ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নৈরাশের লতাপাতা

মতিন বৈরাগী

প্রকাশিত: ২১:৪৪, ১০ নভেম্বর ২০২২

নৈরাশের লতাপাতা

নৈরাশের লতাপাতা

আশার যুগ্ম বৈপরীত্যে নিরাশা, নৈরাশ্য আঞ্চলিক ব্যবহারে নৈরাশ, আলোময় বিশ^াসের তৃতীয় কাব্য ‘নৈরাশের লতাপাতা’। মূলত একটি কবিতা ৫৮টি পর্বে সংযোজিত হয়েছে লতা তার শাখা উপশাখা এবং তারপর পাতার উপস্থিতি। সে পাতা কোথাও সবুজ কোথাও পিঁপড়ে কাটা। তার মধ্যে ফুটেছে দীর্ঘশ^াসের নৈরাশ। আবার আশার আকুতি, যেহেতু আশা এখনো বিলীন হয়নি এবং যদিও তা প্রতিনিয়ত ঠেলে দিচ্ছে দেশ কাল সমাজমনস্কতাকে এবং জীবনপ্রেমিক মানুষকে নৈরাশ্যের দিকে। লতা থেকে পাতায় শোভিত হচ্ছে নৈরাশ্য, তার অর্থ আশা ক্ষীণতম হলেও নৈরাশের ফুলকলির উপস্থিতি না ঘটলেও রয়েছে কলি ও ফুলের মধ্যবর্তী।

কবি তাঁর শিল্পধারারেখায় তাঁর বিশ^াসবন্ধনকে নানাভাবে ছেয়ে যাওয়া ‘নৈরাশের লতাপাতাকে’ বর্ণনার মধ্য দিয়ে আশালতার দিকে নিরন্তর নিবিষ্ট। আলোময়ের এই ন্যারেটিভগুলোতে একটা মেঘা ন্যারেটিভের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অবয়ব দিয়ে গঠনশৈলীকে প্রকৃষ্টতর করেছেন। আশার প্রত্যাশায় পাঠককে ক্লিশ করে না। তার পর্বগুলো সচরাচার চোখে সাদামাটা, খুব ভারি কোনো কৃতকৌশলের প্রয়োগ এতে অলক্ষিত, এতে তার জীবনদর্শন রয়েছে তন্ময়তার মধ্যে। তার উপমাগুলো আশপাশের জীবন লড়াইয়ের খুঁটিনাটি, অকারণ মিথ-আশ্রয়ী নয়। তিনি কৌশলী কবি।  কিন্তু যা বলেছেন তা সরেস মাটির সোঁদা গন্ধের মতো।
০২.
‘শিয়ালের ডাকে ঘুম ভাঙে’। বৈশিষ্ট্যে শিয়াল রাতেই ডাকে, এই সময় তার শিয়ালের খাদ্য শিকার পর্ব। দিনেও ডাকে নির্জন হলে। দলবদ্ধ বা দলচ্ছিন্ন হয়েও ডাকে। যদিও শিয়াল সমাজে আদৃত কোনো প্রাণী নয়, কিন্তু সমাজকুলের শিয়ালরা লুটকরা ধনে হয়েছে অনেক বড়, তেজি, গটগট হাঁটে, তাদের দিনরাত্রি নেই। তবু আজকের সমাজে অদ্ভুতভাবে তারা আদৃত এবং জনকল্যাণে যেনো গলধঘর্ম, আর উপদেশের ঝুড়ি তাদের কণ্ঠে তরলের মতো গড়ায়। তারাও শিকার করে সমাজসম্পদ সমাজের ঘাড়ে পা রেখে।

হাঁস-মুরগিতে তাদের রোচ্যতা নেই, খাসিটা প্রিয়। না চুপি চুপি নয় এখন কর্পোরেট গোষ্ঠী নামে প্রায়শই তারা শিকারটার ঘাড় পরীক্ষা করে এবং ক্রমাগত মটকাতে থাকে। সমাজপ্রণালীকে এরা একপ্রকার কুকুর আদল মনে করে, মাঝে মাঝে জনগণ সঙ্গবদ্ধ হয়ে তাড়া দিলে তারাও দলবদ্ধ হয় এবং ক্ষমতার নানা সুরছন্দে ডাকে, তাতে ভীতিও থাকে, শঙ্কাও থাকে এবং পরিণামও থাকে। তবে তাড়ার জোরটা সঙ্ঘবদ্ধ হলে, অটুট এবং বিজ্ঞতাপূর্ণ হলে তখন তারা দৌড়ায়, নিরাপদ খোঁজে। রাত্রির ঘুম মাঝপথে কেটে গেলে ¯œায়ুর শিথিলতা কাটে না।

না ঘুম না জাগরণে মনোজগতের কল্পনা-পরিকল্পনা শব্দ হয়ে উঠলে নানা দৃশ্য জীবন্ত হয়ে ওঠে, এবং এমন কী বাঙময়তায় নানা অর্থের দ্যোতক হয়ে নানা দৃশ্যকে স্বপ্নজগতের মতো প্রতীকী করে; তেমনি চারদিকে ঘটমান ঘটনাগুলোও ভাবনার শাব্দিক বয়ানে শিয়ালের প্রতিচ্ছবি হয়ে ডাকতে থাকে লুটমত্ত মচ্ছবে। শিয়াল যেমন টের পায় মানুষের সামান্য নড়াচড়া, বিপদের আধোঘুম জাগরণের ইঙ্গিত, তেমনি এই সব শিয়ালেরা খুব অল্পতেই টেরপায় স্রোতাবর্তের বৈরী ঘুর্ণন এবং প্রতিরোধের বিবরণ তাড়া পড়তে পারে। কিন্তু হাতছাড়া হয়ে যাবার রোষে ডাকতে থাকে পাল্টা হুংকারে। আর এসব ডাক একজন সচেতন মানুষ ছাড়া খুব কমসংখ্যকের শ্রবণগ্রাহ্য হয়।

কারণ এতে থাকে তার সত্যবাদিতার বাগাড়ম্বর কারণ ‘সুরের শরীর থেকে ঝরে পড়া কিছু বসন্তের অকাল বৃষ্টি মাখা মুখ/ইতর ভাবনায়/ছুঁয়ে থাকে মাটির শরীর।’ বাস্তবেও অই মুখগুলো যা ছিল ‘বসন্তের অকাল বৃষ্টিমাখা’ সেই মুখ যে এখনো শিয়ালের গতিবিধির ডাক শোনে আর তাই নিয়ে ভাবনাকে আবর্তিত করে। কিন্তু অসংলগ্ন ছেঁড়া অস্তিত্বের ভাবনা প্রকাশকে ওরা ইতরের চিঁচি মনে করে, এবং অগ্রাহ্যের উপকরণ হিসেবে গণনা করে। আর এভাবে নিগৃহীত মানুষ পূর্ণ এবং অপূর্ণ ভাবনায় ডুবে গিয়ে ‘নিরবধি হেঁটে চলে যায় কাজে [মানে শিয়াল তাড়াতেও হতে পারে, আবার দাস্যজীবনের উপকরণ সংগ্রহেরও হতে পারে, যা চূড়ান্ত বিবেচনায় অকাজের মতোই হতে পারে।] কারণ জীবনের মূল সূত্রজট মুক্ত করতে না পারলে সব কাজই অর্থহীন থেকে যায়।

এরকম নানা দৃশ্যে নানারূপী ভ্রমণেও একজন সংবেদনশীল মানুষের ঘুম আসি আসি করে আবার টুটে যায় অনুপর মানুর বিচ্ছেদের মতো। আর এসব ভাবনা ‘নিদ্রাহত চাঁদের মতো জেগে থাকে’ সংবেদনশীল ¯œায়ুচাকার সকল আবর্তন নিয়ে। এই সময়ে দৃশ্যগুলো নানা দৃশ্য হয়ে  ঝুলে থাকা ‘ইস্পাতের ডানার’ মতো তোলপাড় করে চিন্তার শূন্যতা নিয়ে। যুক্তি তখন যুক্তিকে ভঙ্গুর করে। সঙ্গতভাবে যে আশা চিন্তার মধ্য বহিরগমন ঘটনায় যে বাসনা রূপান্তরিত হয়েছিল চাহিদায় সেগুলোতে ক্ষয়ধরে। ব্যক্তি আর ব্যক্ত হয় না কারণ নিষেধ আছে, আর ‘আই বুড়ো বাসনাগুলো প্রায়শ ক্ষয় হয় ‘অনিশ্চয়তার গহ্বরে’ এবং সুঁচ হয়ে সেলাই করে না আর চৈতন্য খরাজাল, যদিও সামাজিক অবস্থানই তার চৈতন্যের এই দ্বিধাযুক্ততা এবং বার বার টুটে যাওয়া।
০৩.
শিয়ালগুলো প্রতিনিয়ত ডাকছে। ওলট পালট করছে স্থিতির মাটি নখের-আঁচড়ে। দাঁতালো শিয়ালবাহিনী প্রতিক্রিয়ার, প্রভুদের বিনীত আজ্ঞাবহ দাস, মেরুদ-হীন শিক্ষক, শিল্পী কবি সাহিত্যিক লুটমচ্ছবের দাঁতে লোভের লোল ঝরাচ্ছে; ফতুর হচ্ছে আশা। আর নদীর জলে যে মানুষ ভাসিয়ে ছিল তার যৌবন আজ তা সহযাত্রীর রক্তে রক্তবর্ণ। [নদী বহমান, প্রতিনিয়ত নতুন, অগ্রগতির ধারায় প্রকৃতই আধুনিক] এ সময়টা লাশ কাঁধে নিয়ে ফিরবার সময়, যদিও কিছু বলা দরকার, প্রতিবাদ-প্রতিকার-প্রতিরোধের ভাষ্যধারার সম্মিলনে শক্ত পোক্ত হুঁশিয়ারিতে, এবং যদিও বলা প্রয়োজন নিজ মনবোধকে জাগৃতির জন্য ‘তোমরাও সাবধান হও, আঘাতটা আসবে।

সাবধান হওয়া জরুরি’ [অর্থাৎ হুম করে ঝুপ করে লাফিয়ে পড়া নয়, তা হলেই নিপাতনে সন্ধি হবে] কিন্তু তা বলায়ও নিষেধ উড়ছে। আর চারদিকে ‘পাথর গড়িয়ে পড়ছে’ সময়টা পাথরের মতো ভারি, কর্কশ। কাকস্যবেদনার মধ্যেই সময়টা ডুবে যাচ্ছে পুরনো মরার মতো। অথচ তাদের ভাবনার বিষয় ছিল ‘আগুন’। যে আগুন পুড়বে শত বছরের জঞ্জাল। শ্মশান এখানে সামগ্রিকতার প্রতীক হয়ে ফুটেছে। আলোময় বিশ^াস বোধের কবি। এ পর্যন্ত তাঁর ‘সময় চিহ্ন’, ‘ইভের মতো, ভালোবাসা’ কাব্য প্রকাশিত হয়েছে। সবটাতেই রয়েছে মানবপ্রিয়তার শব্দগুচ্ছ। কিছু নিজস্ব অনুভূতিও। ধারাবাহিকতায় তিনি সফল কবি। অনুজপ্রতীম এই কবির প্রতি রইল অনেক শুভাশিষ।

×