ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সাইকো

শিল্পী নাজনীন 

প্রকাশিত: ২২:৫৫, ৩০ মার্চ ২০২৩

সাইকো

শীতের জবুথবু রাত নেমেছে তখন শহরতলীর প্রতি বাঁকে

শীতের জবুথবু রাত নেমেছে তখন শহরতলীর প্রতি বাঁকে। প্রতিদিনের মতো সেদিনও বাসায় ফিরছি ক্লান্ত পায়ে। মাথায় ঘুরছে সেই আটপৌরে চিন্তা। ফিরেই রান্না করতে হবে। অনুভব অফিস থেকে ফিরবে, সময়মতো টেবিলে খাবার দিতে হবে। জঘন্য একটা ব্যাপার। এত অমিত সম্ভাবনাময় মানবজীবন, তাকে কিনা অপচয় করতে হয় খাওয়া নামক এক তুচ্ছতম কাজের পেছনে! ছি! এর চেয়ে বাজে ব্যাপার আর কিছু হতে পারে না মানুষের জীবনে। প্রতিদিন সকালে উঠেই কি খাব, কী রান্না করব এসব ভাবার মতো বিরক্তিকর কাজ আর হয় না কিছু! দুপুরের খাওয়াটা বরাবর ক্যাম্পাসে সারি আমি।

সকালে নাস্তা করে বেরিয়ে পড়ি। আমি ক্যাম্পাসে, অনুভব অফিসে। দুপুর পর্যন্ত টানা ক্লাস আর থিসিসের ব্যস্ততা থাকে, তাছাড়া একা বাসায় ফিরে করারও কিছু থাকে না তেমন, দমবন্ধ লাগে। কাজ না থাকলেও তাই ক্যাম্পাসে আড্ডা মারি, ডিপার্টমেন্টে সময় কাটাই, লাইব্রেরিতে গিয়ে বই পড়ি। সেদিনও লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়তে পড়তে কখন বিকেল গড়িয়েছে সন্ধ্যার দিকে খেয়াল করিনি। কান্টের দর্শন কখন আমাকে টেনে নিয়েছে অন্য এক ভুবনে, ভোগবাদী এই জীবনের খোলস ছেড়ে কখন মন গিয়ে থিতু হয়েছে ভাববাদী এক মায়ার জগতে সেটা বুঝতে পারিনি একদম। ঘোর কাটল লাইব্রেরিতে কর্মরত ছেলেটার কথায়। লাইব্রেরি ততক্ষণে ফাঁকা।

পড়ুয়ারা চলে গেছে ঢের আগে। আমি গেলেই তালা লাগিয়ে সেও বাসায় ফিরবে সেদিনের মতো।
অগত্যা উঠতে হলো। সেন্ট্রাল ফিল্ডের উল্টোপাশের ফুসকা মামার দোকান থেকে ফুসকা নিলাম হাফপ্লেট। তখনই ঝুপ করে সন্ধ্যা নামল। মাথার ওপর হাজারও অতিথি পাখির ওড়ার দৃশ্য ঝাপসা করে দিয়ে কুয়াশার মিহিন চাদর ছড়িয়ে সে ক্যাম্পাসে নেমে এলো হঠাৎ। শীত শীত অনুভূতিটাকে আমলে না নিয়ে ফুসকার প্লেটটা খালি করলাম আয়েস করে।

সেন্ট্রাল ফিল্ডে তখন ছাত্রদের আড্ডা দারুণ জমে উঠেছে ততক্ষণে, হল্লা ভেসে আসছে কানে। ক্যাম্পাসে নামা এই সন্ধ্যাটা ভীষণ প্রিয় আমার। মাঝে মাঝে অনুভবকে নিয়ে আমি মুক্তমঞ্চের সিঁড়িতে বসে থাকি চুপচাপ। শুনতে চেষ্টা করি আঁধারের তান। অন্ধকারের কি আলাদা কোনো ভাষা থাকে, কোনো তান? আমি অনুভবকে জিজ্ঞেস করি হঠাৎ হঠাৎ। অনুভব চুপ থাকে। কথা বলে না একদম। আমার ধারণা, থাকে, অন্ধকারেরও থাকে আলাদা ভাষা, আলাদা তান।

আমরা যখন মাতৃজঠরের অন্ধকারতম জগতে থাকি, তখন সেই অন্ধকার জগতের সঙ্গে আমাদের তৈরি হয় নিবিড় গাঁটছড়া, প্রগাঢ় বন্ধুত্ব, সেই সঙ্গে তুমুল বৈরিতাও সম্ভবত। সেই অন্ধকার জগতের সুর ও তান, ভাষা ও ব্যঞ্জনা আমরা আমাদের অবচেতন মনে যেমন বয়ে নিয়ে আসি পৃথিবীতে, তেমনি বয়ে নিয়ে আসি প্রগাঢ় এক অন্ধকারভীতিও। তাই অন্ধকারের প্রতি আমাদের একই সঙ্গে থাকে প্রেম ও ভীতির মতো পরস্পরবিরোধী দুটি অনুভূতি। তাই আমরা অন্ধকারের প্রেমে পড়ি, তার তানে ডুবি আবার কখনো হঠাৎ কোনো অন্ধকার দেখে তীব্র ভয়ে শিউরে উঠি।

আমাদের অবচেতন মন মাতৃজঠরের সেই নিকষ অন্ধকারের স্মৃতি ভেবে মস্তিষ্কের কাছে তীব্র ভয়ের অনুভূতি পাঠায় তখন। এসব শুনে অনুভব হাসে। আমাকে পাগল বলে হেসে উড়িয়ে দেয় সে। এসব থাক। কী যেন বলছিলাম? ক্যাম্পাসে সন্ধ্যা নেমেছিল, না? সেই প্রসঙ্গে আসি আবার। দারুণ ঘন সন্ধ্যা নেমেছিল ঝুপ করে। মুক্তমঞ্চের দিক থেকে খালি গলার কোরাস ভেসে আসছিল তখন, তোমার বাড়ির রঙের মেলায় দেখেছিলাম বায়োস্কোপ, বায়োস্কোপের নেশা আমায় ছাড়ে না, বায়োস্কোপের নেশা আমায় ছাড়ে না।
গানটা মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম। সুর, তাল, লয় নয়, গানটায় জীবনের অদ্ভুত ছন্দ ছিল, যা দুলিয়ে দিচ্ছিল শীত-সন্ধ্যার অন্ধকারের সাঁকো, গানটা গাওয়ার মধ্যে তারুণ্যের দারুণ দিপ্তি ছিল, যা কাঁপিয়ে দিচ্ছিল জরাগ্রস্ত সেই শীত শীত বোধ। তারপর মনে হল, ফিরতে হবে এবার। সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ় হয়েছিল ততক্ষণে। শীত নামছিল দ্রুত। ধীরপায়ে গিয়ে বাসে উঠেছিলাম কখন মনে নেই। অভ্যাসবশত কন্ডাকটরের দিকে ভাড়ার একটাকার নোটটা বাড়িয়ে দিয়ে নেমে পড়েছিলাম আনমনে। শহরতলীর পথটা তখন বেশ নির্জন। 
হঠাৎ একটা কণ্ঠ থামিয়ে দিল আমাকে। প্রথমে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম। ভেবেছিলাম অন্য কাউকে ডাকছে। কিন্তু মেয়েটা আমার সামনে এসে গেল তখন, নির্জীব কণ্ঠে বলল, আপা, আমাকে একটু সাহায্য করবেন? বরাবরই বাস্তববুদ্ধি কম আমার। স্বভাবগতভাবেই আমি সরল। মানুষকে বিশ্বাস করে বসি খুব সহজেই। সেজন্য পরে কষ্ট পাই, পস্তাই ভীষণ। কিন্তু মানুষকে যে আদৌ অবিশ্বাস করা যায়, কিংবা করা উচিত, তাৎক্ষণিকভাবে সেই ভাবনাটা আমার মস্তিষ্কে উদয় হয় না কোনোকালেই।

পরে নিজের বোকামিতে নিজেই অবাক হই, শোচনায় দগ্ধি আর পরবর্তীতে এমন বোকামি আর না করার সিদ্ধান্তে দৃঢ় হই। কিন্তু ওই পর্যন্তই। আবার একই ভুল করি, ভুল না করার সিদ্ধান্ত নিই এবং পৌনঃপুনিকভাবে এটা চলতেই থাকে। তো, মেয়েটার দিকে সেই প্রায়ান্ধকার আলোয় যতটা সম্ভব চোখ রেখে, চলা থামিয়ে আচমকা দাঁড়িয়ে যাই আমি। উৎসুক উৎকণ্ঠায় জিজ্ঞ্যেস করি, কী ব্যাপারে?
মেয়েটার কাঁধে ভারি ব্যাগ। বয়স সতেরো আঠারোর বেশি নয়। মলিন মুখ। সম্ভবত সারাদিন তার খাওয়া হয়নি কিছুই। পোশাক-আশাক, চেহারা দেখে মোটামুটি ভদ্রঘরের মেয়ে বলে শনাক্ত করা যায় সহজেই। আমার তীক্ষè দৃষ্টি আর প্রশ্নের ধরনে মেয়েটা অনেকটা কুঁকড়ে যায়। ক্লান্ত, বিষণœ কণ্ঠে বলে, আপা, আজ রাতটা আমাকে আপনার বাসায় থাকতে দেবেন?
কোথা থেকে আসছেন আপনি?
বরিশাল থেকে। একটা চাকরির জন্য পরীক্ষা দিতে এসেছিলাম আপা। এখানে আমার পরিচিত কেউ নেই। রাতটুকু থাকব শুধু। সকালেই চলে যাব আপা। মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে কেন যে ভীষণ মায়া হয় আমার! তাকে অবিশ্বাস করার কথা একবারও মাথায় আসে না। আগুপিছু না ভেবে দ্বিধাহীন বলি, আসুন আমার সঙ্গে।
তালা খুলে বাসায় ঢুকে মেয়েটাকে বসতে দিই ড্রইংরুমে। নিজেও চেঞ্জ করে এসে বসি পাশে। মেয়েটা বলে, আপা, একগ্লাস পানি দেবেন? পানি খাব।
গ্লাসভর্তি পানিটা হাত থেকে প্রায় লুফে নেয় সে। পানিটুকু একচুমুকে শেষ করে দারুণ তৃষ্ণায়। সঙ্গে দেওয়া বিস্কুট ছুঁয়েও দেখে না একবার। ব্যস্ততা নিয়ে আমি বলি, আমাকে এখন রান্না করতে হবে। আপনি বসুন, আমি রান্নাটা শেষ করি। 
বাসায় আর কে থাকে?
আমি আর অনুভব।
আপনার স্বামী?
আমার বর। 
স্বামী শব্দটাকে একফুঁয়ে উড়িয়ে দিয়ে আমি বলি।
তিনি বাসায় নাই এখন?
আছে। আবার নাই। আপনি বসুন। আমি কাজ শেষ করি।
কিচেনে ঢুকে ঝটপট রান্না শুরু করি আমি। মেয়েটা ডাইনিংয়ের চেয়ার টেনে বসে আনমনে আমার কাজ করা দেখে, কিংবা ঝিমোয়। রান্না শেষে আমি টেবিলে খাবার দিয়ে তাকে ডাকতে গিয়ে দেখি চোখ বন্ধ করে সে বসে আছে মূর্তিবৎ। দুচোখ বেয়ে জল নেমেছে অঝোরে। মেয়েটাকে আমার কিছু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে না। কেন যেন মনে হয়, জিজ্ঞেস করাটা উচিত হবে না। কারো ব্যক্তিগত ব্যাপারে কথা বলতে একদম ভালো লাগে না আমার। কারও দুঃখের কাসুন্দি ঘাঁটতে ইচ্ছে করে না একদম। ক্লান্তি আসে। খেতে বসি আমরা। আমি আর মেয়েটা। আমি খাই। মেয়েটা শুধু প্লেটের খাবারটা অন্যমনস্কভাবে নাড়াচাড়া করে। সামান্যই মুখে দেয়। কিংবা দেয় না। 
আপা। ভাত নাড়াচাড়া করতে করতে বলে মেয়েটা।
বলেন।
এখানে আমাকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন?
চাকরি?! অবাক হয়ে মেয়েটার মুখের দিকে তাকাই আমি।
জি আপা। একটা চাকরি পেলে আমি এখানেই কোথাও থাকার একটা জায়গা খুঁজে নেব।
পড়াশোনা কতদূর করেছেন?
এসএসসি পাস করেছি আপা।
এই পড়াশোনায় কী চাকরি হবে? গার্মেন্টসে কাজ করবেন?
করব আপা। মেয়েটার মরিয়া কণ্ঠ।
আচ্ছা। সকাল হোক তাহলে। আমার পরিচিত অনেকে গার্মেন্টসে কাজ করে। ওরা নিশ্চয়ই আপনার একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিতে পারবে।
আপনার স্বামী কখন আসবে?
মেয়েটার আচমকা প্রশ্নে বিরক্তি জাগে খুব। তার ব্যবহার করা ওই শব্দটায় আরও। 
আমার কোনো স্বামী নেই। অনুভব আসবে সময়মতো। আপনি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। 
আমার কণ্ঠের হঠাৎ কাঠিন্যে আর ব্যবহারের রূঢ়তায় মেয়েটা চমকে একবার আমার দিকে তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নেয়। সম্ভবত খানিকটা ভয় পেয়ে যায় সে। কথা বলে না আর। খাওয়া শেষে আমি উঠে পড়ি। মেয়েটাও প্লেটে প্রায় পুরো খাবারটা রেখেই উঠে যায়। পাশের রুমে তার ঘুমানোর জায়গাটা দেখিয়ে দিতেই গিয়ে শুয়ে পড়ে চুপচাপ। লাইট অফ করে আমিও শুয়ে পড়ি আমার রুমে এসে। অনুভব আচমকা বলে ওঠে, তুমি এত বোকা কেন?
কী করলাম আবার?
এই যে মেয়েটাকে চেনো না জানো না বাসায় নিয়ে এলে!
তাতে কী হলো!
মেয়েটা ফ্রড হতে পারে। তোমার বোকামির সুযোগ নিতে পারে।
কী রকম?
মাঝরাতে তোমাকে অচেতন করে রেখে তোমার সব নিয়ে চম্পট দিতে পারে।
হা হা হা। আমার তো তেমন কিছু নেই অনুভব, যা নিয়ে মেয়েটা চম্পট দেবে!
বোকা!
আমি তো বোকা-ই অনুভব। নইলে তুমি কী করে জুটলে আমার সঙ্গে!
অনুভব চুপ হয়ে যায়। আর কোনো কথা বলে না সে। তাকে জড়িয়ে আমিও হয়ত ঘুমিয়েই যেতাম অচিরেই, কিন্তু পাশের ঘর থেকে ভেসে আসা ফোঁপানির শব্দ আমাকে ঘুমোতে দেয় না। আমার চোখ থেকে হঠাৎ ঘুম সরে যায় দূরে। আমাকে নিয়ে যায় বহুকাল আগের এক ছায়া ছায়া বিকেলের খাদে। যে খাদ থেকে ছিটকে পড়ে এক সময় আমি তলিয়ে গেছিলাম জীবনের ভয়ঙ্কর চোরাবালিতে।
আমার সামনে পাভেল। মাথা হেঁট। জীবনের পেতে রাখা ফাঁদে চোরসদৃশ আটকে পড়া এই পাভেলকে আমি চিনি না। এই পাভেল আমার কাছে আলাদা কোনো অনুভূতি জাগায় না আর। আমি নির্বাক তাকিয়ে তাকে দেখি। আমার দিকে তাকানোর কিংবা আমার চোখে চোখ রাখার সাহস করে না আর পাভেল। সে জানে আমার চোখে তার জন্য এখন স্রেফ করুণা। নর্দমায় পড়ে থাকা নোংরার চেয়ে সে বেশি কিছু নয় আর আমার কাছে। পাভেলের পাশে তার সদ্য বিবাহিত, স্কুল পড়ুয়া বউ। হা হা হা। বউ।

যাকে পাভেল এতদিন আমার কাছে পরিচিত করিয়েছে কখনো মেয়ে কখনো আম্মু হিসেবে। মেয়েটাকে আমিও কত স্নেহ করেছি! পাভেল মেয়েটার প্রাইভেট টিউটর ছিল। কতবার সে মেয়েটাকে নিয়ে গেছে আমার ক্যাম্পাসে! আমি মেয়েটাকে আদর করে রুমে নিয়ে গেছি, খাইয়েছি, গিফট কিনে দিয়েছি! পাভেলকে বলেছি, তোমার টিউশানি করার কী দরকার! আমি তো তোমাকে টাকা দিচ্ছি প্রতি মাসে! শুধু শুধু কেন কষ্ট করবে! পড়াশোনার ক্ষতি হবে তোমার!
পাভেল বলেছে, কী যে বলো! একটা টিউশানিতে কী আর ক্ষতি হবে! তোমার টাকাই বা কতদিন নেব আর! আর এই টিউশানিটা আমি তোমার জন্যই করব। এখান থেকে প্রতি মাসে যা পাব, সেটা দিয়ে তোমার জন্য গিফট কিনব শুধু! অন্য কিছু নয়!
আমি কি তোমার কাছে গিফট চেয়েছি? পড়াশোনা শেষ হোক, চাকরি কর, তখন আমিই তোমার থেকে চেয়ে নেব সব, এখন কিচ্ছু লাগবে না আমার।
না। আমি টিউশানিটা করতে চাই, বাধা দিও না প্লিজ।
অগত্যা বাধা দিইনি আমি আর। সেই পাভেল। সেই মেয়েটা। ভাগ্যিস পরিচিত একজন খবরটা দিয়েছিল আমাকে। নইলে পাভেলের বিয়ের এই লগ্নটা দেখাই হতো না আমার! পাভেলের দিকে নির্বাক তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ নিজের অজান্তেই কখন তার দিকে এগিয়ে গেছিলাম, খেয়াল করিনি একদম। যখন খেয়াল হলো তখন দেখি পাভেলের খুব কাছে আমি। তার বউয়েরও। মেয়েটার দিকে তাকাতে ইচ্ছে হলো না আর। বোকা মেয়েটা। পাভেলের দিকে তাকিয়ে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাই হঠাৎই। শরীরের সব শক্তি একত্রিত করে তার গালে প্রচ- এক চড় কষিয়ে বেরিয়ে পড়ি সেখান থেকে।

পাভেল অনড় বসে থাকে সেখানেই মুখ নিচু করে। পেছনের শত গুঞ্জন উপেক্ষা করে আমি বেরিয়ে পড়ি পথে। আরও কত পাভেল যে ছড়িয়ে ছিল জীবনের অলিতে গলিতে, তখনো অজানাই ছিল সেসব। সেদিন, জীবনের সেই চোরাবালিতে তলিয়ে না গেলে আমার দেখাই হত না হয়ত আরও আরও পাভেলদের সঙ্গে। হৃৎপি-ের পলিতে জমা সব অতৃপ্তি আর অপ্রাপ্তি জড়ো করে কল্পনার আদলে সাজিয়ে তোলা হতো না আমার আর অনুভবের বিমূর্ত সংসার।

মেয়েটার কান্নার শব্দ থেমেছে কখন, কখন ঘুমিয়ে পড়েছি আমিও, টের পাইনি একদম। ঘুম ভাঙল বেশ দেরিতে। আমার অফডে সেদিন। বিছানা ছাড়তেই মেয়েটাকে মনে পড়ে আচমকা। পায়ে পায়ে পাশের ঘরে যাই। নেই। দরজা খোলা। মেয়েটা চলে গেছে কোন ভোরে। বাসার দরজাটা টেনে দিয়ে চলে গেছে কখন আমাকে না বলে। বাসাটা কি একবার ঘুরে দেখা উচিত? সব ঠিকঠাক আছে কিনা? হা হা হা। শব্দ করে হেসে উঠি আমি।

কোথাও কিছুই খোয়া যায়নি, জানি আমি। জীবনজুয়ায় যারা পাভেলদের কাছে হেরে যায় শেষ পর্যন্ত তারা হয়ত খুনি হতে পারে, চোর কিছুতেই নয়। আমি জানি, কোনো এক পাভেলের বিশ্বাসঘাতকতায় বিহ্বল হয়ে মেয়েটা নেমে গেছে পথে। জানে না, আরও আরও পাভেল ছড়িয়ে আছে সে পথের প্রতি বাঁকে। সেখান থেকে অনুভবকে কি খুঁজে পাবে কখনো মেয়েটা? ভাবতেই মনে পড়ে, মেয়েটার নামটাই জিজ্ঞেস করা হয়নি আমার। 
পাশের রুম থেকে অনুভব হেসে ওঠে হো হো। বলে, তুমি একটা আস্ত পাগল! সাইকো!
তার সঙ্গে গলা মেলাই আমিও। হাসতে হাসতেই বলি, হু। সাইকো।

×