ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রসাত্মক বর্ণনায় অদ্বিতীয় ॥ শিবরাম চক্রবর্তী

অলোক আচার্য

প্রকাশিত: ২১:১২, ৩ নভেম্বর ২০২২

রসাত্মক বর্ণনায় অদ্বিতীয় ॥ শিবরাম চক্রবর্তী

শিবরাম চক্রবর্তী

সাহিত্যে মানেই রসবোধ। অবশ্য সে রস সবার জন্য নয়। সকলে সাহিত্যের রস আস্বাদন করতেও জানে না। আবার সব ধরনের লেখাতে সে রসের সন্ধান মেলেও না। মানে কাঠখোট্টা টাইপের রচনা। তবে যে রচনাগুলো মানুষের গোমড়া মুখেও হাসির সঞ্চার করে সেগুলোতে না হেসে পারা যায় না। সেসব লেখা এবং সেই ধাঁচের লেখক আলাদা। অর্থাৎ আমি রম্য লেখকের কথা বলছি। সে হতে পারে মজার কোন ছড়া, কবিতা, গল্প বা একটা গোটা উপন্যাস।

রম্য লেখকদের নিজেদের হাস্যরসাত্মকপূর্ণ মনোভাব থাকে। নিজেকেও প্রচুর হাসতে হয়। রম্য রচনাগুলোর শব্দ চয়ন, বাক্য এবং কাহিনীর ধারাবাহিকতা বর্ণনায় রম্য মানে হাসির উপাদান থাকে। এরকম লেখকেরও কমতি নেই। মানুষকে আনন্দ দিয়েই তাদের প্রশান্তি। যেমন ধরা যাক সুকুমার রায়ের কথা। তার ছড়ায় তো হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যায়। এত মজার যে শুধু পড়তেই ইচ্ছে করে।

আবার বলা যায়, সৈয়দ মুজতবা আলী, বিনয় ঘোষ, বিমলা প্রসাদ মুখোপাধ্যায়, বিনয় মুখোপাধ্যায়, গৌর কিশোর ঘোষ প্রমুখ রথী-মহারথীরা রম্য লিখেছেন। আরও অনেক লেখক রম্য রচনা করেছেন এবং এখনও রম্য লিখছেন অনেকেই। অবশ্য রম্য রচনার মধ্যেও একটি বার্তা থাকতে পারে। যা বুঝে নিতে হয়। শিবরাম চক্রবর্তীর লেখাতেই রয়েছে। রম্য লেখার তালিকায় আরও অনেকেই রয়েছেন।

তবে সবার মধ্যে একজন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যার প্রায় সব লেখাই আপনাকে আনন্দ দিতে পারে। তবে তা ছড়া নয়, গল্প। তিনি হলেন শিবরাম চক্রবর্তী। শিবরাম চক্রবর্তী কেন আলাদা তা বোঝানোর জন্য তার বিশাল রম্য গল্পের ভান্ডারই উদাহরণ হিসেবে যথেষ্ট। একটি পরিপূর্ণ রম্য ধারা তিনি উপহার দিয়েছেন বাংলা সাহিত্যে। সাধারণ ঘটনাগুলোও যার হাত ধরে অসাধারণ একটি হাসির গল্প হয়ে উঠতো তিনিই শিবরাম চক্রবর্তী।

শিবরাম চক্রবর্তীর কথা বাংলা সাহিত্যে যারা একটু আধটু বিচরণ করেন তারা সকলেই জানেন তার কথা, তার সৃষ্টিকর্মের কথা। অবশ্য যে মানুষটি আজীবন মানুষকে আনন্দ দিয়ে গেছেন তিনি নিজে কিন্তু খুব বেশি সুখে ছিলেন না বরং দৈন্যদশায় কাটিয়েছেন শেষ জীবন পর্যন্ত। এখানেই ম্যাজিক। আবার এটাকে নিয়তিই বলতে পারেন।

নিজে খারাপ অবস্থার মধ্যে থেকেও তিনি অন্যকে আনন্দ দেওয়ার উপাদান খুঁজে বেড়িয়েছেন। এটাই বা কয়জন পারে। শিবরাম চক্রবর্তী ১৯০৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর কলকাতার দর্জিপাড়ায়, নয়ানচাঁদ দত্ত লেনে জন্মগ্রহণ করেন। বাড়িটি তার দাদা মশাইয়ের ছিল।

তার কিশোর বয়স কাটে পাহাড়পুর ও চাচলে। তার বাবা শিবপ্রসাদ চক্রবর্তীও নাকি কিছুটা সন্ন্যাসী প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। এই বাব শিবরাম চক্রবর্তীর মধ্যেও ছিল। স্কুলে থাকতে তিনি স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে জেলে যান। তার সঙ্গে পরিচয় ঘটে দেশবন্ধু মিত্রের। তার জীবন ছিল বৈচিত্র্যতায় পরিপূর্ণ। তিনি জীবনে বহু স্থানে কাজ করেছেন। তিনি রাজনীতি করেছেন, দেশকে ভালবেসে জেল খেটেছেন, রাস্তায় কাগজ ফেরি করেছেন, ফুটপাথে রাত্রিবাস করেছেন, সাংবাদিকতা করেছেন। মোটকথা এক  বৈচিত্র্যতাপূর্ণ জীবন ছিল না।

তবে জীবনের বেশিরভাগ সময় থেকেছেন একটি কক্ষেই। তিনি বিজলী ও ফরওয়ার্ড পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন এবং যুগান্তর পত্রিকার প্রকাশকও ছিলেন। তার জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতোভাবে জড়িয়ে আছে উত্তর কলকাতার মুক্তারাম বাবু স্ট্রিটের একটি মেসবাড়ি। এখানে তিনি কেমন ছিলেন তা তার নিজের ভাষাতেই বর্ণনা করা যায়। তিনি বলতেন, মুক্তারামের তক্তারামে শুক্তোরাম খেয়ে আরামে আছেন। তিনি মানসিকভাবে তৃপ্ত ছিলেন।

এই মুক্তারামে তার থাকা রুমটির ভেতরে চারপাশে অসংখ্য লেখাজোঁকা ছিল। সেখানে তিনি অনেকের নাম, যেগাযোগের ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ নানা তথ্য লিখে রাখতেন। এটাই ছিল তার খাতা। নিজে আর্থিক দুর্দশায় থাকলেও বাইরে থেকে তা বোঝার উপায়টি ছিল না। অথচ তিনি জন্মেছিলেন রাজবাড়ির উত্তরাধিকারী হয়ে। ভাগ্যের পরিহাস এবং তার স্বজাত দক্ষতা নিয়ে তিনি ঠিকই সব প্রতিকূলতা জীবনভর সামলে নিয়েছেন। তার কাছে পার্থিব সম্পদ, বিলাসবহুল জীবনযাপন এসব উপভোগ করতে চাননি কোনদিন।

হাসি দিয়েই তিনি দুঃসময় পরিস্থিতিকে সামলে নিয়েছেন। প্রশ্ন করতেই পারেন তিনি এত রস কোথায় পেলেন? কারণ তার প্রায় সব রচনাই রসাত্মক। অর্থাৎ আপনাকে নির্মল আনন্দ দিতে সক্ষম হবে তার রচনা। তিনি নিজেও এত হাস্যরস নিয়ে থাকতেন যে কাউকে বুঝতে দিতেন না। তিনি নিজেকে আড়ালে রাখতেই পছন্দ করতেন। তার লেখাগুলো যদিও জনসম্মুখে এসেছে কিন্তু তিনি এতে খুব বেশি আগ্রহী ছিলেন না। কবিতা দিয়ে সাহিত্য সাধনার শুরু হলেও তিনি লিখেছেন গল্প এবং তা রম্যে ভরা।
তিনি শৈশব থেকেই দুরন্ত ছিলেন। ছোটবেলায় তিনি একবার বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। পরে সেই অভিজ্ঞতা থেকেই লিখেন ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ যা পরবর্তীতে চলচ্চিত্রে রূপান্তর হয়েছিল প্রখ্যাত ঋতিক ঘটকের হাত ধরে। কবিতা দিয়ে শুরু হলেও তিনি বিখ্যাত হন হাস্যরসাত্মক গল্প লিখে। তার ফিচারগুলোও হাস্যরসে পূর্ণ ছিল। তার বক্তব্য বা উক্তিগুলোও হাস্যরস পূর্ণ। যেমন তিনি বলেছেন, বহু বছরের পরিশ্রমের পর আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, নতুন বছর, নতুন বছর বলে খুব  হৈ চৈ করার কিছু নেই।

যখনই কোন নতুন বছর এসেছে, এক বছরের বেশি টেকেনি...। এমন একটি হাস্যরসাত্মক উক্তি আর কয়টি পাওয়া যাবে বাংলা সাহিত্যে? এমনই আনন্দের মানুষ ছিলেন তিনি। এবার তার হাসির গল্পের উদাহরণে আসা যাক। তার বহুল পঠিত একটি গল্প হলো, গুরুচন্ডালী। এই গল্পের মূল চরিত্র ‘সীতানাথবাবু’ একজন হেড পন্ডিত। তিনি বাংলা পড়াতেন।

তিনি ছাত্রছাত্রীদের লেখার ভেতর গুরুচন্ডালী মানে সাধু ও চলিত ভাষার মিশ্রণ মোটেই সহ্য করতে পারতেন না। এটাই গল্পের শেষে সীতানাথবাবুর হিতে বিপরীত হয়। গল্পটি এগিয়েছে হাস্যরসাত্মকভাবেই। এরকম বহু সংখ্যক গল্প তিনি লিখেছেন। লেখকের শিবরাম নামটি অনেক স্থানেই শিব্রাম পাওয়া যায়। এই দুই-ই একই ব্যক্তি। তাকে হাসির রাজাও বলা হয়।

জানা যায়, হাসির রাজা এই মানুষটি জীবনে লেখালেখির সঙ্গে খুব ভালোবাসতেন তিনটে জিনিস। এর মধ্যে প্রথমেই রয়েছে খাওয়া। তিনি বাইরের খাবার প্রচুর খেতেন। এ নিয়ে মজার ঘটনাও রয়েছে। এরপর ঘুম এবং সিনেমা দেখাও তিনি পছন্দ করতেন। তার অসংখ্য সৃষ্টিকর্মের মধ্যে অন্যন্য স্থান দখল করে আছে ‘ঈশ^র, পৃথিবী, ভালোবাসা (১৯৭৪)। এটি প্রথমে দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয় এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।

তিনি জীবনে যেমন নিজেকে নিয়ে কোনদিন ভাবেননি, একইরকমভাবে জীবন যাপন করেছেন সেভাবেই তার অনেক লেখাই যত্নে রাখতে পারেননি। অর্থের সমস্যা দূর করতেই তার লেখালেখি শুরু হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা দূর হয়নি। বরং শেষ পর্যায়ে তাকে নিদারুণ অর্থ কষ্টে পরতে হয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাকে মাসিক ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করে। ২৮ আগস্ট, ১৯৮০ সালে কলকাতায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সারাজীবন তার লেখা মানুষকে হাসিয়েছে, আনন্দ যুগিয়েছে। সেই মানুষটিও অভাবে থাকলেও নিরানন্দ ছিলেন না। রম্য লেখার বিষয়টিকে তিনি এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। এ জগতে তিনি অদ্বিতীয় বলা যায়।

×