
ধূসর ক্যানভাস
রাত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। গাঢ় অন্ধকার এখন অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে। শীতের রাতের শেষে চারদিকজুড়ে কুয়াশার চাদর ছড়িয়ে আছে যেন কান পাতলে জলের ফোঁটার মতো জমাট শিশির টুপটাপ ঝরে পড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে এখান-ওখান থেকে। পূবের আকাশে লাল আহলার আভা দেখা যাচ্ছে। আস্তে আস্তে বাড়ছে। সূর্য উঠছে। কিছু পরেই লাল আলো ভোরের রোদ হয়ে ছড়িয়ে পড়বে সবখানে।
ঠিক এসময়েই নয় বরং এর কিছুটা আগে আগে স্বাভাবিক নিয়মে ঘুম ভেঙ্গে যাবে সত্যব্রতর। দীর্ঘদিনের অভ্যাস। ঘুম ভেঙ্গে গেলে মিনিট পাঁচেক চুপ করে শুয়ে থাকবেন। তাকাবেন এদিক-ওদিক। তখনও সব পরিষ্কার দেখা যায় না ঘরের ভেতরে। আবছা অন্ধকার যেন ঝুলে আছে আসবাবপত্র আর ঘরের অন্যান্য জিনিসপত্রের সঙ্গে।
সত্যব্রত শুয়ে শুয়ে ভাবতে থাকেন আজ কোন কাজ আছে কিনা। যদিও এখন তেমন কোন জরুরী কাজটাজ থাকে না। অন্যান্য লোকজন আছে, তারা করে। কখনও কখনও মনে করিয়ে দেয়াটাই তিনি করে থাকেন। এজন্য মনে রাগ হয় না কারণ কমবয়সী ছেলে ছোকড়াদের কত কাজ অকাজ আর চিন্তাভাবনা থাকে। তার মতো ষাট ছাড়ানো মানুষদের সেসব থাকবে কেন? কারণ ধীরে ধীরে তো ঘরমুখী হয়ে গেছেন তিনি। প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে দূরে কোথাও যেতে মন চায় না। ষাট ছাড়িয়ে সত্তর ছুঁই ছুঁই বয়স এখন সত্যব্রতর। তিনি বলেন- ষাট পেরুনো। তাতে মনের সান্ত¦না মেলে, শরীরের শক্তি বাড়ে না। মনেরও না।
বিছানা ছেড়ে উঠে দুবার শুরকুদ করে পর পর দুই গ্লাস জল খান সত্যব্রত। এ অভ্যাসটাও দীর্ঘদিনের। এতে পেটটা একটু নরম হয়। তবে এই নিয়মটা মেনে চলার কারণেই হয়তো এতদিনেও তিনি পেটের তেমন কোন গোলমালে পড়েননি। অথচ তার বয়সী অনেকেই এখন, এই বয়সে এসে বা তার কিছু আগে থেকেই আই বা অন্য কোন ঝামেলায় জড়িয়ে গেছেন। ফলে খাবার-দাবারের উৎসাহ কমে গেছে বা কোন না কোন হজমি ওষুধে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
তবে সত্যব্রতর শরীরের জন্য সবচেয়ে যে বড় সুবিধা সেটা হলো- ডায়াবেটিস না থাকা। এ রোগটি মানুষকে ধীরে ধীরে প্রায় স্থবির করে দেয়। কন্ট্রোলে রাখতে পারলে তবু রক্ষে, না হলে যখন তখন বড় ধরনের শারীরিক ঝামেলায় পড়ে যাওয়া বিচিত্র কিছু নয়।
বাড়ির চারদিকের গাছ গাছালিতে নানা ধরনের পাখির কিচির-মিচির শুরু হয়ে গেছে। অর্থাৎ ভোরের আলো পৌঁছে গেছে ওদের কাছে। তাই ঘুম ভেঙ্গে খাবারের খোঁজে নামার সময় হয়ে গেছে। তাই ওদের এত চেঁচামেচি আর ওড়াওড়ি।
সত্যব্রত এবার দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন। দুই তিনবার বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলেন। সমস্ত শরীর থেকে ঘুমের জড়তা অনেকটাই যেন কেটে গেল। ভোরে উঠানের ওপর দাঁড়িয়ে পূবদিকে মুখ করে কপালে হাত তুলে সূর্যপ্রণাম করলেন। বিড়বিড় করে মন্ত্র আওড়ালেন অস্ফুট স্বরে।
এই প্রাত্যহিক নিয়মটা বছরের পর বছর ধরে পালন করে আসছেন সত্যব্রত। তবে কখনও কখনও যে ব্যত্যয় হয়নি, তেমন নয়। যখন বাইরে কোথাও গিয়েছেন বাড়ি ছেড়ে তখন হয়েছে। তবে বাড়িতে থাকলে গ্রীষ্ম শীত বর্ষাÑ কখনও নিয়মের ব্যত্যয় হয়নি।
কোথায় কী একটু শব্দ হলো। সত্যব্রত সামনের দিকে তাকালেন। শব্দের উৎস খুঁজতে চাইলেন। দেখলেন দুটো শালিক উড়ে এসে নেমেছে উঠানের ওপর। সেখানে ঠোঁট দিয়ে টুক টুক করে কিছু তুলে নিচ্ছে। উঠানের পূবদিকে তিন-চারটা আমগাছ আছে, পাশে একটা কাঁঠাল গাছ, কয়েক বছরের মধ্যে গাছগুলো বেশ বড় হয়ে গেছে। একটু দূরে আছে দু’তিনটে সুপারী গাছ।
আশপাশের সব গাছগুলোকে ছাড়িয়ে মাথা তুলেছে আকাশের দিকে। গাছ-গাছালির ফাঁক দিয়ে একটা পায়ে চলা কাঁচা সরুপথ চলে গেছে দক্ষিণের বাগানের ওপাশে রেবতীদের বাড়িতে। রেবতী সত্যব্রতর খুড়তো ভাই। ওই বাড়িতে তারা বেশ কয়েকজন একসঙ্গে থাকে। সকাল-বিকাল আসা-যাওয়া আছে। যখন-তখন কেউ না কেউ এ বাড়িতে আসে বা যায়।
কিছু সময়ের মধ্যেই আরও ফর্সা হয়ে গেল চারদিক। পূবদিকের গাছগুলোর পাতায় শিশির জমে আছে এখনও। ভোরের রোদ পড়ে চিক্ চিক্ করছে। চোখ পুড়ানো হাল্কা সবুজ রঙের নতুন পাতাগুলোর ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো এসে পড়েছে উঠানের ওপর। সত্যব্রত গভীর মমতা মাখানো দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছেন সেদিকে। যদিও এমন দৃশ্য নতুন নয় তার কাছে।
প্রায় প্রতিদিনই একা একা চারদিকের গভীর নৈঃশব্দের মধ্যে এমন দৃশ্য তার চোখে পড়ে। কিন্তু আজ কেন যেন মনে হচ্ছে এমন দৃশ্য তিনি আর হয়তো দেখতে পারবেন না কিছুদিন পরে। বুকের ভেতর থেকে গভীর শূন্যতা মাখানো একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এসে ভোরের হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।
কাল সারারাত প্রায় ঘুমাতেই পারেননি সত্যব্রত। বারবার মনে হয়েছে আসলে সিদ্ধান্তটা কি ঠিক নিয়েছেন না কি ভুল নিয়েছেন ওদিকে যাবার কথা বলে। যদি ওপারে যেতে না চাইতেন তবে তো এখানেই থেকে যেতে পারতেন জীবনের শেষ কটা দিন। কিন্তু পরিবারের অন্যদের কথা ভেবেই এ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে তাকে। বিষয়টা নিয়ে ভেবেছেন দিন সাতেকের কম নয়।
বারবার দোনামোনা করে শেষ পর্যন্ত এ রকম একটা সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে। তার একার সিদ্ধান্ত তিনি তো সবার ওপর চাপিয়ে দিতে পারেন না। সংসারে সবার বড় হবার যেমন কিছু সুবিধা আছে, তেমনি অসুবিধাও কম থাকে না।
সত্যব্রত কিছুটা সময় হাঁটলেন উঠানে। এক সময় শালিক দুটোকেও উড়ে যেতে দেখলেন। আশপাশের গাছপালাগুলো ঝলমল করছে সূর্যের আলোয়। সত্যব্রত ধীরে ধীরে হেটে চলে এলেন বড় ঘরের বারান্দায়। বারান্দায় ঢুকেই টের পেলেন ভেতরের লোকজনেরও ঘুম ভেঙ্গেছে। তাদেরও বিছানা ছেড়ে কাজকর্মে যাবার সময় হয়েছে।
বেশ কিছুক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হেটেও ছিলেন উঠানের চৌহদ্দির ভেতরে। ফলে কিছুটা ক্লান্তি বোধ করছিলেন সত্যব্রত। তাই ঘরের ভেতরে ঢুকতেই বসার ইচ্ছে হলো। দরজার কিছু দূরের চেয়ারটায় গিয়ে বসলেন এবার। বসার সময় হাঁটুর হাড়ের জোড়ায় একটু মট করে শব্দ হলো কিনা ঠিক বুঝতে পারলেন না। কিন্তু আলগা একটু ব্যথার মোচড় ঠিকই টের পেলেন। পরিষ্কার বুঝতে পারলেন, বয়স হয়েছে। ইচ্ছেমতো হাঁটাচলা বা দৌড়ঝাঁপ করার দিন শেষ। এবারে হাঁটাচলা হবে মেপে ঝেপে। বুঝে শুনে।
এটুকু চিন্তার মধ্যেই সেই বড় চিন্তাটা আবার এসে গেল। তাইতো, বেশ রাতে কাল ঘুমাতে পেরেছিলেন নানা দুশ্চিন্তার মধ্যে। এক সময় তার অজান্তেই বোধ হয় ঘুম এসে গিয়েছিল সব চিন্তাভাবনাকে ঢেকে দিয়ে। সত্যব্রত ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তবে তাতে তেমন কিছু অসুবিধা হয়নি। ঘুম কিছু কম হলেও যথাসময়ে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল ভোরের দিকে।
বসতে বসতে এবার নতুন করে আবার ফিরে এলো সেই চিন্তাটা। চল্লিশ পঞ্চাশ বছরের এই ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যেতে হবে নতুন ঠিকানায়। সেখানে কীভাবে আবার বসবাস শুরু হবে, সে চিন্তাতেই অস্থির হয়ে উঠেছেন সত্যব্রত মনে মনে। ছিটমহলের জীবন শেষ হবে এবার এই এতগুলো পরিবার আর মানুষের। বছরের পর বছর এই মাটিতে জীবন কেটেছে সবার। কত জন্ম মৃত্যুর ইতিহাস জড়িয়ে আছে এই মাটি, ঘরবাড়ি আর জল জংগলের সঙ্গে।
এই সবকিছুকে পেছনে ফেলে চলে যেতে হবে দূরে কোথাও। কোথায়, ঠিক জানাও নেই। এসব চিন্তাভাবনা মনের ভেতরে সময় অসময়ে একেবারে স্তব্ধ করে দিচ্ছে সত্যব্রতকে। আর ক’দিন তিনি বাঁচবেন, কে জানে! কিন্তু শেষের সেদিন কি আর খুব বেশি দূরে? জন্মমৃত্যুর কথা কেউ কি জানে! কখন যে নিঃশব্দে মৃত্যুদূত এসে কড়া নাড়বে সত্যব্রতর জীবনের দরজায়, সেটা কেউ কি জানে! সত্যব্রত না। তবে যে বয়স তখন নানারকম দুশ্চিন্তায় সময় কাটে সত্যব্রতর। শত চেষ্টা করেও মন থেকে সেসব সরাতে পারেন না। ভুলে থাকতে পারেন না।
দুশ্চিন্তা যে অন্যদের মনেও উঁকি দেয় মাঝেমাঝে, সেটাও স্পষ্ট বুঝতে পারেন তিনি। গতকাল নয়, পরশুদিন ছোটভাই দেবব্রত বলছিল, আমার কিন্তু আসলে দাদা ভয় করতিছে, কোথায় না কোথায় নিয়ে গিয়ে ফেলবে, কে জানে! একেবারে বিদেশ বিভুঁই মনে হবেনে। সেখানে কি নতুন করি ঘর বানাতে হবে, জমি জিরেতই বা পাব কোথায়, বুঝতে পারছিনে।
সে সবের কি ব্যবস্থা ওরা করবিনে! সত্যব্রত আস্তে আস্তে বলেন। কিন্তু কথার মধ্যে হতাশার সুরটা ঠিক ধরা পড়ে। কথায় তেমন জোর পাওয়া যায় না।
তুমিতো বলতেছ, দাদা। দেবব্রত বলে, আমাদের এই ব্রাহ্মণবাড়ির লোকজন এ তল্লাট ছাড়ি গেলে চারদিক তো আন্ধার হয়ে যাবে। ও বাড়ির রমাপদরা এখন বলতিছে এখান থিকা যাবে না। দেখবা, আমরা চলে গেলি, ওরাও থাকবেনি না। পরে যাওনের ঝামেলা আছে, বলেন সত্যব্রত, সরকারী লিস্টিতে নাম না থাকলে পড়ে গেলে কোন সুযোগ-সুবিধাই পাওন যাইবেনে না।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে, কী ভাবতে ভাবতে দেবব্রত সায় দেয় দাদার কথায়। বলে, ঠিক বলছো, দাদা। তোমার কথাই ঠিক। এখন যতটা সুযোগ-সুবিধা পাওন যাবে, পরে তা আর পাওন যাবেনি না। এসব কথা এখন পরিষ্কার মনে পড়ে সত্যব্রতর । আর তাতেই তিনি বুঝতে পারেন বাড়ির অরাদ্দ রীতিমতো অনিশ্চয়তায় ভুগছে। দুশ্চিন্তায় কাতর হচ্ছে। ঠিক এই মুহূর্তে কেন যেন তার ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায়। যদিও তখনকার সেইসব এখন কেমন ধূসরতায় ম্লান হয়ে এসেছে। মনে পড়ে যায় বাবার কথা।
বাবাও হয়তো এমনভাবে অনিশ্চয়তা আর দুশ্চিন্তায় ভুগছিলেন যখন নদীভাঙ্গনের মুখে পড়ে একদিন যা কিছু ছিল সবই নিয়ে এখানে চলে এসেছিলেন আরও দু’য়েকটা পরিবারের সঙ্গে। তারপরে এখানেই স্থিত হয়েছিলেন অনেক ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে। সত্যব্রতর বাবা গুরুপদ বেশ কয়েক বছর হলো মারা গেছেন। মৃত্যুর আগে তিনিও কিছুটা অস্বস্তিতে ছিলেন ছিটমহলের ঝামেলা নিয়ে।
কিন্তু কোন উপায় না দেখে সবকিছু তিনি অনেকটা বাধ্য হয়েই মেনে নিয়েছিলেন অন্যদের সঙ্গে। (এরপর ৯ পৃষ্ঠায়) মারা যাবার সময় যদিও বলে গিয়েছিলেন এসব এভােেব চিরদিন থাকবেনা, থাকতে পারে না। মানুষের জটিলতা সারাজীবন ধরে কেউ সহ্য করতে চায় না, জটিলতার শৃঙ্খল ভাঙ্গার জন্য সব সময় সে উন্মুখ থাকে, এটা প্রকৃতির নিয়ম।
সত্যব্রতর মনে হয়, সেই নিয়মেই বোধহয় আজকে দ্বিতীয়বারের মতো বাস্তুচ্যুত হতে হচ্ছে তাদের। সত্যব্রত মনে মনে হাসেন, দেশভাগের সময়ও তাদের পরিবার এই দেশ ছেড়ে ওদেশে যায়নি। জন্মভূমির মাটি কামড়ে পড়ে ছিল এদেশেই তার বাপ ঠাকুরদা। তবে তখন যদি সবাই ও দেশে মানে ভারতে চলে যেত তাহলে আজকে নতুন করে আর সেখানে যাবার প্রয়োজন হতো না।
যতই বয়স বাড়ছে ততই যেন স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ছেন সত্যব্রত। সেই কোন ছোট বেলায় কত না ঘটনা এখন যেন ছবির মতো চোখের সামনে ভেসে উঠছে।
তবে সেই স্মৃতির মধ্যেই বারবার ফিরে আসছে বাবার মুখ। দীর্ঘজীবন পেয়েছিলেন তিনি। একসময় প্রথম জীবনে শহরে সরকারী চাকরিতে ছিলেন। কিন্তু সে চাকরিতে শেষ পর্যন্ত থাকতে পারেননি। পারিবারিক কারণেই এক সময় গ্রামের বাড়িতে এসে আর ফিরে যাওয়া হয়নি তার। জায়গা জমি আর বাড়ির টান তাকে ধরে রেখেছিল গ্রামেই।
তারপর অন্য আর সবার মতোই, কিছু দূরের এক গ্রামের মেয়েকে পছন্দ করেন তার সঙ্গে বিয়ে দেয়া হয়েছিল বেশ ধুমধাম করে পারিবারিকভাবে। বাবাও এসব মেনে নিয়ে ধীরে ধীরে ওখানকার মানুষদের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন। তারপর আস্তে আস্তে নিজ বুদ্ধিবলে অর্থবিত্তে তুলনামূলকভাবে ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছিলেন সবার মধ্য থেকে।
গুরুপদ গাছপালা আর পাখি ভালবাসতেন। বাবার এই ভালবাসার কথা জানতেন সত্যব্রত ছোটবেলায়। দেখতেন বাবা কি পরম মমতায় ভোরবেলা পাখিগুলোকে ডেকে ডেকে খাবার দিতেন। এভাবে দিনের পর দিন ডাকা আর খাবার দেয়ার জন্য পাখিদের কাছে খুব বিশ্বস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। পাখিগুলো অনেক সময় তার হাত থেকে খাবার নিয়ে নিত। নির্ভয়ে আশপাশে ঘুর ঘুর করত।
গুরুপদ বলতেন, চারপাশে এই যে সবুজ প্রকৃতি পাখিদের মতো ওদেরও প্রাণ আছে। আমরা, মানুষেরা এই বিশ্বচরাচরের অনেক কথাই জানি না, বুঝতে পারি না। কিন্তু ওরা পারে। মানুষের চাইতে ওরা প্রকৃতি আর বনবনানীর অনেক কাছাকাছি থাকে। যতদিন যাচ্ছে প্রকৃতির কাছে মানুষ ক্রমশ অবিশ্বাসী হয়ে উঠছে। কারণ এই মানুষ নিজের স্বার্থ আর লোভের কাছে নিজেকে বিকিয়ে দিয়ে উজার করে দিচ্ছে প্রকৃতি থেকে সবুজ অরণ্যভূমি।
এই যথেচ্ছায় মানুষের প্রকৃতি আর কতদিন সহ্য করবে? এই সব কথা বলতে বলতে গুরুপদের চোখ জ্বল জ্বল করে উঠতো। বাবার এসব কথার প্রকৃত অর্থ সেই বয়সে বোঝেননি সত্যব্রত। পরে মনে হয়েছে তাহলে এই জন্যই কি ভূমিকম্প হয়! নিজের শক্তির জানান দেয় প্রকৃতিই? মানুষকে সতর্ক করে দেয়? এসব কথা ভাবতে ভাবতে বাবাকে কখনও কখনও যেন অচেনা মনে হতো সত্যব্রতর। বাবার কাছ থেকে আরেকটা অভ্যাস রপ্ত করেছেন সত্যব্রত। যে অভ্যাসটা এখনও আছে। মাঝে মাঝে চেষ্টা করেছেন এটাকে বাদ দিতে, কিন্তু পারেননি। কেননা যুগ যুগ ধরে চলে আসা অভ্যাসটাকে শেষ পর্যন্ত রয়েই গিয়েছে।
তবে সেটা দেড়যুগ আগে ছেড়েছেন সেটা হলো ধূমপানের অভ্যাস। শহরে চাকরি করার সময় অভ্যাস বা নেশাটা তাকে ধরেছিল বেশ ভালভাবেই কিন্তু বাড়িতে এসে ধীরে ধীরে ওই কু-অভ্যাসটিকে ত্যাগ করতে পেরেছিলেন। ধারণা ছিল, তিনি যদি ধূমপানের নেশায় আসক্ত না হন তা হলে তার সন্তানরাও এই নেশায় আসক্ত হবে না। তার এই উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল, সত্যব্রত কখনও ধূমপানে আসক্ত হননি।
তবে যে অভ্যাসটি তিনি ছাড়তে পারেনি সেটা হলো নিজে নিজে বারান্দার বাইরে আলগা চলায়। শুকনা নারিকেল পাতা দিয়ে জ্বাল দিয়ে দুধ চিনি ছাড়া এক বা দুকাপ চা খাওয়া। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে কিছুক্ষণ উঠান আর বাড়ির আশপাশে হাঁটাচলা করে ফিরে এসে চা বানিয়ে খাওয়া এখনও চলছে। আজও সেই আয়োজনই করছেন। এখন নানারকম চিন্তাভাবনার মধ্যেও সে আয়োজনের র্হের্ফে হয়নি।
হঠাৎ উঠানে কেউ যেন কথা বলছে মনে হলো সত্যব্রতর।
কিন্তু এত তাড়াতাড়ি বাড়ির বাইরের কেউ কি এলো? কারুর তো আসার কথা নেই এত ভোরে। তাহলে! হঠাৎ মনে হলো, আসেলে এখন আসবে তো রেবতী। ভোরবেলা জেঠুর সঙ্গে একটু চা খেতে সে প্রায় নিয়মিতই আসে ঘুম থেকে উঠে। এটা এখন তারও অনেকটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে।
সত্যব্রত যতই বাধা দেন, মৃদু বকাঝকাও করেন। কিন্তু কাজ হয় না। ও হেসেই সব উড়িয়ে দেয়, জেঠু আমার জন্য তোমার কত খরচ হয় বলতো? এ জন্য তুমি আমার সঙ্গে এ রকম কর?
আমি কি তাই বলছি নাকি রেÑ
গুরুপদ তাকান রেবতীর দিকে।
তা হলে, কী বলছ?
তোর যাতে এ সবে অভ্যেস না হয়ে যায়-
তাই যদি হবেনে তবে তোমার অভ্যাসটা ছাড়নি কেন?
চুপ করে থাকেন সত্যব্রত। এ কথার উত্তর দিলেও আবার নতুন কথা শুরু করবেÑ
কথা না-ই কেন, জেঠু?
হাসতে থাকে রেবতী, দাও, দাও তাড়াতাড়ি চাটা করতো জেঠু বেরুতে হবেনে একবার, তাড়া আছে। এবারও সত্যব্রত কোন কথা না বলে চা তৈরির কাজে লেগে যান। রেবতী শুকনো নারিকেল পাতাগুলো এগিয়ে দেয় জেঠুর কাছে। এই নাও, ধরোÑ
গুরুপদ মনে মনে হাসেন, এ পাগলকে যত তাড়াতাড়ি বিদেয় করা যায়, সেটাই ভালÑ
কিন্তু রেবতী থামে না। বলে, জেঠু, আসলে তোমরা কোথায় যাচ্ছো, সেটা কি ঠিক হয়েছে? কেউ তো ঠিকভাবে কিছু বলতে পারছিনেÑ নতুন করে আবার কোথায় কোন ঝামেলা বাধাবেনে, কে জানে!
রেবতীর গলায় শংকা ফুটে ওঠে।
চা হয়ে গিয়েছিল। একটা কাঁচের গ্লাসে চা ঢেলে রেবতীর দিকে এগিয়ে দেন সত্যব্রত, নে ধরÑ
রেবতী চা নিয়ে চুমুক দেয়। পরমুহূর্তেই একটু থামে তারপর হঠাৎ চেচিয়ে ওঠে, এই, আবার সেই কাজটাই তো করলে, জেঠুÑ
সত্যব্রত চমকে ওঠেন, আবার কী হলো রে!
চিনিই তো দাওনি। আমি কি তোমার মতো চিনি ছাড়া খাই?
তাই তো, অপরাধীর ভাব এনে মুখে সত্যব্রত রেবতীর হাতে থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে নেন, ভারি ভুল হয়ে গেলতোÑ দে, চিনি দিয়ে দিচ্ছিÑ
জেঠু এ কাজটা তুমি কিন্তু মাঝে মাঝেই করেেছা আজকাল, রেবতী বলতে থাকে, কী এতসব ভাবছো, তুমি? সব ভুলে যাচ্ছোÑ
বয়স হচ্ছে না, সত্যব্রত বলেন, তোর বয়স হলে তোরও এমনি হবে দেখিস্Ñ
সত্যব্রতর কথা শুনে কিছুক্ষণ অপলক তার দিকে তাকিয়ে থাকে রেবতী। পরে বলে, তাতো বুঝলাম, আমার বয়স হলি পরে তোমার মতো ভুলে যাব। তা তুমি সেটা দেখবে কেমন করি? তুমি তো আমাদের কাছে থাকছোনেÑ
তাইতোÑ! সত্যব্রত রেবতীর কথা শুনে থমকে যান হঠাৎ। চায়ের খালি হয়ে যাওয়া গ্লাস দুটো ধরেছিলেন একবার ধোবেন বলে। আনমনে কাপ দুটো আবার নামিয়ে রাখলেন নিচে। তাই তো, তুই তো ঠিকই বলেছিস্Ñ
আমি ঠিকই বলি, জেঠুÑ মৃদু মৃদু হাসে রেবতী, এখনও চিন্তা করি দ্যাখো, যাবে কি, যাবে নাÑ
সত্যব্রত কোন কথা বলেন না।
অপলকে শুধু তাকিয়ে থাকেন উঠোনের দিকে। উঠোনের ওপর এখন শাদা ফিতের মতো পড়ে থাকা ভোরের হালকা রোদের ঝিকিমিকি। ওপাশে হালকা সবুজ পাতার ওপরে ছোট ছোট পাখিদের ওড়াওড়ি চলছেই। আস্তে আস্তে রোদ বাড়ছে। আশপাশের বাড়িগুলো থেকে নানা ধরনের শব্দ আসছে হাওয়ায়। নতুন দিন শুরু হয়ে গেছে। সবাই যার যার কাজে লেগে যাচ্ছে। এসবকিছুই ছবির মতো মনে হয় সত্যব্রতর কাছে। মনের ভেতরে যেন গেঁথে আছে। নিত্যদিনের অতি পরিচিত আয়োজন এসব চলছে বছরের পর বছর ধরে। সব যেন অভ্যাসের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। এসবকিছু ছেড়ে চলে যেতে হবে দূরে কোথাও! অজানা বিভুঁইয়ে! এসব কথা মনে হলেই মনের ভেতরে যেন কোথায় একটা প্রচ- ভয়ের আবহ টের পান সত্যব্রত। চারদিক কেমন অচেনা হয়ে যেতে থাকে।
সত্যব্রত বুঝতে পারেন এ বাড়ির সবার মনের মধ্যেই এই ধরনের একটা ভয় আর অনিশ্চয়তার দোদুল্যমানতা কাজ করে যাচ্ছে। সরাসরি কেউ বলছে না। কিন্তু চোখের দৃষ্টিতে সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়। কাজে-কর্মে তেমন যে মন নেই, সেটাও বোঝা যায় চলাফেরার মধ্য দিয়ে।
কী করবেন সত্যব্রত? এ প্রশ্নটির উত্তর কিছুতেই যেন স্থির করতে পারেন না! আবার ভুল হয়ে যাবে না তো সবকিছুতে? এ-ও আরেক ভয়! পরে যদি সারা পরিবারটিই কোন না কোনভাবে বিপদের মুখে পড়ে যায়, তখন?
এটা তো ঠিক, এখানে সবাইকে নিয়ে যেমন আছেন, তাতে একটা স্বস্তি আছে। নিরাপত্তাও আছে। ওদিকে গিয়ে যদিÑ আর ভাবতে পারেন না সত্যব্রত। এই বয়সে এসে আজ আবার কোন এক পরীক্ষার মধ্যে পড়ে গেলেন সত্যব্রত। কেন না সবাই তো এক রকম তার বুদ্ধি বিবেচনা আর সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভরশীল হয়ে বসে আছে এখনও। পরিষ্কার করে কেউ কিছু বলছেও না তার মুখের ওপরে।
কী এ্যাতো ভাবতিছ, জেঠু! হাঁটুতে মৃদু ধাক্কা দেয় রেবতী। আমি যাইÑ বলতে বলতে দ্রুত নেমে যায় উঠোনে। তারপর দৌড় দেয় মাঠের দিকে। সত্যব্রত ভাবনার দায় দায়িত্ব নেই। আপন মনে ঘুরছে ফিরছে, দুষ্টুমি করছে পরিচিত মানুুষ আর পরিবেশের মধ্যে! এমন দিন আর কোনদিন ফিরে পাবেন না সত্যব্রত।
বুকচিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
দীর্ঘদিনের অভ্যাসে হঠাৎ যেন চিড় ধরে যায় সত্যব্রতর। এমন তো সাধারণত হয় না। ঘুমের সমস্যা তার কোনদিনই ছিল না। খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ার কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়াটাই এতদিনের অভ্যাস।
কিন্তু আজ যে কি হয়েছে, কে জানে! যথাসময়ে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ার পর মাথার মধ্যে এতসব চিন্তাভাবনা এলো যে ঘুমটা চটে গেল একসময়। কিন্তু চিন্তাভাবনার তো শেষ হলো না। আসলে সবটাই দুশ্চিন্তা।
এদিকে দিনে দিনে সংসারটা গেছে ছোট হয়ে। আগের মতো আর ভরা নেই। সত্যব্রতর স্ত্রী পার্বতী গত হয়েছেন, তাও বছর সাতেক হয়ে গেল। ছেলে একটা আছে শুভব্রত, সে থাকে কলকাতায়। মা মারা যাবার পর সেই যে কলকাতায় গেল আর ফিরল না। ওখানেই চাকরি-বাকরি করে। বিবাহও করেছে ওর ওখানে। কালভদ্রে আসে। বিয়ের সময় এবং পরে এসেছিল দুবার। তবে যোগাযোগটা রাখে বাড়ির সঙ্গে। ছিটমহলের ব্যাপার নিয়ে যখন কথাবার্তা চলছিল তখন শুভব্রত সোজাসুজি বলেছিল, এবারে ওখানকার পাট চুকিয়ে সবাই এদিকে চলে এসো। সুযোগ যখন হয়েছে, এই সুযোগটা নষ্ট কর না। বৌমাও কথায় কথায় শুভর কথায়ই সায় দিয়েছিল।
সত্যব্রত ভাবেন, আসলে মনের ভেতরে ছেলের প্রতি যে টান রয়ে গেছে তার কারণেই এদিকটা ছেড়ে ওদিকে যাবার ইচ্ছেটা দেখা দিয়েছে। পার্বতী বেঁচে থাকলে ছেলের টানে সেও একপায়ে রাজি হয়ে যেত ওদিকে যেতে।
এদিকে ছোট ভাই দেবব্রত যতই সত্যব্রতর কথায় সায় দিক কিন্তু পরে আবার অনিশ্চয়তার কথা বলে, অনাগত ভবিষ্যতে যদি অসুবিধা দেখা দেয় তখন তারা কোথায় যাবে? এ প্রশ্নও তোলে। সত্যব্রত এসব কথার মধ্য থেকে দেবব্রতর অনীহা ভাবটা ঠিক বুঝতে পারেন।
এসব নানা চিন্তাভাবনার মধ্যেই একসময় দুর্বল হয়ে বোধহয় নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন সত্যব্রত। ¯œায়ূর ওপর বেশি চাপ সহ্য হচ্ছিল না। কিন্তু ভোরের দিকে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল অদ্ভুত কিছু স্বপ্ন দেখে। চোখ খুলে দেখেন ঘর অন্ধকার।
রাত শেষ হয়নি। আন্দাজে বুঝলেন এখনও অন্ধকার থাকলেও ভোর হতে আর বেশি দেরি নেই। কিন্তু স্বপ্নে এসব কী দেখলেন সত্যব্রত। সেই নদীভাঙ্গন, সেই ঘরদোর ভেঙ্গে অন্য কোথাও চলে যাওয়া। এসব স্বপ্ন এখন কেন দেখলেন, সত্যব্রত বুঝতে পারলেন না। তাহলে কি অবচেতন মনের কোথাও থেকে উঠে এসেছে এসব স্বপ্ন এখন, যখন নতুন করে আবার ঘরদোর ভেঙ্গে অন্য কোথাও যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন সত্যব্রত!
বাকি রাতটুকু আর ঘুমাতে পারলেন না, মনের ভেতরে কেমন যেন তোলপাড় চলছে। খোলা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালেন, দূর আকাশে আলোর আভাস ফুটছে অন্ধকার সরিয়ে দিয়ে। শেষরাতের অতল নৈঃশব্দের মধ্যে এখন কেন জানি হঠাৎ পার্বতীর কথা মনে পড়ল সত্যব্রতর। সে পাশে নেই কতদিন! সে ঘুমিয়ে আছে এই মাটিতেই। তাকে ছেড়ে যেতেও তো মনে চাইছে না। মনে পড়ছে রেবতীর কথা, আশপাশের আরও অনেকের কথা। এদের সবাইকে, সর্বোপরি এই জন্মভূমিকে ছেড়ে আসলে কি কোনদিন দূরে কোথাও যেতে পারবেন সত্যব্রত?