ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কথাশিল্পী শওকত আলীর সাহিত্যের কথকতা

দীপংকর গৌতম

প্রকাশিত: ০১:৩৮, ২৫ নভেম্বর ২০২২

কথাশিল্পী শওকত আলীর সাহিত্যের কথকতা

.

শওকত আলী বাংলা কথাসাহিত্যের দিকপাল। ইতিহাস সচেতনতার মধ্য দিয়ে ভাষাবিন্যাসী আয়োজন তাকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছে। দশক বিচারে সাহিত্য নির্ণয় করার কোনো সঙ্গত বিষয় না থাকলেও কালের যাত্রায় শওকত আলীর অবস্থান ষাটের দশক। ব্যাপক চিন্তা, প্রতিচিন্তার মধ্য থেকে তিনি সাহিত্যের বন্ধুর পথে যাত্রা করেন এবং মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন কথাশিল্প। অর্থাৎ কথাসাহিত্যের মধ্য দিয়েই তিনি তার ভাবনা তুলে ধরেন।
‘পিঙ্গল আকাশ’ উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যে তার উজ্জ্বল রেখাপাত। প্রধানত উপন্যাসকেই তিনি চিন্তা-চেতনা প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তার শেষ রচনা সম্ভবত ‘মাদারডাঙ্গার কথা’ (২০১১)। তবে ‘পিঙ্গল আকাশ’ প্রকাশের পর বোঝা গিয়েছিল সাহিত্যের এ বন্ধুর পথে তিনি সিন্ধু তীরে বালু নিয়ে খেলতে আসেননি।

উপন্যাসে মঞ্জুর আত্মহননে ফুটে ওঠে ক্ষয়িষ্ণু ও মূল্যবোধহীন বিকৃত একটি নগরসংস্কৃতি বিকাশের চিত্র। এ প্রসঙ্গে মনে রাখা ভালো, শওকত আলীর উপন্যাসের সব চরিত্রই কম-বেশি আত্মোন্নয়নকামী। এর পেছনে যে লেখকের ব্যক্তিজীবনের সংগ্রাম-সংকটের ছায়াপাত ঘটেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশের ষাটের দশকের গল্প-উপন্যাসে গ্রাম ও শহরকেন্দ্রিক নাগরিক জীবনের যে আশা-আকাক্সক্ষা-স্বপ্ন এবং সংগ্রামশীলতা কিংবা সামষ্টিক জীবনে সামাজিক-রাজনৈতিক যে প্রভাব পড়েছে, তা উপন্যাসে তুলে ধরার ক্ষেত্রে শওকত আলীর দক্ষতা অসামান্য। একই সময় তিনি উপন্যাস-গল্প রচনার একটি স্বাতন্ত্র্য ভাষা গড়ে তুলেছেন সফলভাবে; যে ভাষা সহজেই সাধারণ পাঠককে আকর্ষণ করে। আর এভাবেই ‘পিঙ্গল আকাশ’ থেকে ‘মাদারডাঙ্গার কথা’ তার সবগুলো উপন্যাসে আমরা যে শওকত আলীকে আবিষ্কার করি সেখানে তিনি ভিন্ন পথরেখা নির্মাণ করেছেন- যা শুধুমাত্র শওকত আলীর কথাসাহিত্য নির্দেশ করে। আমরা শওকত আলীর কথাসাহিত্যের দিকে তাকালে  যদি ছোটগল্পের কথা বলি তা হলে শুনতে পাই এক প্রান্তস্বর।
‘কিষাণের একটা জীবনই কি কম, কহ? ... কিষাণের জীবনে কত কথা থাকে’ এবং ‘একটি-দুটি করে লোক দেখা গেল এক সময় বড় সড়কের ওপর। কৌতূহল না সমবেদনার কারণে তারা একে একে এসে পৌঁছাচ্ছিল বোঝা মুশকিল। তবে লোকগুলো ঈষৎ আন্দোলিত হচ্ছিল। আন্দোলিত হচ্ছিল তার প্রমাণ তারা ক্রমেই কাছাকাছি জড়ো হচ্ছিল এবং জড়ো হয়ে কাছে এগিয়ে আসছিল’- (গল্প-‘নয়নতারা কোথায় রে’)। মেহনতী ক্ষেতের মজুর-কিষাণ জীবনের অন্তর্গত ভাষাচিত্রের মধ্য দিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে। কিষাণ জীবনের কথকতা, তাদের আগমন, আন্দোলন- সংগ্রামকে ঐক্যবদ্ধ করার যে প্রাণান্তকর চেষ্টা এটাই শওকত আলীর তার গল্পের বিষয়। উত্তরবাংলার শ্রমজীবী মানুষের পীড়িত জীবন নিয়ে সারাদেশে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেহনতী কিষাণ সমাজেরই প্রতিনিধিত্ব করে। তার গল্প হাড় খুলির বৃত্তান্তে আমরা যে একজন রাজাকারীকে দেখি, বিত্তবেসাতির জোর তার যুদ্ধাপরাধী পরিচয় ভুলিয়ে দিয়েছে। সে তার দখল করা জমি খুঁড়তে খুঁড়তে এক সময় দেখা পায় অজস্র হাড় খুলি বেরিয়ে আসছে। এই বেরিয়ে আসা আর শেষ হয় না। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা এ গল্পের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী যে সমাজ বাস্তবতা তা উঠে এসেছে।
শওকত আলীর গল্পে উত্তর জনপদের আবহ ও বিন্যাসী পরিবেশ এমনভাবে উঠে এসেছে যে রূঢ় ভূমিজ মেহনতজীবী মানুষের চিত্রায়নে তার বিশেষত্ব তার গল্পকে যেমন সম্বৃদ্ধ করেছে। তেমনি চিনিয়ে দিয়েছে শোষক-শাসকের দ্বন্দের মূল জায়গাটা। তার চিহ্নি জায়গায় একটি দাবানল জ্বালা যেত, যার মধ্যদিয়ে উঠে আসত কৃষকরাজ, শ্রমিক রাজ। তবে একটি গল্পের সঙ্গে কখনো আরেকটি গল্পের সাযুজ্য আছে। এক রাত, এক শীত, বৃষ্টি এবং কান্দরের বর্ণনা গল্পে ঘুরে ফিরে আসে। : ‘অন্ধকার চারদিকে থৈ থৈ করে। মনে হয় বাতাসে অন্ধকার পাক খাচ্ছে, ফুলছে আর চারদিকে কেমন ছড়িয়ে যাচ্ছে। উত্তর দেখো, দক্ষিণ দেখো, আসমানে তাকাও শুধু কালো। থেকে থেকে কালো মেঘের পি-গুলো একদিক থেকে গড়িয়ে যাচ্ছে আরেকদিকে। ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটা এসে শরীর কাঁপিয়ে দিচ্ছে’ (‘আর মা কান্দে না’ )। তার গল্পের বর্ননা রীতির যে কাব্যিকতা গতিশীল ও মুগ্ধ হওয়ার মতো। এপিক ধর্মী রচনায় সিদ্ধহস্ত শওকত আলীর এই বর্ণনার মধ্যদিয়ে প্রকৃতি, সমাজ বাস্তবতাকে যেমন অবলোকন করা যায় তেমনি তার গল্পের মানুষদের শ্রেণি চরিত্র সর্বোপরি শ্রেণিসংগ্রামের দিকে নিয়ে যাওয়ার তীব্র বাসনা তার রয়েছে। সেটা সহজেই অনুমেয়। তার বর্ণনা রীতিসিদ্ধ প্রভাবে কাব্যকলার যে রস নিষিক্ত তার বাতাবরন শিল্পিত ও সৌন্দর্যমণ্ডিত। এই বর্ণনার সঙ্গে একাধিক গল্পের মিল থাকলেও আরেকটি গল্পেও এ গল্পটির বর্ণনা রীতির প্রভাব খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করা যায়। ‘খোলা কান্দরে হাওয়ার ঝাপটা ভীষণ আছাড় খাচ্ছে। উত্তর থেকে বাতাস শব্দ করে ছুটে আসছে। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে উথাল-পাতাল অন্ধকারটা দেখে নিল দুজনে। তারপর পা বাড়াল। কিন্তু কোথায়? তখনই শুরু হলো বেদম বৃষ্টি।

‘নয়নতারা কোথায় রে’ গল্পেরও আকাশ-বাতাস-বৃষ্টির বর্ণনা অনুরূপ : ‘আসমানের লীলা বোঝা ভার। এই বাতাস বন্ধ, গুমোট ভাব, যেন চেপে আসছে বুকের ওপর ভারি বোঝার মতোÑ তারপর এই আবার দেখ, দেখতে দেখতে কোন দিক থেকে বাতাস বইতে শুরু করে দিল, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ফুটে উঠল বাতাসের গায়ে। শেষে মেঘ ডাক ছেড়ে বৃষ্টি ঢালতে শুরু করে দিল।’ (লেলিহান সাধ)।
শীতের প্রকোপ এবং তীব্র শীতে জববুথবু উত্তর জনপদের প্রান্তিক জীবনের চিত্র এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। যার মধ্য দিয়ে আমরা দেখতে পাই মেহনতী মানুষের সংকট উত্তরণহীন প্রয়াসে চলছে। কামলা-কিষাণের মধ্যে কোনো ভেদ নেই, বৈষম্য নেই তারে সংকট একই দুরবস্থা একই। গল্পে শ্রমজীবী মেহনতী মানুষের পক্ষে ও তার যে সংগ্রাম তা তিনি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। তার দৃশ্যমান জগতের চিত্র, মানুষের মানবিক অবস্থান, শ্রেণি শোষণের প্রকারভেদ তিনি কাছ থেকে দেখেছেন। তার দার্শনিক চেতনার আলোকে তা তিনি লিখেছেন। নিরাবেগ বোঝাপড়া নিয়ে। তার গল্পের বর্ননায় কাব্যময়তা আছে, ভাঙাচোরা জীবনের মানুষের স্বপ্ন আছে। শ্রেণি শোষণের চিত্র আছে, শ্রেণী-সংগ্রামের ইঙ্গিত আছে। হেনতী মানুষের ভাষাচিত্রী শওকত আলী তাই গণমানুষের কাছের লোক হয়ে গেছেন সহজেই। এর পেছনে তার পোড় খাওয়া জীবনের একটা ভূমিকা আছে সেটা আরেকটু পেছন থেকে দেখলে বোঝা যাবে যে শওকত আলী যাদের প্রতিনিধত্ব করেছেন তারা কারা? এক সময়ের চেনা-জানা মানুষ। কাছের মানুষদের নিয়ে তিনি মহৎ সাহিত্য রচনা করেছেন।

দুই.
জম্নভূমি ত্যাগের পরও সার্বিক শান্তি কখনোই আসেনি। বাংলাদেশে এসে প্রত্যক্ষ করেছেন পাকিস্তানের নব্য ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ-নির্যাতন। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বাংলার মানুষ ঐক্য গড়ে তুলে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু স্বাধীনতার প্রত্যাশা পূরণ হয়নি পুরোপুরি। আগে যারা সামন্ত ছিল, সেখানে নতুন সামন্ত এলো। শ্রেণি বদলাল, শ্রেণি চরিত্র রয়েই গেল। ফলে স্বপ্ন ভাঙার নতুন কষ্ট জমা হলো। এই স্বপ্ন ভঙের বেদনা তার ট্রিলজিতে (দক্ষিণায়নের দিন, কুলায় কালগ্রোত, পূর্বরাত্রি পূর্বদিন) লিখেছেন তিনি। এখানে বাংলাদেশের যাত্রালগ্ন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা-উত্তর অস্থির রাজনৈতিক বাস্তবতা। সামরিক শাসনের অবরুদ্ধ কালের চিত্রসহ সচেতন নাগরিক শ্রেণির ভেতর-বাহির অসাধারণ দক্ষতায় অংকন করেছেন। একাত্তর-পরবর্তী বাঙালির জীবন দেখতে গিয়ে শওকত আলী বাঙালি জাতি-গোষ্ঠীর পেছনের ইতিহাসও একনজরে দেখে নেওয়ার প্রয়াস গ্রহণ করেছেন ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ উপন্যাসে। এই উপন্যাসে তিনি বাংলায় মুসলিম আগমন, সেনদের অত্যাচার-নির্যাতনে অতিষ্ঠ সমাজের নিচু শ্রেণির অবস্থা পাঠকের সামনে হাজির করেছেন। এখানেই থেমে যাননি। দেখিয়েছেন সমাজের এই নির্যাতিত শ্রেণিই প্রকৃতপক্ষে ছিল বাঙালির আদি-বংশধর। শওকত আলী ইতিহাসশ্রয়ী এ উপন্যাসে স্পষ্টভাবেই দেখিয়েছেন, বাঙালি জাতিকে প্রাচীনকালে তো বটেই মধ্যযুগে এবং আধুনিক যুগেও তার ভাষা-শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি রক্ষার সংগ্রাম করতে হয়েছে।
‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ উপন্যাসটি শওকত আলীকে রাতারাতি খ্যাতির শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছে দেয়। এই উপন্যাসে তিনি বিশ শতকের প্রায় শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে সুদূর পেছনপানে তাকিয়ে ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণের শিল্পভাষ্য রচনা করেছেন। লক্ষণ সেন ২৮ বছরের রাজত্বকালের শেষ বছরগুলোতে বার্ধক্যে এবং ক্ষমতা প্রয়োগে খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। অনেক সময় শাসনকার্য পরিচালনা তার জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছিল। এই দুর্বলতার সুযোগে সাম্রাজ্যের ভেতরে ঐক্য ও সংহতিতে ফাটল ধরে এবং কিছু স্বাধীন শক্তির উত্থান ঘটে। এ ছাড়া শক্তিমান ও ক্ষমতাধরদের অরাজকতা দেশময় ছড়িয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে তুরস্কের অভিযানকারী বখতিয়ার খিলজি অনায়াসেই বাংলা দখল করে নেন। এই বিশৃঙ্খল পটভূমিতে গ্রামবাংলা কীভাবে অস্থির হয়ে উঠেছিল, ক্ষমতাধরদের তাণ্ডব ও লুটপাটে কীভাবে মানুষ গ্রামছাড়া হয়েছিল এবং এর মধ্যে কিছু নরনারী বিচিত্র সম্পর্কের টানাপোড়েনে কীভাবে রক্তাক্ত হয়ে উঠেছিল, সেসবের নানামাত্রিক বুনন-বিন্যাসে গড়ে উঠেছে ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ উপন্যাসটি।
উল্লিখিত উপন্যাসের সবচেয়ে বড় শক্তি এর ভাষা; প্রতিটি পদে, পদবন্ধনে। সাধু ভাষার শব্দভা-ার বিস্ময়কর নৈপুণ্যে তিনি ব্যবহার করেছেন চলিত ভাষার গড়ন-সৌষ্ঠবে। সম্ভবত ষোড়শ শতকের ভাষিক জগতের ধ্রুপদি আবহের স্বাদ পাইয়ে দেওয়ার জন্য তিনি এই অসাধারণ ভাষাপ্রপঞ্চ বেছে নিয়েছেন। কমল কুমার মজুমদারের ভাষা ব্যবহারের সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে, বাক্য গড়নের রীতির সঙ্গে পরিচয় আছে। সেখানে কাঠিন্য নির্ধারণই যেন কর্তব্য। কিন্তু সে অন্য অভিধা। শওকত আলী ভাষার মধ্যে পুরে দিতে চেয়েছেন জীবনের প্রতি গভীর মমত্ববোধের আলো, আনন্দ আর অফুরন্ত প্রবাহ। বাক্যের গড়ন সৌষ্ঠবের মধ্যেও তার এই অফুরন্ত শক্তির পরিচয় মেলে। পথ চলতে চলতে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত শ্যামাঙ্গ সম্মুখে যে প্রহেলিকা দেখতে পায়, তার বর্ণনা দিতে গিয়ে শওকত আলী লিখেছেন : ‘সে বড় বিচিত্র অবস্থা। এখন স্মরণ হলে কৌতুক বোধ হয়। অবশ্য তখনো তার কৌতুক বোধ হচ্ছিল। কৌতুক বোধ হওয়ারই কথা। কারণ প্রথমে তুমি দেখলে বংশবীথিকার বিনত শাখায় একটি বনকপোত। পরক্ষণে সেই ক্ষুদ্রাকার পাখিটি হয়ে গেল একটি ঊর্ধ্বলম্ফী মর্কট মুহূর্তেক পরে সেই মর্কটও আর থাকল না, নিমেষে হয়ে গেল একটি বিশুদ্ধ বৃক্ষশাখা। চক্ষু কচালিত করলে অতঃপর তুমি আর কিছুই দেখলে না। বংশবীথিকা না, বনকপোত না, মর্কট না, বিশুদ্ধ শাখাও না।’
এই রচনার মধ্যে প্রায় প্রতিটি শব্দই তৎসম। কিন্তু কোথাও দুর্বোধ্যতার লেশ নেই। অধিকন্তু এমন একটি সহজতা বিরাজমান, যা পাঠকের বোধের জগত তৃপ্ত করে। লেখকের ‘কুলায় কালগ্রোত’ ‘পূর্বরাত্রি পূর্বদিন’ নতুন সময় আসার একেবারে আগের সময়ের বয়ান। মূলত ষাটের দশকে আমাদের মধ্যবিত্ত এবং সমগ্র সমাজ ব্যবস্থায় একটা পরিবর্তন আসে। নতুন একটা চিন্তা-চেতনা দ্বারা আলোড়িত হয় পুরো সমাজ। ধ্যান-ধারণা, চালচলন জীবন ব্যবস্থায় একটা পরিবর্তনের সুর বেজে ওঠে। সে সবই উল্লিখিত দুটো উপন্যাসে তিনি তুলে ধরেছেন। শওকত আলীর উপন্যাসের জগৎ নির্মিত হয়েছে মূলত মধ্যবিত্ত, নিুমধ্যবিত্ত শ্রেণিকে ঘিরে; এদের জীবনের টানাপড়েন, জীবনবোধ, সংগ্রাম প্রভৃতি তার উপন্যাসের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে উঠে এসেছে। নগরকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত সমাজ মূলত তার উপন্যাসে ঘুরে ফিরে এসেছে। একই সময় তার রচনায় সমকালীন রাজনৈতিক বাস্তবতা, ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ও স্থান করে নিয়েছে।

তিন.
শওকত আলীর প্রথম উপন্যাস ‘পিঙ্গল আকাশ’-এ নাগরিক মধ্যবিত্ত শ্রেণির নগ্ন, নীতিহীনতা, রুচির বিকৃতি, কামনার করালগ্রাসের পরিণাম, উপন্যাসের কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র মঞ্জুর দীর্ঘশ্বাস, রক্তরক্ষণ ও আÍহনন শিল্পিত হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে দিয়ে বোঝা যায় তার সাহিত্য রস আস্বাদন বা প্রদানের ক্ষমতা। এই মধ্যবিত্ত জীবনেরই নানাকৌণিক দিকের প্রতিফলন ঘটেছে লেখকের অন্যান্য উপন্যাসে।
শওকত আলীর রচিত উপন্যাসের তালিকা দীর্ঘ না হলেও একেবারে সংক্ষিপ্ত নয়। জীবনভর সাহিত্যসেবায় নিয়োজিত থেকে গুণী এই কথাশিল্পী বাংলা একাডেমি এবং একুশে পদকসহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। বামঘেঁষা রাজনৈতিক চেতনা দ্বারা তিনি উত্তাল যৌবনে প্রভাবিত হলেও তার রাজনৈতিক বিশ্বাস ও ধারণা স্বচ্ছ। তার ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারণা কতটা স্বচ্ছ সে কথার প্রমাণ আমরা পাই ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ উপন্যাসে।
শওকত আলীর জš§ পশ্চিমবঙ্গের দিনাজপুর জেলায়। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ তার অন্তর-বাহির কুরে কুরে খায়। নিজ ভূমি হারানোর বেদনা থেকে তিনি আর মুক্ত হননি। তার কথায় বিভিন্নভাবে উঠে আসত পৈতৃক বাড়ি, বাড়িতে একটা পুকুর ছিল, পুকুরের জল কাকচক্ষু যাকে বলে; একটা কুকুর ছিল খুব প্রভুভক্ত। বাড়ির পাশে মেলা হতো, কীর্তন, যাত্রা, সার্কাস- মোদ্দা কথা তিনি সংস্কৃতি সমৃদ্ধ এলাকায় বড় হয়ে উঠেছিলেন। কাছ থেকে সেসব দেখেছেন। তারপর একদিন সকালে শোনা গেল- এদেশ আর তাদের নেই! সেই কষ্ট তিনি লালন করেছেন আমৃত্যু। মেহনতী মানুষের ভাষাচিত্রী শওকত আলী যেমন ছিলেন কথাশিল্পী তেমনই ছিলেন ছিলেন শ্রেণি সংগ্রামে বিশ্বাসী এক লড়াকু। তার মৃত্যুর মধ্যদিয়ে তিনি জানান দিয়ে গেছেন যে সমাজের তথাকথিত ছোটলোকরাই সাহিত্যের প্রকৃত চরিত্র। যাদের জীবনে প্রওতিনিয়ত সংগ্রাম আছে। শ্রেনীসংগ্রামের সম্ভাবনা আছে। সেই সংগ্রামের কারিগর সমাজের প্রান্তিক মাপনুষেরা যাদের প্রতিনিধি তিনি। আর যারা সেই সংগ্রামের নেতৃত্ব দেবেন তাদের জন্য তিনি জীবনের স্লেটে খড়িমাটি দিয়ে নাম লিখে গেছেন।

 

×