ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ইংরেজি উপন্যাস ॥ কয়েকজন অগ্রপথিক

সরকার মাসুদ

প্রকাশিত: ২১:৪৬, ২৬ জানুয়ারি ২০২৩; আপডেট: ২২:২৫, ২৬ জানুয়ারি ২০২৩

ইংরেজি উপন্যাস ॥ কয়েকজন অগ্রপথিক

বিশ শতকের বিশের দশকে যে অল্প কজন বাঙালি কথাসাহিত্যিক অগ্রণী সৃষ্টিশীলতার পরিচয়

বিশ শতকের বিশের দশকে যে অল্প কজন বাঙালি কথাসাহিত্যিক অগ্রণী সৃষ্টিশীলতার পরিচয় রেখেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তার ওপর দুজন ইংরেজ কথা সাহিত্যিকের প্রভাব সবচেয়ে বেশি ছিল। তারা হলেন চার্লস ডিকেন্স (১৮১২-১৮৭০) এবং টমাস হার্ডি (১৮৪০-১৯১৬)। ডিকেন্সের মতই শরৎচন্দ্র নারী চরিত্রের অনেক ভেতরে প্রবেশ করতে পেরেছিলেন। তাছাড়া ‘নারী মনস্তত্ত্ব’ বিষয়টি তিনি নিজের মতো করে, নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফরাসি বিপ্লবের ফলে ইউরোপে নীতিবর্জিত সমাজ ও ছন্নছাড়া জীবনের উদ্ভব হয়েছিল।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ধর্মের নামে ভ-ামি ও অর্থনৈতিক বৈষম্য। অ ঞধষব ড়ভ ঞড়ি ঈরঃরবং-এর মতো উপন্যাসে এসব যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে উপস্থাপন করতে পেরেছেন ডিকেন্স। অগ্রসর বাঙালি ঔপন্যাসিকদের চোখ এড়িয়ে যায়নি এসব বিষয়। পশ্চিমের সমালোচক দৃষ্টিতে ডিকেন্সের উপন্যাসগুলো হচ্ছে ঘড়াবষ ড়ভ চঁৎঢ়ড়ংব। সোজা কথায়, ভালো কোনো উদ্দেশ্য সাধনের গরজে রচিত হয়েছে ওইসব গ্রন্থ। দেশভাগ পূর্ববর্তী বাঙালি কথাশিল্পীগণ যেসব উদ্দেশ্যে কলম ধরেছিলেন তার ভেতর সমাজ বা দেশের কল্যাণ আকাক্সক্ষার মতো বিষয়ও ছিল; কারও কারও বেলায় ওটাই প্রধান ছিল, একথা অস্বীকার করা যাবে না।

শরৎচন্দ্রে আমরা দেখি, নারী চরিত্র সাধারণত পুরুষ চরিত্রের তুলনায় বেশি পরিণত ও সংবেদী। আধুনিক বিজ্ঞান প্রমাণ দিয়েছে, প্রত্যেক পুরুষের মধ্যে সুপ্ত এক নারীসত্তা বিরাজমান। সম্ভবত এজন্যই শরৎচন্দ্র নারীর অতটা ভেতরে ঢুকতে পেরেছিলেন। ডিকেন্সের মধ্যে কিন্তু আমরা দেখতে পাই, পুরুষ চরিত্রের ভেতর নারীসত্তার অন্বেষণ। শরৎচন্দ্র ও ডিকেন্স দুজনেই নি¤œবিত্ত জীবনের দারিদ্র্যের ও নানারকম টানাপোড়েনের নিখুঁত ছবি এঁকেছেন। দুজনেরই মন নিপীড়িত ও লাঞ্ছিত মানুষের জন্য গভীর সহানুভূতিতে আর্দ্র।

Hard Timesmn Bleak House, David Copperfield প্রভৃতি উপন্যাসে চার্লস ডিকেন্স কোনো-না-কোনো সামাজিক সমস্যা সম্বন্ধে সচেতন। শরৎচন্দ্রের গৃহদাহ, চরিত্রহীন, পল্লীসমাজ, পথের দাবি এবং আরও অনেক লেখায় ওই একই জিনিস প্রবলভাবে উপস্থিত।
ভিক্টোরিয়া যুগের এক প্রধান কথা সাহিত্যিক টমাস হার্ডির পরোক্ষ প্রভাব লক্ষ্য করা যায় শরৎচন্ত্রের ওপর। হার্ডি তার সাহিত্যিক জীবন শুরু করেন উপন্যাস দিয়ে এবং এক্ষেত্রে তার উল্লেখযোগ্য উত্তরণ ঘটে। শেষ জীবনে শুধু কবিতা লিখেছেন। হার্ডির প্রথম উপন্যাসের নাম Desperate Remedies (1971), সর্বশেষ উপন্যাস Jude the obscure। হার্ডি সেই ভিক্টোরিয়া আমলেই যৌনতার মতো অতি স্পর্শকাতর থিম নিয়ে ভেবেছেন, কাজও করেছেন।

পরকীয়া ও অবৈধ যৌন সম্পর্কের সংকট ও সমাজে তার প্রভাব নিয়ে রচিত তার বিখ্যাত উপন্যাস ঞবংং ড়ভ ঃযব উ টৎনবৎারষষব-এ বিষয়টি চমৎকার দক্ষতার সঙ্গে উঠে এসেছে। ঋধৎ ভৎড়স ঃযব সধফফরহম পৎড়ফি উপন্যাসে টমাস হার্ডি একটা কথা বলেছিলেন। সেটা হচ্ছে খড়াব ষরাবং রহ ঢ়ৎড়ঢ়রহয়ঁরঃু নঁঃ ফরবং ড়ভ পড়হঃধপঃ। উক্তিটির প্রতিধ্বনি লক্ষ্য করা যায় শরৎবাবুর ‘বড় প্রেম শুধু কাছে টানে না দূরেও সরিয়ে দেয়’ এই মন্তব্যের ভেতর। হার্ডি স্বযুগের রোমান্টিক প্রেমের ইমেজ ছাড়িয়ে সাহিত্যে যৌনতা সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে আসেন।

এখানেই তিনি ভিক্টোরিয়া আমলের অপরাপর কথাকারদের থেকে এগিয়ে আছেন। অবৈধ যৌনসম্পর্কসহ নানারকম অনাচারের উপস্থিতি আমরা অনেক বাংলা উপন্যাসেও দেখতে পাই। অসামাজিক ও অন্যায় যৌনাচরণের কারণে হার্ডি সৃষ্ট বিভিন্ন চরিত্র হৃদয়ের বিক্ষিপ্ততায় ভোগে। তাদের ভালোবাসা আর বিয়ে প্রায়শই একসূত্রে গাঁথা নয়। যেমন Jude the obscure উপন্যাসে দেখা যায়, ঔঁফব বিয়ে করেছে অৎধনড়ষষধ নামের একটি মেয়েকে, অথচ তার মন কাঁদে ঝঁব-এর জন্য। অন্যদিকে,  ঝঁব-এর বিয়ে হয়েছে ফিলোস্টোনের সঙ্গে যদিও সে জুডকেই ভালোবাসে। ঝঁব তার স্বামীকে ত্যাগ করার সময় তাদের বিয়ে সম্বন্ধে যে মন্তব্য করেছিল তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সে বলেছে ‘I think I should begin to the afraid of you, Jude, the moment you had contracted to cherish me under a Government stamp, and I was licensed to be Loved on the premises- Ugh, hwo horrible and gordidÕ. (Jude the obscure, page, 290)
প্রাগুক্ত ঝঁব-এর বাঙালি রূপ শরৎচন্দ্রের অভয়া বা কিরণময়ী চরিত্র। এরা ভালোবাসার খোঁজে স্বামীগৃহ ছেড়ে এসেছে। কেননা যাকে ভালোবাসে না, তার সঙ্গে দীর্ঘকাল সংসার করা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। প্রেমজনিত মনো অস্থিরতা, অনৈতিক সম্পর্কজাত পাপচেতনা; অবশেষে ঈশ্বর ভাবনায় থিতু হওয়া- এই বৃত্তে বন্দি হার্ডির চরিত্রগুলো সম্বন্ধে সমালোচক ডেভিড ডেইচেস সেজন্যই বলেছেন, ‘In a world without God...his characters are possessed of longing for God’...
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বাংলা উপন্যাসে যে ইংরেজ কথা সাহিত্যিকরা সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছিল তাদেরই একজন জোসেফ কনরাড (১৮৫৭-১৯২৫)।

তার সম্বন্ধে বিস্ময়কর তথ্য এই যে, তিনি কেবল জাতিতে পোলিশ ছিলেন তা-ই নয়, তেইশ বছর বয়স পর্যন্ত ইংরেজি ভাষাটাই জানতেন না। অনেক দেরিতে শেখা ওই ভাষায় উপন্যাস লিখে কনরাড বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন, এমন দৃষ্টান্ত সম্ভবত দ্বিতীয়টি নেই। উনিশ শতকে প্রকৃতির কল্যাণী ভূমিকায় আস্থাবান ছিলেন লেখক-শিল্পীরা। দার্শনিক এমারসন তো প্রকৃতিকে ‘শুশ্রƒষাকারী’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। সেই হিতকর প্রকৃতি কনরাডের লেখায় অমঙ্গলের প্রতীক হিসেবে দেখা দিয়েছে। তার সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস Heart of Darkness (1902) আফ্রিকার গভীরস্থ কঙ্গোর পটভূমিতে রচিত এমন একটি গ্রন্থ যেখানে দেখানো হয়েছে, হিংস্র ও অনিষ্টকারী না হয়ে মানুষের কোনো উপায় নেই। যদি না পারিপাশ্বিক অবস্থা তাকে সহায়তা করে।

এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র এবং বয়ানকারীর নাম মার্লো। গন্ধে বর্ণিত জাহাজের ক্যাপ্টেন স্বয়ং কনরাড। নৈতিকতার মুখোশের পেছনে লুক্কায়িত দূরভিসন্ধির ‘দাঁত-নখ’ এখানে বেরিয়ে পড়েছে চরম হিংসুটে ভঙ্গিতে। পূর্ববর্তী উপন্যাস খড়ৎফ ঔরস (১৯০০)-এর  নায়কও জাহাজের  ক্যাপ্টেন। একবার মক্কা অভিমুখী একটি জাহাজ তীর্থযাত্রীদের নিয়ে সমুদ্রে ডুবে যায়। জাহাজটির ক্যাপ্টেন লর্ড জিম (তিনি উপন্যাসের নায়কও) সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং অন্য একটি জাহাজে (ফরাসি জাহাজ) উঠতে সক্ষম হন। এভাবে তিনি সলিল সমাধি থেকে রক্ষা পান।

কিন্তু তারই সহকর্মী মার্লো জিমের ওই স্বার্থপরের মতো বাঁচার বিষয়টি অপরাধ হিসেবে গণ্য করে আদালতে তুলে ধরে। এক্ষেত্রে মার্লোর বক্তব্য, The real Significance of crime in its being a breach of faith with community of mankind and from the point of viwe he was no mean traitor but his execution was a hole-corner affair,
এই মনস্তাত্ত্বিক অপরাধ বোধ পরে আমরা লরেন্স, জয়েস প্রমুখের লেখায় পেয়েছি। মানুষের ধর্ম বিষয়টির প্রতি কনরাড আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন।

সহানুভূতি ও সহমর্মিতার ব্যাপারটা এখানে স্বাভাবিকভাবেই এসে যায়। কিন্তু ঔপন্যাসিক এই মর্মে সংশয় পোষণ করেছেন যে, কোথাও একটা ফাঁক থেকে গেছে। কেননা জিমকে ঠিক দোষী বলা চলে না। কনরাডের ভাষায় He (Jim) is dogged away by the shadwo of his guilt ডস্টয়েভস্কিসুলভ আক্ষেপ কনরাডের সৃষ্ট চরিত্রে আমরা দেখি না। প্রায়শ্চিত্তের পর নবজন্ম লাভ তাদের ভাগ্যে ঘটেনি। মৃত্যু অথবা আত্মহনন, অথবা অথর্বের মতো অবশিষ্ট জীবনযাপন এই-ই হচ্ছে তাদের নিয়তি। 
বিশ শতকের প্রথম কুড়ি বছরের ভেতর যে গুটিকয়েক কথাকার ইংরেজি সাহিত্যের অঙ্গনে তোলপাড় সৃষ্টি করেছিলেন তাদেরই একজন ডি এইচ লরেন্স (১৮৮২-১৯৩৪)। ১৯১১ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস  The white Peacock. এ বই প্রকাশিত হওয়ার পর লরেন্সকে নিয়ে ইতিবাচক আলোচনার সূত্রপাত হয়। তিনি শিক্ষকতার পেশা থেকে স্বেচ্ছা অব্যাহতি গ্রহণ করেন। উদ্দেশ্য, লেখালেখিতে আরও বেশি মনোনিবেশ করা।

যাহোক ১৯১৩ তে প্রকাশিত  উপন্যাস Sons and Lovers পাঠক মহলে গভীর কৌতূহল সৃষ্টি করে। বস্তুত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার আগেই লরেন্স খ্যাতির শিখর স্পর্শ করেন। ওই জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ ছিল আপত্তিকর জীবন উপস্থাপনা যেমন খোলাখুলি যৌন আচরণের অকপট বিবরণ। সমাজে প্রবল মূল্যবোধ লরেন্সের গল্প-উপন্যাসের সূত্র ধরে, প্রবল ঝাঁকুনি খায়। লরেন্সের বাবা ছিলেন কয়লাখনির শ্রমিক; মা স্কুলশিক্ষিকা-রুচিবন্ত, মার্জিত এক মহিলা। 
তার বাবা-মার দাম্পত্য জীবন সুখের ছিল না। ফলে লরেন্স বাবার প্রতি বিরূপ আর মায়ের প্রতি নির্বিষ্ট ও আবেগী ছিলেন। পরকালে মায়ের প্রতি তার আকর্ষণজনিত অভিব্যক্তি উল্লেখযোগ্য শিল্প সৌকর্যে পরিণত হয়েছিল। ইডিপাস কমপ্লেক্স ও ফ্রয়েডীয় কামাসক্তি লরেন্সসাহিত্যের দুটি প্রধান দিক। এ বিষয়গুলোর প্রাণবন্তু প্রয়োগ সন্ধিৎসু পাঠক সমাজে উস্কে দিয়েছিল বিতর্ক।
আত্মজৈবনিক উপাদানে সমৃদ্ধ উপন্যাস Sons and Lovers-এ এসব জিনিস ভালোভাবেই এসেছে। এ গ্রন্থ ভিক্টোরীয় সুচিতার ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এক তীব্র প্রতিবাদ যেখানে লেখক তার বিচিত্র মিশ্র অনুভূতির ও প্রেমক্ষুব্ধ আত্মার উন্মোচন ঘটাতে পেরেছেন। প্রাত্যহিক জীবনের মলিনতার ও দীনতার যন্ত্রণা শিল্পব্যাঞ্জক ভঙ্গিতে ফুটে উঠেছে পল লরেন্স, ক্লারা মিরিয়াম প্রভৃতি চরিত্রের আন্তঃসম্পর্কের ভেতর দিয়ে। 
ঝড়হং ধহফ খড়াবৎং রচিত হওয়ার পর আমার ধারণা লরেন্সের জীবনদৃষ্টি আরও গভীরে পৌঁছেছিল। জধরহনড়ি উপন্যাসে আমরা পাই প্রেমের অস্থিরতা, ব্যতিক্রর্মী দাম্পত্য জীবন ও বিক্ষিপ্ত মানবমনের অন্তরঙ্গ ছবি। যৌনতা আর গল্প-উপন্যাসে কেবল শারীরিক ঘটনা নয়, একটি গভীর প্রতীকও। ‘লেডি চ্যাটারলি’জ লাভার’ উপন্যাসের চিত্রিত কনি, তাই, কোনো অস্বাভাবিক মেয়ে নয়।

ব্যাভিচার তার নারীত্বের ঐশ্বর্যকে মুক্তি দিয়েছে। জীবনরসিক ও জীবনভোগী নারী সকলের   প্রতিনিধি এই কনি। তবে রোদলেয়র প্রণীত Fleurs du mal (ক্লেদজ কুসুম)ই যেন বহুযুগ পরে গদ্যের রূপ পেয়েছে Sons and Lovers -এর মাধ্যমে। লরেন্স নিজের জীবনে যে সব সমস্যায় জর্জরিত হয়েছেন (নয় বছরের বড়, তিন সন্তানের মা তার গুরু-পত্নীর পাণিগ্রহণও তার মধ্যে একটি) উপন্যাসটিতে সেই সব কিছুর জ্বালাময় প্রকাশ অত্যন্ত চিত্তস্পর্শী ও শিল্পসম্মত।

×