ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

লেখনীতে যার মুক্তির বার্তা

অলোক আচার্য

প্রকাশিত: ০১:৩১, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২

লেখনীতে যার মুক্তির বার্তা

কাজী মোতাহার হোসেনে

‘কোন্ জাতি কতটা সভ্য, তা নির্ণয় করবার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মাপকাঠি হচ্ছে তার শিক্ষাব্যবস্থা,পাঠ্যপুস্তক ও সাধারণ সাহিত্য’- এমন প্রগাঢ় জ্ঞানগর্ভ উক্তিটি প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব কাজী মোতাহার হোসেনের। একটি উঁচুমানের সভ্যতা গড়ে তুলতে হলে তার থেকেও উঁচুমানের সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা হওয়া প্রয়োজন। সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা একটি সমাজকে নিবিড়ভাবে পথনির্দেশ করে। সেই সমাজের সাহিতচর্চার ধরন যত উৎকৃষ্ট তত সমাজের মুক্তি ঘটে। জাতির মঙ্গলের জন্যই সমাজে ইতিবাচক ধ্যান- ধারণা প্রতিষ্ঠিত হওয়া দরকার।

আর তার পথনির্দেশ করে শিক্ষা ব্যবস্থা,সাহিত্যচর্চা ও সংস্কৃতি। তাঁর প্রবন্ধগুলোতে রয়েছে গভীর উপলদ্ধি সত্য, সঠিক পথনির্দেশনা যা সাহিত্য ও সংস্কৃতির উৎকর্ষ সাধনের মাপকাঠি। বাংলা সাহিত্যে প্রবন্ধ একটি ভাবগাম্ভির্যপূর্ণ বিষয় হিসেবে পরিগণিত হওয়ায় একটি সার্থক প্রবন্ধ রচয়িতা খুব বেশি পাওয়া যায় না। হয়ত এতে কিছুটা কাঠিন্য থাকে এবং ভাবের প্রকাশের চেয়ে জীবনের খাঁটি সত্যই তুলে আনা হয়। তবে সাহিত্যের পথনির্দেশে প্রবন্ধ সাহিত্যই অগ্রগামী এবং কাজী মোতাহার হোসেন একজন সার্থক প্রবন্ধকার।

কাজী মোতাহার হোসেন যেমন প্রবন্ধকার হিসেবে স্বীকৃত, তেমনি তিনি সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, দাবাড়ু, সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবেও তাঁর যথেষ্ট খ্যাতি রয়েছে। মূলত তিনি বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন একজন ব্যক্তিত্ব। সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে তাঁর স্বাধীন চিন্তা ভাবনা এবং গভীর দৃষ্টিপাত আলোচনা বাংলা সাহিত্যের অমর সম্পদ হয়ে আছে। তাঁর ‘মনুষ্যত্ব’ নামক প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ’মানুষের মধ্যে দুটি সত্তা- জীবসত্তা আর মানবসত্তা।

জীবসত্তার কাজ প্রাণধারণ আত্মরক্ষা ও বংশরক্ষা। এখানে মানুষ বৈশিষ্ট্যহীন, প্রাণী জগতেরই একজন- অপরাপর প্রাণীদের মতো ক্ষুৎপিপাসায় কাতর হয়ে ছোটাছুটি করা তার কাজ। আর এর সাথে তিনি আরেকটি সত্তার কথা উল্লেখ করেছেন যা মানুষকে অপরাপর প্রাণীদের পশ্চাতে ফেলে এসেছে এবং সেই সত্তার নামই মনুষ্যত্ত্ব। লেখক এই প্রবন্ধে দুটি সত্তাকে ভালোভাবে আলাদা করেছেন এবং বুঝিয়ে দিয়েছেন কোন্ সত্তার দরকার কোথায়। তিনি বলেছেন, অপ্রয়োজনের জগৎ মনুষ্যত্বের জগৎ, এখানেই মানুষ আত্মার লাবণ্য অনুভব করে। প্রেম, সৌন্দর্য ও আনন্দ না হলেও প্রাণধারণের ক্ষতি হয় না, বাঁচার জন্য এরা একান্ত প্রয়োজনীয় নয়, কিন্তু মানুষের মতো বাঁচতে হলে এসব না হলে চলে না।
আজ আমরা যে কেবল টাকার পেছনে, আমাদের ভোগবিলাসের পেছনে ছুটছি, তার সাথে মনুষ্যত্বের কোন যোগসূত্র নেই। উপরন্তু এসব আমাদের উপলদ্ধিই করতে দেয় না যে, মন নামক কোন বস্তু রয়েছে এবং তারও চাহিদা আছে, সেই চাহিদাও পূরণ করা প্রয়োজন এবং সেই চাহিদা পূরণে খুব বেশি টাকা-পয়সার দরকার হয় না, আর তার নামই মনুষ্যত্বের চাহিদা। এই যে আজ সারাবিশে^ ভোগবাদিত্বের জয়গান চলছে, সেখানে মনুষ্যত্বের কোন অস্তিত্ব নেই কিন্তু প্রাণের অস্তিত্ব ঠিকই আছে! তার মানে সেখানে প্রাণীর অস্তিত্ব আছে কিন্তু মনুষ্যত্ব নেই। এর জন্য মানুষের অস্তিত্ব বড় দুর্লভ বস্তু হয়েছে।

আর তাই লেখক এই প্রবন্ধে মনুষ্যত্বকেই মানব দেহরূপ ঘরের ওপরের তলা এবং জীবসত্তাকে নিচ তলা বলে সাজিয়েছেন। এক সত্তা থেকে অন্য সত্তায় পৌঁছানোর মই হিসেবে শিক্ষার কথা বলেছেন। আমরা আজ যেদিকে চলছি বা যে শিক্ষা আমাদের শুধু নিচের তলার সন্তুষ্টির উপাদান হিসেবে কাজ করছে, তাতে আত্মার স্বাদ অনুপস্থিত। তার মতে, আত্মার স্বাদ পেতে চাই সাহিত্য, শিল্প। এখানেই তিনি সাহিত্যের গুরুত্বকে বাড়িয়ে দিয়েছেন।

তবে সে স্বাদ আজ আর কতজন পায়? আত্মার স্বাদ আস্বাদনের শখ আজকাল আর দেখা যায় না, বরং জিহ্বার স্বাদ আস্বাদনেই ব্যস্ত থাকতে হয়। প্রাণধারণের জন্য এটাই এখন সর্বপ্রথম পদক্ষেপ। আর তাই মনে হয় মানবজাতি ক্রমশই আত্মামৃত এক জাতিতে পরিণত হচ্ছে, যেখানে মনুষ্যত্ব কমছে আশঙ্কাজনক হারে। যদিও এ শব্দটির গুরুত্বই আজকাল মানুষ কম বোঝে। সাহিত্যতৃষ্ণাই আজকাল কেউ বুঝতে পারে না।
কাজী মোতাহার হোসেন ৩০ জুলাই ১৮৯৭ সালে কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী থানার লহ্মœীপুর গ্রামে তাঁর মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা কাজী গওহরউদ্দীন আহমদ ছিলেন সেটেলমেন্টের আমিন। তাঁর মায়ের নাম তাসরুন্নেসা। তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ^াসী হয়ে শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির শক্তি গড়ে তুলতে প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি মুসলিম সাহিত্য সমাজ গড়ে তোলেন এবং এসময় তাঁর সাথে ছিলেন কাজী আব্দুল ওদুদ, সৈয়দ আবুল হোসেন ও আবুল ফজলের মতো বহুগুণী ব্যক্তিত্ব।

বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন হয়েছিল তাঁর হাত ধরেই। বুদ্ধির মুক্তি এই শব্দদ্বয় বুঝতে গেলে আমাদের বুঝতে হবে যে, আমরা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সত্তাকে কিভাবে দিনের পর দিন আত্মার তাগিদ অনুভবের সুযোগ না দিয়ে বন্দী করে রেখেছি। তিনি বুদ্ধিকে সেই জায়গা থেকে মুক্ত করতে কাজ করে গেছেন। তিনি চিন্তা চর্চার প্রসারতার মাধ্যমে সঙ্কীর্ণতাকে দূরে ঠেলে দিয়েছেন। তিনি তাঁর ‘সংস্কৃতি কথা’ প্রবন্ধে বলেছেন, সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত কালচারের উদ্দেশ্য নয়- উপায়। উদ্দেশ্য নিজের ভেতরে একটা ঈশ^র বা আল্লা সৃষ্টি করা। যে তা করতে পেরেছে সে-ই কালচার্ড অভিধা পেতে পারে, অপরে নয়।

তিনি বলেছেন, অপরদিকে কালচার্ড লোকেরা সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে অন্যায় আর নিষ্ঠুরতাকে, অন্যায় নিষ্ঠুরতাকে তো বটেই, ন্যায় নিষ্ঠুরতাকেও। মানুষকে ন্যায়সঙ্গতভাবে শাস্তি দিতেও তাদের বুক কাঁপে। তিনি এর মাধ্যমে এমন একটি মানবব্যবস্থাকে বুঝিয়েছেন, যেখানে কোন হানাহানিই থাকে না, কোন ক্রোধ থাকে না, অন্যের আঘাতের চিন্তাও আসে না। কালচার্ড শব্দ বলতে আমরা যা বুঝি তার থেকে অনেক বেশি প্রসারিত এক চিন্তা দ্বারা তিনি শব্দটিকে মজবুত করেছেন এবং পাঠকের চোখ খুলে দিয়েছেন। তিনি বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন গড়ে তোলেন।

বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন সব ধরনের কুসংস্কারমুক্ত হয়ে প্রগতিশীলতা ধারণ করা শেখায়। সে সময় বাংলার মুসলমান সমাজে তৎকালীন সময়ের যে কুসংস্কার ও কুপ্রথা ছিল তা থেকে মুক্তি দিতেই বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন গড়ে ওঠে। শিখা নামক একটি পত্রিকাও তিনি সম্পাদনা করেন। এই শিখা পত্রিকার সংখ্যাগুলোতে লেখা থাকত- জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব। তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, বাঙালীকে প্রথমে তার চিন্তা-চেতনায়-ধ্যানে পরিবর্তন আনতে হবে, কুসংস্কারের শৃঙ্খল ভাঙতে হবে। সত্যকে জানতে হলে জ্ঞানের প্রয়োগ করতে হয়, বাইরের চোখ দিয়ে নয়, অন্তরের বিবেক দিয়ে এবং যুক্তি দিয়ে কাঠামো দাঁড় করাতে হয়।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে তাঁর বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক ছিল। তিনি একজন দক্ষ দাবাড়ু ছিলেন। এদেশে দাবা খেলায় তাঁর বিশেষ অবদানও রয়েছে। কাজী মোতাহার হোসেনের চিন্তা-চেতনা ছিল আধুনিক এবং মুক্ত। তিনি বলেছেন, যৌনতৃপ্তির উপায় কামকে প্রেমের সাথে যুক্ত করা। শুধু কামে তৃপ্তি নেই, তা পরিণামে ক্লান্তি ও অবসাদ নিয়ে আসে। প্রেমের সঙ্গে যুক্ত হয়েই কাম স্নিগ্ধ ও তৃপ্তিকর হয়ে ওঠে। অথচ সমাজ বিয়ে মারফতে কামের দ্বারটি খোলা রাখলেও প্রেমের দ্বারটি বন্ধ করে দিয়েছে।

এখানে উল্লেখ্য, কাম শারীরিক আর প্রেম মনের সৌন্দর্যবোধ বলেই অনুমান করতে পারি। এত বছর আগে এই উচ্চারণই তো সাহসী। যেখানে আমরা আজও বহু মানুষ এই ফারাক বুঝতে ব্যর্থ এবং নিজের প্রেম ও কামকে একসাথে মিশিয়ে একটি একাধিপত্য সমাজ প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে চলেছি, সেখানে কত আগেই এই সত্য বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি। কামের সাথে প্রেম না থাকলে তা শেষ পর্যন্ত ক্লান্তি এবং শারীরিক অত্যাচারই হয়। এ বিষয়ে আরও আলোচনা আছে এই প্রবন্ধেই। বুদ্ধি নিয়েও আজ আমাদের নিজস্ব মতামত আছে। আমরা সচরাচর বুদ্ধি বলতে জ্ঞানকেই বোঝাই। আবার যার যত বুদ্ধি সে তত চতুর এটাও মনে করি। বুদ্ধি আমরা যেভাবে কাজে লাগাব সেভাবেই তা আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করবে।
এ বিষয়ে তিনি উদাহরণ টেনে বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ যদি তাঁর বুদ্ধিকে সাহিত্য,শিল্প ও বিশ^চিন্তায় না লাগিয়ে ব্যারিস্টারি কাজে লাগাতেন, তো তাঁর বুদ্ধির উন্নয়ন না হয়ে অবনতিই ঘটত এবং তিনিও মনীষীর মর্যাদা না পেয়ে একজন সুচতুর আইনজীবীর সম্মান লাভ করতেন। তাহলে বলতে পারা যায়, মানুষের মূল্য নির্ধারণের বিষয়ে বুদ্ধির প্রাচুর্য নয়, উৎকর্ষই গণনার বিষয় (নিবন্ধ-মূল্যবোধ ও যুক্তিবিচার)।

মানুষের প্রাপ্ত এই জীবন এক অসামান্য প্রাপ্তি। বাইরে নয়, ভেতরেই রয়েছে সব সুন্দর অসুন্দরের বোধ। লেখক বেশ ভালভাবেই এই বোধ উপলব্ধি করতে পেরেছেন। ব্যর্থতাই যে সফলতার চাবিকাঠি- মানব সভ্যতার ইতিহাসে এ নিয়ে প্রভূত উদাহরণ টানা যায়। কিন্ত কাজী মোতাহার হোসেনের মতো এমন বিশ্লেষাত্বকভাবে বুঝিয়েছেন এমন সংখ্যা কমই আছে।
তিনি ’ব্যর্থতা জিন্দাবাদ’ এ লিখেছেন- আপনি কি জানেন না, সমাজমরু সবসময়ই প্রতিভা তরুর রস শুষে নিতে চায়; যখন পারে না, তখন শত নির্যাতন সত্ত্বেও তরুটি ফুল ফোটায়, তখনই সে বলে ওঠে; দেখ দেখ কেমন ফুল ফুটিয়েছি।

যেন এই ফুল ফোটানোর বাহাদুরিটা তারই। সমাজের মতো বেহায় আর কে আছে? আপনি যে পথে চলতে চেয়েছিলেন সে পথেই চলুন। দেখবেন সার্থক হলে পরিবারের লোকেরা আপনাকে গলার মালা করেই রাখবেন, না হলে অবশ্য ভিন্ন কথা। কিন্তু সার্থক না হলেই যে আপনার জীবনটা বরবাদ হয়ে গেল তা নয়। বরং আপনার মতো ব্যর্থ লোকেরাই সমাজকে সমৃদ্ধ করে তোলে। যে সমাজে যত ব্যর্থ লোকের বাস সে সমাজ তত ধনী। এমনভাবে ব্যর্থতার ভেতর জীবনের জয়গান আর কারও লেখায় পাইনি।

এখান থেকে অনুপ্রেরণা পাই এবং সমাজ শিক্ষাও পায়। শুধু সফল একজনকে নিয়ে সমাজ চলতে চায়, ব্যর্থদের দূরে ঠেলে দেয়। কিন্ত আদতে সেই সফল মানুষটিও কোন ব্যর্থতা থেকেই একসময় সফল হয়েছে। তার খোঁজ আর কেউ রাখে না। তার কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বহু সম্মাননায় ভূষিত হন। ১৯৬৬ সালে প্রবন্ধসাহিত্যের জন্য তাঁকে দেয়া হয় বাংলা একাডেমি পুরস্কার। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে সম্মানিত করেন। এমন একজন গুণী মানুষের জন্য আমরা গর্বিত।

×