ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০২ জুন ২০২৩, ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০

সফল পঞ্চাশ

মাহমুদ কামাল

প্রকাশিত: ০০:৩০, ২৬ মে ২০২৩; আপডেট: ০০:৩১, ২৬ মে ২০২৩

সফল পঞ্চাশ

.

সম্ভবত ১৯৮৬ কি সাতাশি সাল। তখন এবং তারও আগে থেকেই আমাদের এই নিস্তরঙ্গ টাঙ্গাইল শহরে বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে কবিতা আবৃত্তি, বিতর্ক ও উপস্থিত বক্তৃতার আয়োজন হতো। তখন থেকে সাধারণ গ্রন্থাগারের উদ্যোগে প্রায় বছরই বইমেলার আয়োজন করা হয়েছে। বইমেলাতেও থাকত এ রকম প্রতিযোগিতা। এমনি একটি দিবসে গ্রন্থাগার আয়োজন করে কবিতা আবৃত্তি প্রতিযোগিতা। সেই অনুষ্ঠানে আমার সঙ্গে বিচারক ছিলেন কবি শ্যামল সেন। অনুষ্ঠানে ছিপছিপে শ্যামলা মতো সাদা প্যান্ট-শার্ট পরা লম্বাটে এক ছেলে আবৃত্তিতে অংশ নেয়।

জানতে পারি তার নাম মাহবুবুর রহমান। ডাক নাম বিপ্লব। সরকারি বিন্দুবাসিনী স্কুলের ছাত্র। মাহবুব আবৃত্তি করছিল কবি হেলাল হাফিজের বিখ্যাত ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতাটি। কিন্তু উচ্চারণে বারবার ‘যৌবন’ শব্দটি ভুল হওয়ায় শ্যামল সেন তাকে সঠিক উচ্চারণের দিকনির্দেশ দিচ্ছিলেন। সেদিন মাহবুব পুরস্কার না পেলেও পরবর্তীতে দেশসেরা বিতার্কিক হতে পেরেছিল। সেই মাহবুবুর রহমান এখন খান মাহবুব নামে বিখ্যাত। সম্বোধন তুমি থেকে আপনি। তো, প্রাথমিক স্মৃতি এখানেই শেষ নয়। কে জানত বয়সে চৌদ্দ বছরের ছোট খান মাহবুবের সঙ্গে পরবর্তীতে আমার আত্মার সম্পর্ক হবে।

সেই স্কুলের ছাত্রের সঙ্গে দীর্ঘদিন দেখা নেই। আমার একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল শহরের পুরনো বাসস্ট্যাডের পৌর মার্কেটে। মাঝে মধ্যেই সেখানে বসি। মাহবুবুর রহমানকে ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি স্মৃতিকে উসকে দিয়ে একদিন দোকানে এসে হাজির। স্কুলপড়ুয়া মাহবুবুর রহমান ১৯৯৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে মাস্টার্স করে চাকরিতে না গিয়ে শাহবাগের আজিজ মার্কেটে প্রকাশনা ব্যবসা শুরু করেছেন। নাম পলল প্রকাশনী। সময় তার নিজস্ব গতিতে চললেও অবাক হয়ে যাই তাকে দেখে। একটি ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বললেন, আপনার মাধ্যমেতো অনেক ছাপার কাজ হয়। কাজ-টাজ থাকলে দেবেন। দেখলাম কার্ডে নাম লেখা, খান মাহবুব। আমার দোকানটি ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কের পাশে হওয়ায় খান মাহবুব ঢাকা যেতে-আসতে প্রায়ই সেখানে আসতেন। আমার আর পলল প্রকাশনীতে যাওয়া হয় না। এর প্রধান কারণ মুদ্রণসংক্রান্ত সব কাজই কবি আবিদ আজাদের শিল্পতরু প্রকাশনীর প্রেস থেকেই করে আসছি ১৯৯১ সাল থেকে। শিল্পতরুকে অনেকেই ঠাট্টা করে বলত শুল্কতরু। কিন্তু আবিদ ভাই নিজ উদ্যোগে তিনটি সম্পাদনাসহ আমার নয়টি বই বের করেছেন। স্বভাবতই তার সঙ্গে সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর। এ জেলা থেকে বিভিন্ন দিবসের স্মরণিকার কাজ আমার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হতো। ছুটে যেতাম শিল্পতরু প্রেসে। আবিদ ভাইয়ের একটু অসহিষ্ণুতার জন্য ছাপাসংক্রান্ত সম্পর্ক একদিন ভেঙে যায়।

১৯৯৮ সালে টাঙ্গাইল বনবিভাগ স্মরণিকা সম্পাদনার দায়িত্ব দেয় বিশিষ্ট লেখক ও প্রখ্যাত আইনজীবী কামাক্ষানাথ সেন ও আমাকে। যথারীতি আমরা কবি আবিদ আজাদের স্মরণাপন্ন হই। শিল্পতরু তখন কাঁঠালবাগানের ঢাল থেকে তার বাড়ির কাছে মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডে স্থানান্তর হয়েছে। আবিদ ভাই সম্ভবত ওই দিন অসুস্থ ছিলেন। মধুর সম্পর্কের বন্ধনটি সাময়িকভাবে ওই দিন ছিন্ন হয়ে যায়। তিনি খুব অসহিষ্ণু আচরণ করলেন ছাপা ও কাগজের অস্বাভাবিক মূল্য নিয়ে। দাম-দরসংক্রান্ত বিষয়ে  ইতিপূর্বে তার সঙ্গে দু’কথা হয়নি। আমাদেরও অভিমান হলো। সত্তর দশকের কবি আবিদ আজাদকে তখন এবং এখনো প্রধান কবি হিসেবে জ্ঞান করি। বিনা খরচে তিনি আমার বই বের করেছেন। ঋণের কোনো শেষ নেই। পরবর্তীতে ছাপার কাজ না হোক মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অটুট ছিল।

এখন কোথায় যাই! পরিচিত ছাড়া কোনো কাজের আনন্দ যেমন নেই, নিশ্চয়তাও নেই। মনে পড়ে গেল খান মাহবুবের কথা। চলে আসি আজিজ মার্কেটে। মাহবুব আমাদের খুব সমাদর করলেন। তার বাবা মোশারফ হোসেন টাঙ্গাইলের স্বনামধন্য আইনজীবী। কামাক্ষা দাও আইনজীবী হিসেবে জনপ্রিয়। মাহবুব আমাদের দুপুরের খাবারের আপ্যায়ন করলেন। বলা বাহুল্য খুব কম খরচে খান মাহবুব আমাদের স্মরণিকাটি ছেপে দেন। সেই যে সম্পর্কের শুরু পরবর্তীতে নানা পর্যায়ে আমাদের আত্মীয়তা গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে ।

খান মাহবুবের ‘পলল’ থেকে আমার বেশ কিছু বই প্রকাশিত হয়েছে। এই সুযোগে সেগুলো এখানে তুলে ধরি। ১. চলমান রাজনীতি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ (প্রবন্ধ ) ২. বালক বয়সে (কবিতা ) ৩. টাঙ্গাইলের বারো মনীষী (সম্পাদনা ) ৪. কামাক্ষানাথ সেন স্মারক গ্রন্থ (সম্পাদনা ) ৫. টাঙ্গাইলের কবি ও কবিতা ( মোহাম্মদ আবদুল মাননানের সঙ্গে যৌথ সম্পাদনা) ৬. টাঙ্গাইলের গল্পকার : নির্বাচিত গল্প (ওই) ৭. সব্যসাচী আবু কায়সার (্ওই) ৮. আশির দশকের কবিতা (ওই) ৯. বাংলা কবিতা উৎসব-২০১০ (খান মাহবুবের সঙ্গে যৌথ )।

টাঙ্গাইল সাধারণ গ্রন্থাগার এ পর্যন্ত পাঁচবার বাংলাদেশ-ভারত কবিতা উৎসবের আয়োজন করেছে। খান মাহবুব চারটি অনুষ্ঠানে সমন্বয়কের কঠিন দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৬ সালের প্রথম অনুষ্ঠানে প্রকাশনাবিষয়ক সেমিনারে অতিথি হিসেবে বক্তব্য রেখেছেন। এরপর ২০১০, ২০১৫, ২০১৮ এবং ২০২০-এ অনুষ্ঠিত কবিতা উৎসবের সমন্বয়কারী হিসেবে আমাদের অনেক কাজ লাঘব করে দিয়েছেন। এর মধ্যে প্রতিবারই ঢাকা থেকে কবিদের নিয়ে আসা এবং অনুষ্ঠানের প্রতিটি পর্বের সভাপতি/প্রধান অতিথি নির্বাচনে সহায়তাসহ সেই পর্বের কবিদের তালিকা করা- এসব কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করে আমার অনেক পরিশ্রম বাঁচিয়ে দিয়েছেন। এই কাজ করতে গিয়ে উপায়হীনভাবে অনেক সময় তাকে রূঢ় আচরণ করতে হয়েছে। বাংলা কবিতা উৎসব মানেই মাহবুবেরই অনুষ্ঠান।

মাহবুব দু’বার কলকাতার সাহিত্য অনুষ্ঠানের সঙ্গী হয়েছেন। অনুষ্ঠানে তিনি প্রতিবারই প্রাণবন্ত বক্তব্য রেখেছেন। কলকাতা যাতায়াতকালে আমাদের অনেক আনন্দ-বেদনার স্মৃতি আছে। বিশেষ করে ‘বনগাঁ’ ট্রেনের বিষয়টি মনে হলে আমরা দু’জন এখনো আঁতকে উঠি।

টাঙ্গাইল সাহিত্য সংসদ টাঙ্গাইলে জন্মগ্রহণকারী জাতীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত কবি/ লেখকদের ২০০৪ সাল থেকে প্রতিবছর অর্থমূল্যসহ পুরস্কৃত করছে। ...সাল থেকে তরুণ লেখক পুরস্কার চালু হয়। প্রথম বছরেই আমরা তাকে পুরস্কৃত করে এর ধারাবাহিকতা শুরু করেছি। এ ছাড়া মাহবুব সাহিত্য সংসদের বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেছেন।

ঘরে বাইরে সবখানেই তিনি সফল। প্রকাশক সমিতির নেতৃত্বে যেমন লেখক হিসেবেও তেমনি। তার রচনাসমূহ ভিন্নমাত্রিক। ছাত্রজীবনে সাহিত্যনির্ভর কর্মকান্ডে অংশ নিলেও পরিণত বয়সে বিষয়ভিত্তিক লেখার প্রতি মনযোগী হয়েছেন। এগুলো সম্ভব হচ্ছে বিদূষী স্ত্রীর কারণে। তিনি তাকে শান্তিতে রাখেন বলেই তার কমকান্ড বাইরে এতটা সাবলীল। শুধুমাত্র ‘সাহানা’ এই নাম ধারণ করে বর্তমানে মাহবুবের স্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অর্থ বিভাগের যুগ্ম সচিব হিসেবে কর্মরত। দুই মেয়ে নিয়ে তাদের সুখের সংসার।

২০০৭ সালে আমার পঞ্চাশ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে আয়োজন করেছিলেন বহুমাত্রিক লেখক আলম তালুকদার এবং খান মাহবুব। আলম ভাইকে বিশেষভাবে মনে পড়ছে। করোনা তাকে ছিনিয়ে নিয়েছে। এই রসিক মানুষটির সঙ্গে যিনিই মিশেছেন আনন্দলাভ করেছেন তার সঙ্গ। মিল দিয়ে কথা বলতেন। বক্তৃতাও। বক্তব্যের শেষে প্রায়ই বলতেন, ‘কাউকে না দিয়া বাদ, শুধু রাজাকার বাদ, সবাইকে ধন্যবাদ।’ গ্রন্থসংক্রান্ত তার স্লোগান, ‘পড়িলে বই আলোকিত হই/না পড়িলে বই অন্ধকারে রই’ এখন মিথ হয়ে গেছে। অগ্রজ এই প্রিয় বন্ধুটি খান মাহবুবের  সঙ্গে পঞ্চাশ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানটি করেছিলেন। তাদের আহ্বানে কে না এসেছিলেন।  এসবই ঘটেছিল খান মাহবুবের প্রচেষ্টার কারণেই। পরের বছর দু’জনের সম্পাদনায় বের হয় ‘আলোকিত মাহমুদ কামাল’ নামের সংকলনটি।১৪ বছর পর খান মাহবুব পঞ্চাশে পড়লেন। এবার তাকে নিয়েই গ্রন্থপ্রকাশ।