ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আমি অন্ধকারেই থাকি

মূল : অ্যানি আর্নো  অনুবাদ : নাসরিন জে রানি

প্রকাশিত: ২১:৩৫, ২ মার্চ ২০২৩

আমি অন্ধকারেই থাকি

আইয়ুব আল আমি

(পূর্ব প্রকাশের পর)

পর্ব-১৩

কিন্তু তৃতীয় একজন বয়স্ক আর বেশ কুৎসিত দেখতে, তিনি রোগীদের পাশে বসে খেয়াল রাখছিলেন। আজ আমার মা ছোট ফুলতোলা ছাপার জামা পরেছেন, ঠিক ওই রকমের একটি ড্রেস যা আমি ছোটবেলায় পরতাম। এই জামাতে তাকে দেখতেও লাগছে ছোট্ট খুকির মতো । এই মুহূর্তে আমি অনুভব করলাম আমি সত্যিই বড় হয়ে গেছি। ফেরার জন্য বিদায় মুহূর্তে তিনি বললেন, “আগামী রবিবার আমাদের দেখা হবে”। কিন্তু আমি আগামী দুই মাস আসতেই পারবো না, আমার একটি অপারেশন হবে; এটি একটি জটিল  অস্ত্রোপচারের ব্যাপার। যার জন্য তার আগেই আমার মৃত্যু হয়ে যেতে পারে। 
বাড়ি ফিরে ছেলেদের সঙ্গে তার মজাদার আর অদ্ভুত কা-কারখানাগুলো নিয়ে গল্প করতে করতে আমরা প্রচ-রকমের হাসাহাসিতে ফেটে পড়েছিলাম। দুঃখকে অক্ষত রেখে দিতে নেই, বরং ‘প্রক্রিয়াজাত’ করে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে রসে পরিণত করতে হয়, সহজ করে মেলে দিতে হয়।
আজ আবার অপরাধবোধে আক্রান্ত হয়েছিলাম আমি, কিছুটা মুক্তি পেতে তার হাতের নখগুলো কেটে দিলাম। মুখটাও কামিয়ে দিলাম। আমার মনে হচ্ছে- তিনি কি এখন এমন অস্থির বালখিল্য আর দুরন্ত হয়ে পড়েছেন, তাই শুধু জিদ ধরে হুইলচেয়ারেই বসে থাকেন, পায়ে ভর দিয়ে হাঁটতে চাইছেন না। কিন্তু এইসব নিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করার সাহস আমার নেই। 

আগস্ট, শনিবার ১৭
আমি আমার মাকে দেখতে যাইনি যদিও আমি ক্রাচে ভর দিয়ে ভালোভাবেই হাঁটতে পারছি। আমি এমনি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এক জবুথবু বৃদ্ধার মতো ওখানে যেয়ে উপস্থিত হতে চাই না। আমার মায়ের কথার তেজ, চলমান উদ্বেগ, তার কার্যকলাপ এইসবও একটি ব্যাপার। আমি এই দৌর্মনস্য ও উত্তেজনা শুধুমাত্র আমার লেখায় অনুভব করি। 
আমার বাবা তার প্রশংসা করে বলতেন- “তোর মায়ের সঙ্গে তর্ক করে তুই কোনোদিন জিততেই পারবি না”। 

সোমবার ২৬
ডেভিডকে সঙ্গে নিয়ে আমি তাকে দেখতে গেলাম, ও খুব বিরক্তবোধ করছিল। সেই পরিচিত গন্ধ, তার রুম থেকে এনেসির ওই চিমনিটার বাঁক, আর সেন্ট থেরেসের মূর্তি, সবকিছু যার যার জায়গায়ই আছে। আর এই স্থায়িত্বটুকু আমার মনে শান্তি এনে দিল। তাকে দেখার পরে ছুঁয়ে দেখছিলাম- তিনি পূর্বে যা ছিলেন তার থেকে কতটা পরিবর্তন এলো এবং এরপরেও তিনি তো সেই ‘মানুষ’টাই আছেন, এখনো। ডাইনিংহলটা আজ বৃদ্ধা মহিলাদের ভিড়ে পূর্ণ হয়ে গেছে, সেই পুরনো রোগীরাই সব। টিভিতে উচ্চশব্দে রকমিউজিক বাজছে, যখনই আমি এখানে আসি, আমার মনে হয়, এইসব জিনিস নিয়েও আমার লেখা উচিত। 
সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার ৫
আগামীকাল দুই বছর পূর্ণ হবে, যখন আমি তাকে ইভত্যুতঁ এর ঐ বৃদ্ধপল্লী থেকে নিয়ে এনেছিলাম আমার কাছে। আমার মনে পড়লো সেদিন বাগুইনিজ এলাকায় এক মহিলাকে লিফট দিয়েছিলাম ফিরতি পথে, তিনি গাড়িতে বসে গর্বের সঙ্গে মহিলাটিকে বলছিলেন, “আমি আমার মেয়ের বাড়ি যাচ্ছি, ওর সঙ্গে ওখানেই থাকবো”। 

আজ আমি এরিককে নিয়ে তাকে দেখতে এসেছি। তিনি নিচতলায় হলরুমে ছিলেন- দেয়াল বরাবর একটি লম্বা পাইপকে হাতড়ে হাতড়ে আপন মনে খেলছিলেন। তার পায়ের চপ্পল দেখে আমি তাকে চিনতে পারলাম। 
আমার মায়ের নতুন রুমমেট ওই বৃদ্ধা মহিলাটি এই ভ্যাপসা গরমে একটি ফারকোট পরে আত্মগরিমায় গটগট করে হেঁটে যাচ্ছে, কাঁধে একটি ব্যাগ ঝুলিয়ে। তার খাপছাড়া অমার্জিত পোশাকে দেখতে লাগছে একটি বুড়ি বেশ্যার মতো। 
আমার মায়ের হাতের নখগুলো বেশ লম্বা আর মাথার চুলগুলোও আলুথালু হয়ে আছে, সব মিলিয়ে বেশ এলোমেলো অবস্থা। আজ তার এইসব গুছিয়ে দেওয়ার শক্তি আমার নেই, যখনই আমি তার এই চলমান অবনতির দিকে তাকাই, আমি আর আজকাল নিজেকে দোষ দিই না, যেন কিছুই অনুভব করি না। আমার মনে হয় না যে, এইসব শুধু আমার কারণেই ঘটছে। তিনি ইতোমধ্যেই তার শারীরিক সমর্থতা হারাতে শুরু করেছিলেন, সেই ১৯৮২ সালে যখন তাকে আমার বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম।

কিন্তু তাকে ন্যূনতম সাহায্যটুকু করতেও আমি ব্যর্থ হয়েছি, তিনি যেন তার “অন্ধকারে” একাই বাস করছেন। ল্য মঁন্দ পত্রিকায়, ক্লদ সাউঁত্যে লিখেছিলেন, “একজনের মূল্য লাখের সমান”। আমার মা-ও এমনটাই বলতেন, তবে তিনি বলতেন এভাবে- “একজনের মূল্য মাত্র এক ডজন”। তার এভাবে কথা বলাটা আমি খুব অপছন্দ করতাম, এসব আমার কাছে পুরনো দিনের অচল বাগধারা মনে হতো। অন্যের কোনো ব্যাপারে তিনি কখনোই ছাড় দিতেন না, সবসময় আঘাত করেই কথা বলা চাই, কাউকে ভালো কিছু বলা যেন খুব অস্বাভাবিক ব্যাপার। আমার কাছে তিনি ‘কাল’ এর এক ব্যক্তিত্ব, তিনিও আমাকে আঘাত করে করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। 
শনিবার ৭
আমি আমার মায়ের পোশাকগুলোই পরতাম। কেউ যদি আমাকে এই নিয়ে বাজে কিছু বলত তখন আমি তাকে ভয় দেখাতাম এই বলে, “আমি মাকে বলে দেব”। আমার মা ছিলেন প্রতিহিংসাপরায়ণ, শাস্তিদাতা। যিনি ইচ্ছে করে অন্য মেয়েদের মায়েদের সঙ্গে মিছিমিছি ঝগড়া বাধিয়ে দিতেন, ওইসব ঝগড়ায় জেতা তার যেমন নেশা, তেমন খেলাও। রুয়নে একবার তার সঙ্গে এক ডেন্টিস্টের চেম্বারে গিয়েছিলাম। মনে পড়ছে ‘এক কাপ চা পান’ এর ঘটনাটি।

ওই ডাক্তারের চেম্বারে ভেংচিকাটা মূর্তিগুলো দিয়ে সাজানো গ্লাস কেবিনেটের মাঝে অনেকগুলো আর্মচেয়ার বিছিয়ে রাখা আছে- এমন একটি ওয়েটিংরুমে বসে আমরা অপেক্ষা করছিলাম সেদিন। আমার শৈশবের ওয়েটিংরুমগুলো ছিল অদ্ভুত আর ভয়ানক। সেগুলো আমাকে ‘অন্যজগতে’ নিয়ে যেত, এমন কোথাও- যেটা ছিল ধনী, গুরুত্বপূর্ণ লোকেদের দুনিয়া। ওইসব ওয়েটিংরুমগুলোর উইন্ডো ডিসপ্লেগুলো হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখা আমার জন্য বারণ ছিল।

সেদিন আমার মা খুব নিচুস্বরে কথা বলছিলেন, একটি অস্বাভাবিক বেদনাদায়ক সেশনের পরে দন্তচিকিৎসক যখন বললেন, “আমার মনে হয় এখন আমরা চা পান করতে বসতে পারি,” এইকথা শুনে আমি বেশ আশ্চর্য হয়েছিলাম, ওই বাজে আর জঘন্য চীনা পানীয়টা এর পুরস্কার হতে পারে না, এত কষ্টের ফল হতে পারে না এবং আমি স্বাভাবিকভাবেই ধরে নিয়েছিলাম আমার মা বলবেন- “তিনি চা পছন্দ করেন না”। কিন্তু তিনি এইসব কিছুই না বলে হাসি দিয়ে সম্মতি দিলেন।তিনি জানতেন ‘উচ্চবিত্ত সমাজ’ এর এই রীতিনীতি আর সাংকেতিক কথাটির মানে- ‘চলুন চা পান করি’ মানে হলো- ‘কোনো কাজের আলাপ’।  (চলবে)

×