্প কিছুক্ষণের ভেতরেই গৃহকর্মী কিছু জলখাবার ও ঠান্ডা জুস পরিবেশন করে। দুজনের আলাপচারিতায় তার কবিতার বিষয়বস্তু উঠে আসে। তার কাছে স্বরচিত কবিতা শুনতে চাইলে আগ্রহ নিয়ে একে একে বিভিন্ন কবিতার অংশবিশেষ শোনাতে থাকেন।

ক। ‘মোদের বাড়ির পাশে নানা রকম ঘর/থাকি সেথা মোরা সব আপন পর।...খ। নদীপানে চাহিয়া ধরিতেছিলাম মাছ/শুনতেছি হাহাকার, কলরব কাহারও যেন সর্বনাশ।’ এভাবে অনুরূপ পাঁচটা কবিতা পাঠ করলে আমি তাকে ক্ষান্ত হতে বলি। ‘ঠিক আছে, ভেরি গুড, সাবাশ!’ বলে তাকে প্রশংসা করি।’ এতে তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

লেখা কবিতাগুলো আসলে কবিতা কিনা জানা নেই, তবে গুরুচ-ালি ভাষায় প্যারোডিতুল্য অনুকরণকৃত ছড়া বলা যেতে পারে। প্রায় সবসময় সকলস্থানে কবিতার বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনার কারণে এলাকার উৎসাহী লোকজন মজা করে তাকে সনেট হিসেবে পরিচিত করে তোলে। কবি জীবনানন্দ দাশ তার ‘কবিতার কথা’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি; কেননা তাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভেতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা রয়েছে।’ 
আমার কাছ থেকে আরো স্তুতিবাক্য শোনার জন্য সনেট আলির শ্রবণেন্দ্রিয় উৎকর্ণ হয়ে ওঠে। তার এই আগ্রহের প্রতি সম্মান রেখে কদিন পূর্বে শ্রুত একটি প্রসঙ্গে সরাসরি তাকে জিজ্ঞেস করি, ‘শুনলাম আপনার কবিতার পা-ুলিপি নাকি বাংলা একাডেমি পাঠাচ্ছেন?’
‘এক শুভাকাক্সক্ষীর পরামর্শে পা-ুলিপি বাংলা একাডেমি পাঠানোর জন্যে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ডিসি অফিসে জমা দিয়েছি এবং তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। উনি সাহিত্যানুরাগী মানুষ, পড়ে পছন্দ হলে বাংলা একাডেমি পাঠিয়ে দেবেন। 
তিনি বলেন, ‘একাডেমি প্রকাশের জন্য নির্বাচন করলে চারণকবি হিসেবে আপনার নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে।’ 
‘পা-ুলিপি কি হাতে লিখে দিয়েছেন?’
‘কবিতার বই দুটো কম্পিউটরে টাইপ করে জমা দিয়েছি। তিন হাজার টাকা খরচ করে বাইরে থেকে টাইপের কাজ শেষ করেছি। আমার দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন বই একবার ছাপা হলে আর আমাকে কেউ উপহাস করতে পারবে না বরং প্রশংসা করবে।’ 
‘আপনি কি জানেন, এ বছর মানে ২০১৯ সালে কবিতায় কে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছে?’
‘আদার ব্যাপারি হয়ে জাহাজের খবর রেখে লাভ কী!’ 
এবার সৌজন্যের বালাই না রেখে জেরা করার ন্যায় আবার বলি। তার স্বরচিত কবিতা শ্রবণই আমাকে এমন প্রশ্ন করতে প্ররোচিত করে। ‘আপনি কি কবি মাকিদ হায়দারের নাম শুনেছেন?’ 
তিনিই এ বছর কবিতায় বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন। তারা তো চারভাই খ্যাতিবান কবি এবং অপর ভাই রশীদ হায়দার শক্তিমান লেখক।’ না থেমেই অবিরামভাবে তাকে প্রশ্ন করি।
‘আপনি কি কবি নির্মলেন্দু গুন কিংবা কবি ফজল শাহাবুদ্দিনের কোনো কবিতা পড়েছেন?’ 
‘কবি বলতে আমরা সাধারণত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল, জসীমউদ্দীন, বন্দে আলী মিয়া এদেরকেই বুঝি।’
তার অধিকাংশ কবিতাই জ্যেষ্ঠ কবিদের কবিতা অনুকরণ বা অনুসরণ করে রচিত। তিনি কবিতা লেখেন অতি সেকেলে, অপ্রচলিত এবং লুপ্তধারায়। সেটা যদি ঈশ^রগুপ্ত বা নবীনচন্দ্র সেনের ধারায় লিখতেন, তবুও কথা ছিল। তার অধিকাংশ কবিতার সারবস্তু সমকালীন বিষয়, পদস্থ কর্মকর্তা এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের গুণকীর্তন। সনেট আলি মুখে মুখেই ছন্দমিল দিয়ে পদ্য লিখে ফেলতে পারেন। তার কাছে ছন্দবিহীন কবিতা চুনবিহীন পানের ন্যায়। তিনি বহু রাত নির্ঘুম থেকে অধিকাংশ কবিতা রচনা করেছেন।

এই কবিতা লিখতে গিয়েই তিনি সংসার-সন্তানের প্রতি উদাসীন, অমনোযোগী এবং নির্লিপ্ত থেকেছেন। যেন বৈরাগ্যসাধনে ব্যস্ত, নিবিষ্ট এক সাধক। কবিতা তার যেমনই হোক, যেভাবেই লিখুক- সরলতার কারণে লোক হিসেবে তাকে আমার পছন্দ হয়ে যায়।  
ছ’মাস পর শীতকালে রসপিঠা রসনার জন্যে বাড়ি গেছি। পরদিন অপ্রত্যাশিতভাবে একজন মহিলা আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে। একহারা গঠন, অপুষ্ট এবং শীর্ণকায় বলে আগন্তুক মহিলাটির বয়স ঠাহর করা মুশকিল। ৩৫ বছর বললেও মেনে নেওয়া যায় আবার ৪৫ জানান দিলেও মনে দ্বিধা থাকে না। পোশাকে আভিজাত্যের ছাপ অনুপস্থিত থাকলেও আচ্ছাদনে কোনো কমতি নেই। আপাদমস্তক প্রায় অপ্রকািশত। অবগুণ্ঠনবতী এবার আমার উদ্দেশ্যে বলতে থাকেন, ‘ভাই আমি ব্যাংক কেরানি সাবিত আলির পরিবার। ওই যে কবিতা লেখে, আপনার বন্ধুমতো।’
‘জি ভাবি, ঠিক মনে আছে, সবাই তো এখন তাকে সনেট হিসেবে চেনে।’
‘জি ভাই, আপনি ঠিক মনে রেখেছেন।’
‘তার সরলতা আমার ভালো লেগেছে।’
’তার উদাসীনতাই তো আমাদের ডোবালো।’ তারপর তিনি তার পারিবারিক কায়ক্লেশ, দুর্দশা, অপ্রতুলতা অনটনের কথাগুলো ক্ষোভ নিয়ে ব্যক্ত করতে থাকেন।
‘দেখুন ভাই, তার কাঁধের ওপর বিরাট সংসারের গুরুদায়িত্ব। আমার চার চারটে ছেলেপিলে। তার ওপর শাশুড়ি বেঁচে আছেন। এই চাকরি ছাড়া তার আয়ের আর কোনো পথ নেই। এই দুর্মূল্যের বাজারে সামান্য বিশ-পঁচিশ হাজার টাকায় কী হয়! কীভাবে সংসার চালাই।

শাশুড়ি বৃদ্ধ মানুষ, তাকে মাঝেমধ্যে ভালোমন্দ খাওয়ানো দরকার। বড় ছেলেটার প্রতি খেয়াল রাখতে পারিনি বলে সে একেবারে বখে গেছে। ছোট ছেলেটা নাইনে পড়ে, তাকে টিউশনি দিতে পারিনি। তবুও সে ভালোভাবে পাশ করে। তারপর একটা মেয়ে সেভেনে আর সবশেষ ছেলেটা থ্রিতে।
ছয় সাতটা পোষ্য। এখন আপনিই বলেন, কীভাবে সংসার চলে!’    
‘আমি আপনার জন্যে কী করতে পারি?’
‘আপনি তাকে বুঝাবেন, যাতে সে ঘরমুখো হয়, সংসারের দিকে খেয়াল রাখে, কবিতার চিন্তা মাথায় থেকে দূর করে  যেন বাড়তি আয়ের চিন্তা করে। একেবারে মফস্বল হলেও এটা জেলা শহর, এখানে টিউশনি করে অনেকেই অনেক টাকা (এরপর ১৩ পৃষ্ঠায়)  
উপার্জন করে। আপনার কথা সে শুনবে, আমার কাছে আপনার প্রশংসা করে।’
‘তার কবিতা আশপাশের অনেকেই তো পছন্দ করে।’
‘শুধু ফেসবুকের লোকেরাই বেশি পছন্দ করে আর যাকে নিয়ে লেখে সে পিঠ চাপড়ে দেয়। সবচেয়ে বড় কথা তার একটি কবিতাও কোনো জাতীয় পেপার-পত্রিকায় ছাপা হয়নি।’
‘এখন বলেন, আপনার বড় ছেলে কী করে?’
‘তা আর বলবেন না ভাই, পেটে ধরলেও মনের দুঃখে ক্ষোভে বলতে হচ্ছে, তার তো অনেক বদনাম। মেট্রিক ফেল করার পর আর টাকা জোগাড় করতে পারিনি, পরীক্ষা দিতে পারেনি। সামনে পরীক্ষার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে। এখন নাকি তার বাবার (ইয়াবা) নেশা। জেলার এক বড় সাহেবের ছেলেও নাকি একইরকম। তার ইয়ার। কিছুদিন আগে সন্ধ্যার দিকে সুযোগ বুঝে দুজন পাইলট স্কুলের একটা কম্পিউটর চুরি করে বিক্রি করে দিয়েছিল, পরে স্কুল জানতে পারলেও বড় সাহেবের ছেলে সঙ্গে থাকায় কিছু হয়নি। বড় সাহেব স্কুলে একটা নতুন কম্পিউটর কিনে দেয়।’
‘ঠিক আছে ভাবি, আমি যতদূর পারি, যেভাবে পারি বুঝিয়ে বলব। শুধু কবিতা লিখলেই হবে না, পরিবারের দিকেও নজর রাখতে হবে। সবকিছু ম্যানেজ করে যে লিখতে পারে, সে-ই কবি।’ 
তারপরও বলতে থাকে, ‘আপনি ভালো করে বুঝাবেন, আপনার কথায় গুরুত্ব দেবে।’
‘ভাবি, এ বিষয়ে আপনি চিন্তা করবেন না। আমি তাকে বুঝানোর দায়িত্ব নিলাম, আপনি নিশ্চিন্ত মনে বাসায় যান।’
এক শীতবিকেলে গড়পকুর মাঠে সনেট আলিকে ডেকে নিই। প্রথমে তাকে উৎসাহ দিয়ে তার আবৃত্তি শুনি, কবিতার গুণগান করি। তারপর ক্রমশ বিভিন্ন কবিদের বিষয় নিয়ে আসি। আমি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, সমর সেনের কবিতার প্রসঙ্গ নিয়ে আসি। বলি ‘তারা তিরিশের কবি, তাদের জন্ম ১৯০১ থেকে ১৯১৬ সালের মাঝে। তারা কী ধরনের কবিতা লিখেছেন, আর আপনি কী লিখছেন?

তাদের জন্ম আপনার জন্মের অর্ধশতাব্দীরও অধিককাল আগে। কাজেই আপনার লেখা তাদের চাইতে আরও আধুনিক হওয়া উচিত। অথচ আপনি এখনো লেখেন অপ্রচলিত পদ্ধতিতে, ভুল বানানে এবং যাচ্ছেতাই ধ্যান-ধারণায়। তিরিশের ওই পঞ্চকবিই বাংলা কবিতার বাঁক এবং রীতি পরিবর্তনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। আপনি তাদের কবিতা পড়ুন, তাহলে কবিতা সম্পর্কে আরও ভালো জানতে পারবেন।

প্রশংসার পরিবর্তে এমন উপদেশ শুনে সনেট আলি অপ্রস্তত, অপ্রতিভ এবং হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। চেহারায় চিন্তার ছাপ পরিস্ফুট হয়। তখন তাকে বিমূঢ়, বিহ্বল এবং বিভ্রান্ত বলে প্রতীয়মান হয়। মনে হলো প্রয়োজনীয় উপদেশ দেওয়ার এখনি যথাযথ সময়, এ মুহূর্তে কিছু বললে তার বোধোদয় হবে। এ বিশ্বাসে আস্থা রেখে বলতে থাকি, কবিদেরও সংসার আছে, সন্তান আছে, সমাজ আছে, সবকিছুর সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে চলতে পারলেই জীবন নিয়মমাফিক হয়। স্বচ্ছন্দ, সহজসাধ্য ও শান্তিপূর্ণ হয়। এমন নয় যে, কাব্যচর্চা করতে গিয়ে সন্তান অস্থিরমতি, বিপথগামী হয়। স্ত্রী পরিজন নিঃসঙ্গ, নির্মক্ষিক বোধ করে।’
সনেট আলি বলেন, ‘কবিতা মাথায় এসে ভর করলে কোনোকিছু খেয়াল থাকে না।’
‘সবকিছুর প্রতিই আপনাকে মনোযোগ রাখতে হবে। আর তিরিশের কবিদের কবিতা মাথায় রেখে সমকালীন কবিদের কবিতা আপনাকে বারবার পড়তে হবে। জানতে হবে সাম্প্রতিক কবিতার প্রকৃতি, ধরণ এবং বৈশিষ্ট্য। সবকিছুর ওপরে পরিবার পরিজন।

সন্তান মানুষ করতে হবে, স্ত্রীকে সময় দিতে হবে, তারপর কবিতার জন্যে অবকাশ।’
‘কবিতার জন্য আমি কত বিনিদ্র রাত পার করেছি। তারই ফল দুটি কাব্যগ্রন্থ। আর কবিতার বাইরে আজ আপনার জাগতিক ও পারিবারিক বিষয় সম্পর্কিত কথাগুলো আমার দিব্যচক্ষু কিছুটা হলেও খুলে দিয়েছে।’
‘রাইট আপনার সেই পা-ুলিপির খবর কী?’
‘ডিসি সাহেব বদলি হয়ে চলে যাবেন শুনে সেখানে গিয়ে একদিন দুই ঘণ্টা অপেক্ষার পর সিরিয়াল পাই।’
‘সাবিত সাহেব সরি, ভেরি সরি। কাজের চাপে আপনার পা-ুলিপিটা পড়ে দেখতে পারিনি।’
আক্ষেপের সুরে সান্ত¡না দিতে থাকেন। তারপর বলেন, ‘আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আমার নাজিরের কাছে ওটা আছে, নতুন রিলিভার উপযুক্ত মনে করলে অবশ্যই পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন। আমি তাকে বলে যাব।’
বিমোচক জেলা প্রশাসক আগমনের পর সনেট আলি একদিন জেলা পরিষদ অফিসে যান এবং ডিসির নাজিরকে তার পা-ুলিপি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। ‘ভাই নাজির সাহেব, আমার পা-ুলিপির খবর কী?’
কিছুক্ষণ কাঁচুমাচু করে অপরিজ্ঞাতের ন্যায় চেহারায় কিছুটা হতাশা এনে বিষাদকণ্ঠে নাজির সাহেব জানায়, ‘আগের স্যার বদলি যাবার সময়ে ওই ব্যাপারে আমাকে বলে যান, এজন্যে কদিন ধরেই আপনার পান্ডুলিপিটা খুঁজছি।’

×