ফেরা
গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব সাজ্জাদ কাদিরের গল্পগ্রন্থ ‘ফেরা’ প্রকাশ পায় ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। ‘ছায়াবীথি’ প্রকাশনের গ্রন্থটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন ইকরামুল হক শাকিল। ‘ফেরা’র দশটি গল্পের রূপকার সাজ্জাদ কাদির মূলত কলাম লেখক এবং প্রাবন্ধিক। দেশের সমকালীন বিষয় ছাড়াও জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্যের জোরালো সমর্থক ও আলোচক সাজ্জাদ কাদির ভিন্নমাত্রার শৈল্পিক দ্যোতনায় পাঠকদের সামনে হাজির হলেন।
সত্যিই অভিভূত এবং বিস্মিত হওয়ার অবস্থা বৈ-কি। তবে গল্পগুলো পড়তে গিয়ে আঙ্গিকের বৈশিষ্ট্য আর বৈচিত্র্যে সেই চিরাচরিত সমাজ, আশা-আকাক্সক্ষা আর ইচ্ছে অনিচ্ছের বিরোধ মূর্ত হওয়াও যেন ভেতরের জিইয়ে থাকা বোধের অনন্য বহির্প্রকাশ। তবে উৎসর্গ করার ব্যাপারটিও কেমন যেন চমকপ্রদ। সর্বাগ্রে পিতামাতাকে শ্রদ্ধায় নিবেদনে স্মরণ করা ছাড়াও প্রতিদিনের সঙ্গী দীপাকে বরমাল্য দেয়াও অভাবনীয় এক বার্তা তো বটেই।
আর একমাত্র সন্তান দীপকে অনুপ্রেরণার বাহক হিসেবে মর্যাদা দেয়া সেও যেন অভিনব এক অভিব্যক্তি। সত্যিই অনুভবের বিচিত্রতায় গল্পগুলোর সারবত্তাও যেন সমকালীন সমাজের চালচিত্রই শুধু নয় চিরকালীন প্রথারও এক অবিমিশ্র মিলন।
যুগ, কাল সময়কে অতিক্রম করেও কঠিন জীবন বোধে আধুনিকতাকে বরমাল্য দেয়া কতখানি কষ্টসাধ্য তা যেন বেদনায় জর্জরিত প্রতিটি গল্পের মর্মকথায়। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নত বাংলাদেশ এখনও পুরনো সমাজ সংস্কারকে কি মাত্রায় আঁকড়ে ধরে রেখেছে সেটাও সুনিপুণ নান্দনিক দ্যোতনায় স্পষ্ট হয়েছে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সুখ-দুঃখ আনন্দ বেদনাই শুধু নয় প্রচলিত নিয়ম সংস্কার মেয়েদের কতখানি দুর্বিষহ অবস্থায় নিয়ে যায় তা যেন গল্পকারকে বেদনাদায়ক অনুভবে বিমর্ষ করে দেয়। গল্পের নারী-পুরুষ সবাই যেন সমাজ ব্যবস্থার কঠিন নিগড়ে বাধা এক অচলায়তন বিধির নির্মম শিকার। সেই পুরাকালের বাল্য বিয়ে আর বিচ্ছিন্নতা কিংবা অকাল বৈধব্যের শক্ত বেষ্টনীতে আটকে যাওয়া যেন পরিস্থিতির মর্মস্পর্শী যাতনা।
গল্পকার নিজের মনমতো চরিত্র সাজাননি বরং তার শিল্পকর্ম নির্মোহ, নিরাসক্তভাবে তাকে যে গতিময়তায় পৌঁছে দেয় সেখানেই তার নির্মম পরিণতি পাঠকদের আকর্ষণ বাড়ায়। গল্পগ্রন্থের নামানুসারে ‘ফেরা’ একটু ব্যতিক্রমী মাত্রাও যোগ করে। গল্পের মূল চরিত্র পঞ্চানন গাইনের জীবন কাহিনী বিধৃত করতে গিয়ে তার সহপাঠীরা কোথায় গিয়ে পৌঁছেছেন সেটা যেমন আনন্দের পাশাপাশি পঞ্চাননের জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত তাকে কোথায় এনে দাঁড় করায় তারও এক দ্বৈত সত্তায় পাঠকরা দুঃসহ এক জীবনবোধে তাড়িত হয়।
কারণ সমাজ-সংস্কার সবাইকে একইভারে বাড়তে দেয়ই না। ঘাত-প্রতিঘাতের নির্মম বেড়াজালে কেউ সফলতার শীর্ষে পৌঁছায় কেউ বা টানাপোড়নের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়।
অন্যান্য গল্পগুলোতেও সামাজিক অভিঘাতের বেদনাদায়ক ঘটনা পরম্পরা। যা উন্নয়নের নতুন বিশে^ও আমাদের সমাজকে নানামাত্রিকে জগদ্দল পাথরের মতো চাপা দিয়ে রেখেছে। সব কিছু জানতে হলে ‘ফেরা’ গল্প সংগ্রহটি পাঠকদের পড়তে হবে।
জানতে হবে সমাজ ব্যবস্থার নির্মম জালে জড়িতরা কিভাবে তাদের যাপিত জীবনকে লড়াই সংগ্রামের মধ্যে এগিয়ে নিচ্ছে। থেমে থাকার কোন সুযোগই নেই। গল্পটির বহুল প্রচার এবং পাঠকপ্রিয়তা আশা করছি।