প্রতিশোধের অস্ত্র
সন্ধ্যাবেলার সময়টা ভাল না। এই সময়ে মানুষ বড় একাকী বোধ করে। বুকের মাঝে কেন জানি হু হু করে শোকের বাতাস বয়। তুলসীতলায় সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বেলে রাধারানীরও বুকের মাঝে এ রকম একটা বোধ হতে থাকে। কতক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল বলতে পারে না। হঠাৎ কর্কশ শব্দ করে উড়ে যাওয়া একটা পাখির ডাকে সংবিৎ ফেরে রাধারানীর।
কতগুলো দিন, না না- মাস হয়ে যায় কেউ নিশ্চিন্তে নিজের আঙিনায় বেরোতেও ভয় পায় ভীষণ। সেই কবে থেকে বর্গিরা এসে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করেছে দেশটায়। রাধার অবশ্য ভয়ডর নেই। কারণ ওদের এদিকটায় তেমন কেউ আসেই না বলতে গেলে। শ্বশুর মশায় নরেন পাল ছিলেন ভাবুক মানুষ। পালপাড়ার নানান হৈ হট্টগোল ভাল না লাগায় গাঁয়ের এই একদম শেষে এক টুকরো জায়গায় শান্তির নীড় বেঁধেছিল।
স্ত্রী গত হওয়ার পর নরেন পালকে সারাবেলা বাঁশি হাতেই হেথা হোথা বসে থাকতে দেখত গ্রামের লোকেরা। একমাত্র ছেলে ধীরেনের দিকেও খেয়াল ছিল না তেমন একটা।
রাধার বিয়ে হয়ে সংসারে আসার বছর দুয়েক পরে গত হয় নরেন পাল। এখন এই নির্জন জায়গায় ওরা দুটি মাত্র প্রাণী-রাধারানী আর ধীরেন পাল। দেশের যে অবস্থা তাতে ভয়ে রাধার বুক কাঁপে। এইতো গতকালই মোক্ষদা মাসী ভিক্ষে চাইতে এসে বলে গেল পাকিস্তানী হায়েনা সেনারা গঞ্জে এসে আস্তানা গেঁড়েছে। দলে দলে মানুষ মারছে আর নদীতে ভাসিয়ে দিচ্ছে। মানুষ যেদিকে যেভাবে পারছে পালাচ্ছে ঘটিভাটি-ভিটামাটি রেখে।
অনিশ্চিত ভবিষ্যত। এক বেলার ভাতের চালটুকুও নেই। ভিটেমাটি ছেড়ে প্রাণটুকু হাতে নিয়ে চলে যাচ্ছে সবাই। পলায়নপরদেরও সঙ্গে কি যেতে হবে আমাদেরও? ভাবতে ভাবতে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে রাধার। পুরনো ঘরের প্রায় ভাঙতে বসা ঘরের বেড়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। সেদিনই স্বামী ধীরেনকে জিজ্ঞেস করছিল, এবার পূজা হবিনে? ঘরডাও তো সারা লাগবি। এই ভাঙ্গা ঘরে মানুষ থাকতি পারে?
আর তোর পূজা আর ঘর সারা!
ক্যান কি হয়িছে?
শুনতে পাচ্ছিস না খান সেনা আর রাজাকারদের কারবার। মাঠে ধানগুলে পাকতিছে, সেগুলা ঘরে তুলবের পারব কিনা সেইডেই এহন একমাত্র চিন্তে। ধীরেনের এমন কথায় মন খারাপ হয় রাধার। তখনই মনে হয় আজ সাঁঝ গড়িয়ে আঁধার নেমে এলো, সেতো এখনও এলো না।
ও রাধা জল তোলা আছে? ধীরেনের হাঁক শুনে আশ্বস্ত রাধা, যাক তবুও তো কোন বিপদ হয়নি। ঘরের মানুষ ঘরে ফিরেছে।
ঝাঁ চকচকে কাস্তে দরজার পাশে বেড়ার ফাঁকে গুঁজে রাখতে রাখতে রাখতে তাকায় স্ত্রী রাধার দিকে, এইটে ধার করাতে গেছিলেম, সেইজন্যি দেরি হলো। কাল ধান কাটপ, ধান না কাটলে ভাত খাব কিভাবে? ধান কাটলেই না আমরা ভাত খাবের পারব।
বাড়ির পেছনের জঙলায় মুই ঘেঁচু খুঁজে পেয়েছি। ওগুলো কিছুদিন খেতে পারব, স্বামীকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে রাধা।
ধীরেন রাগ করে, সারাদিন জঙলায় ঘুরিস ক্যা? সাপখোপ আছে না?
সন্ধ্যার সামান্য আগে হাতমুখ ধুয়ে এসে কেবলই দুটো মুড়ি মুখে দিয়েছিল ধীরেন, বাইরে থেকে ডাক আসে- ও ধীরেন বাড়িত আছিস?
ধীরেন আর বৌ রাধারানী চুপ।
আবার গলা শোনা যায়, ও ধীরেন একটু বাইরে আয়। কথা ছিল।
ধীরেন অবাক, তাদের বাড়ির এদিকটায় তো এ সময় কোনদিন কেউ আসে না। আর এটা আক্কাস মুনশির গলা না? শয়তানটা এখন এখানে কেন? তাকায় রাধারানীর দিকে। ওর মুখ ভয়ে ফ্যাকাসে। কি করবে বুঝে উঠতে পারে না ধীরেন। আবার ডাকে আক্কাস মুনশি বড় মিষ্টি গলায়, ও ধীরেন বাইরে আয় একটু।
কিচ্ছু করার থাকে না ধীরেনের। দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসে। ছোট্ট উঠানে নেমে দেখে মুনশি একা আসে নাই সঙ্গে আরও চার পাঁচজন খাকি পোশাকের লোক, প্রত্যেকের হাতে অস্ত্র। লোকগুলো দেশী না। দেখেই চিনতে পারে, ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে শহরে গিয়ে আর্মি দেখেছে। যা বোঝার বুঝে নেয় ধীরেন।
আশপাশের অনেক হিন্দুকে ধরে নিয়ে গেছে আক্কাস মুনশি আর পাকিস্তানী আর্মিরা। সেই মানুষগুলো আর ফেরেনি। লোকমুখে শুনেছে, হিন্দুদের সবাইকে এরা নদীতে নামিয়ে কোমড় পানিতে দাঁড় করিয়ে গুলি মেরে দিচ্ছে। মানুষগুলো লাশ হয়ে পানিতে ভেসে যায়।
কাকা? কী মনে কইরে? ধীরেনের গলা দিয়ে শব্দ বের হয় না। শুকিয়ে গেছে মুখ।
আলাম তোগেরে দেখতে। আমাগে একটা দায়িত্ব আছে না? ও ধীরেন রাধারানী কনে? পশ্চিমা সাহেবরা ওর গান শুনবের আইছে। কত সুন্দর গান গায় তোর বউ। ডাকদিনি-
আক্কাসের কথায় গা জ্বলে ধীরেনের, কিন্তু সামলে নেয়, ও ঘরেই আছে, শরীর ভাল না কাকা। এখন ওসব গান-টান শুনাবের পারবি না। আপনেরা পরে আহেন।
কইস কি? তোর বৌ অসুস্থ? তালি তো তাক ভাল কইরে দেখা উচিত। চলেন সার আমরা ভেতরে যাই দেখি কিরাম বিমার হয়েছে আমাদের রাধারানীর।
যা বোঝার বুঝে যায় ধীরেন পাল। বেড়ায় সঙ্গে গেঁথে রাখা বাঁশের লাঠিটা একটানে হাতে তুলে নিয়ে হুংকার দিয়ে ওঠে, খবরদার এক পাও আগালি মাথা ফাঁক করে দিব।
সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তানী সৈনার অস্ত্র গর্জে ওঠে, ইয়ে মাবুদ! ইয়েতো মুক্তি হ্যায়!
নিজের বাড়ির নিজের উঠানে বুকের মধ্যে গুলি নিয়ে ছটফট করতে থাকে ধীরেন পাল। বিস্ফোরিত চোখে ঘরের বেড়ার ফাঁক দিয়ে এই ভয়ঙ্কর ঘটনাগুলো ঘটে যেতে দেখে রাধারানী। প্রাণপ্রিয় স্বামীর তরতাজা দেহটা কেমন ছটফট করতে করতে নিস্তেজ হয়ে যায় মাত্র মুহূর্তের মধ্যে। রাধা চিৎকার করতেও ভুলে যায়। পরমুহূর্তেই দেখে জানোয়ারগুলো এগিয়ে আসছে ঘরের দরজার দিকে। মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে ওঠে রাধার।
ঘরের মধ্যে পাকিস্তানী আর্মি ঢোকা মাত্র রাধারানী দরজার পাশে বেড়ায় গুঁজে রাখা ধারাল কাস্তে একটানে খুলে নিয়ে চালিয়ে দেয়, আরেক হাতে ছিনিয়ে নেয় আর্মির হাতের পিস্তল। কি ভয়ঙ্কর কাজ করছে জানে না রাধারানী। শুধু মনে হয় সামনে এক অসুর দাঁড়িয়ে রয়েছে এবং একে বধ করাই একমাত্র দায়িত্ব এখন। কি হলো না হলো দেখার জন্য না দাঁড়িয়ে থেকে রাধা ওই কাস্তে দিয়ে ঘরের পেছনের ভাঙ্গা বেড়াটা দুই কোপে কেটে নামিয়ে দিয়ে অন্ধকার জঙলায় ঝাঁপিয়ে পড়ে।
অমাবস্যার রাতের আঁধারেও এই জঙলা হাতের তালুর মতোই চেনা রাধার, সারাদিন এখানেই জঙলার মধ্যে ঘোরে। ঘুরতে ঘুরতে আগেরদিনই জঙলার মাঝামাঝি জায়গায় একটা আড়াল হয়ে থাকা গর্তে বেকায়দায় পড়ে গিয়েছিল। সেদিকেই এগিয়ে যায় ও। গর্তের মধ্যে লুকিয়ে থাকলে তাকে কেউ খুঁজে পাবে না।
আক্কাস মুনশি আর আর্মিদের চিৎকার চেঁচামেচি, দৌড়ঝাঁপ একসময় কমে আসে। হায়েনারা এদিকটায় বেশিদূর খোঁজাখুঁজি করার সাহস করে না। তবে অসুরটাকে যে খতম করতে পেরেছে এটাই সান্ত¡না। হঠাৎই রাধারানীর মনে হয়- স্বামী আমাকে ছেড়ে চলে গেল চোখের সামনে চিরতরে, ছটফট করতে করতে চোখের সামনে মানুষটা মারা গেল! আমার চোখ কেন শুকনো? কাঁদতে পারে না। ওর ভেতরে এক ভয়ঙ্কর শক্তি তৈরি হয়। যেন এক ভয়ঙ্কর আগুন, প্রতিশোধের আগুন।
রাত আরও গভীর হলে রাধারানী লুকানো জায়গা থেকে বেরোয়, চুপিসারে আগাতে থাকে। জানে আমাকে এখন কি করতে হবে! শহীদ ধীরেনের স্ত্রী রাধারানী মুক্তি যোদ্ধাদের খোঁজে এগুতে থাকে। দুর্দমনীয় গতিতে এগুতে থাকে। বাতাসে শারীর আঁচল উড়তে থাকে পতাকার মতো পতপত করে। আঁধারে জ্বলতে থাকে ওর চোখ অঙ্গারের মতো। হাতে একটি অস্ত্র-প্রতিশোধের অস্ত্র।
[সত্য ঘটনার ছায়া অবলম্বনে]