
.
আমরা যারা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের ভিতর থেকে উঠে এসেছি- তাদের শামসুর রাহমানকে মনে পড়তে হবে। আর এতো হাইজহোল্ড কবিতার কবি শামসুর রাহমান- কবিতার মধ্যে কতো হিরণ¥য় লাইন আছে তাঁর, তা-ও মনে রাখতেই হবে; তামাম দুনিয়ায় যে কবির এমন অসামান্য সব বইয়ের নাম হয়- তিনি শামসুর রাহমান। তাঁর কবিতা ভালো- একথা বলবার এখতিয়ার যাঁরা রাখেন- তাঁরা তো বলেইছেন, আমার কাছে মনে হয়, শামসুর রাহমানের কবিতার থেকে অধিক
ভালো তাঁর কবিতার নিয়ত। -বদরুজ্জামান আলমগীর
রাজনীতি ক্ষেত্রেও এতোটা জাজ্জ্বল্যমান প্রমাণ পাওয়া কঠিন হবে, যতোটা কূটনৈতিক হিসাবনিকাশের ভিতর দিয়ে শামসুর রাহমানের নসিব নির্ধারিত হয়েছে।
তৃতীয় বিশ্ব নামে যে হরিজন রাষ্ট্রগুলো ছিল- তাদের ডাকনাম থাকুক বা না থাকুক, তারা কিন্তু ইন রিয়াল লাইফে এখনও আছে। তো ওই দেশগুলোর কাঠামোর মধ্যে কিছু মায়াবী শঠতা আছে- ওখানে জনগণ নেতাদের কাছে তাদের নাগরিক অধিকার হিসাবে কিছু কার্যকর দেখতে চায় না, তারা বরং নেতৃত্বের কাছে দাক্ষিণ্য আশা করে, নানা উন্নয়ন প্রকল্পের আবদার জানায়।
লেখকদের কাছেও তারা মনন চায় না- চায় মনের খোরাকি, আশা করে নানা কায়দার আঁখিজল মিশানো প্রেমপত্র; প্রত্যাশা করে নিজের উপর প্রতিরক্ষার ছাউনি, প্রতিপক্ষের দিকে বজ্রপাত। কখনও কখনও আছে তীব্র জাতীয়তাবোধ, তার উপর নিজের দলকে দেখানো দেশপ্রেমের জগদ্দল।
নানা চড়াই-উতরাই, আগ-পিছ করে বলা যাবে- শামসুর রাহমান সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী কবি; পাকিস্তানি স্বৈরাচারকালে যাত্রারম্ভ, বাঙলাদেশের আভ্যন্তরীণ স্বৈরাচারে তার খ্যাতি, জয়ময় ও বিস্তার। শামসুর রাহমানের সমপর্যায়ে দ্বিতীয় আরেকজন কবির নাম করা যাবে না- যিনি এই জনপদের প্রতিটি পাশ ফেরায়, উত্থানে পতনে, বাঁকে, মোড়ে বাতিওয়ালার দিগ্বলয়ে এমন ঠাঁই নির্ঘুম জেগে আছেন!
কিন্তু পরিহাস এখানে যে, তাঁর মৃত্যুর ৪০ দিনও পার হয়নি- বাঙলা কবিতার বহু নকশাকার, কবি, সমালোচকদের কাছ থেকে রাহমান প্রায় নাই হয়ে যান। সাম্প্রতিক কবিতার অনেক সেলেব্রিটি স্টার কবি, উত্তরাধুনিক তাত্ত্বিকের মুখে আল মাহমুদের নাম শুনি, কিন্তু শামসুর রাহমানের কথা বললে বুঝি তাদের মারাত্মক শিল্পবোধের ওজু নষ্ট হয়ে যায়।
শামসুর রাহমান তাড়াহুড়ো করেছেন, একই কবিতা বারবার লিখেছেন- একথা সত্য, বাহুল্য ও ক্যাটালগিং আছে লাগামহীন। কিন্তু তাঁকে এই ঝুঁকিটা বারবার নিতে দেখা যায়- যেখানে কবিতাটা কেবল ব্যক্তির একান্ত আকুতির অভিব্যক্তি থাকে না, বরং পুরো জনপদ একসাথে বসে পুঁথির মতো তা পড়তে পারে। শামসুর রাহমানের দুর্ভাগ্য এখানেই। তিনি ডকু পোয়েটিকস করেছেন- এমন আর অন্য কোন কবিকে করতে দেখি না। এই একান্নবর্তিতার মধ্যে একটি নজরুলীয় ধারার মোলাকাত পাই। টেরাকোটা অঙ্কিত একটি সরু গলিই কবিতার উত্তীর্ণতার একমাত্র সারকথা হতে পারে না, সফলতার শিরোপা কখনও কখনও আরো হয়তো ভিতরে- একটি জনপদের সমন্বিত নিঃসঙ্গতার সংবেদে রোপিত- শামসুর রাহমানের কবিতায় এমন একটি প্রত্যয়জুড়ে দেয়া আছে।
শামসুুর রাহমানের যে কবিতার একটা সহজাত ক্ষমতা ছিল- তা কারো পক্ষেই অস্বীকার করা সম্ভব নয়। তাঁর সত্যিকার অসাম্প্রদায়িক মানবিক মূল্যবোধ ও তজ্জনিত মায়া অন্য আরেকজন কবির মধ্যে খুঁজে পাওয়া কার্যতই অসম্ভব। তিনি কেবল কাব্যবিশ্বাসের কবি নন, তিনি বাস্তবিক সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে তাঁর বিশ্বাসটুকুর বাস্তবায়নও দেখতে চাইতেন। তাঁর সততা ও সফলতা এখানে, আবার কবিতার ডিসকোর্সে বিফলতার সূত্রও এখানেই জাগর।
শামসুুর রাহমানের মুছে যাবার একটি বড় কারণ সামরিক স্বৈরাচার হটে যাবার পর গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সত্যিকার গণতন্ত্রের চর্চা না থাকা, গণতন্ত্রের নামে লাগাতার একক বা পারিবারিক অমানবিক দলখোর রাজনৈতিক, সামাজিক প্রক্রিয়া চালু থাকার ভিতর নিহিত আছে। শামসুর রাহমান তাঁর আশা প্রকল্পে বাঙলার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর যে মানসিক, বৌদ্ধিক বিন্যাস আশা করেছিলেন- আসলে তা ছিল না। তাই দিনকে দিন তিনি হয়ে উঠেছেন এক নো ম্যান’স ল্যান্ডের কবি।
গণতান্ত্রিক রাজনীতি সামরিক শাসনের উপর তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে পারেনি। স্বৈরাচারবিরোধী লড়াইয়ের অবিসংবাদিত বীর নূর হোসেন, তাজুুল ইসলাম, সৈয়দ আমিনুল হুদা টিটো, রাউফুন বসুনিয়াসহ অগণিত শহীদ মর্যাদাপূর্ণ সাংস্কৃতিক আদলে গৃহীত হয়ে ওঠেননি। এটি পুরো জাতিগোষ্ঠীর ওঠানামা, প্রস্তুতির উপর নির্ভর করে; কবি হিসাবে শামসুর রাহমানের গ্রহণ-বর্জনও একই অভিবাদনের জন্য অপেক্ষা করে। সামরিক স্বৈরাচারকে মানুষ অন্তত প্রাণ খুলে গালি দিতে পারতো, কিন্তু গণতন্ত্রের জমানায় তাদের অসন্তোষ জানানোর অধিকারটুকুও খোয়া গ্যাছে।
আল মাহমুদ খুব ভালো কবি, কেউ কেউ তাঁকে পাথেয় করবেন- তাতে কোন সমস্যা নাই, কিন্তু শামসুর রাহমান থেকে যাচ্ছেন সদ্য স্বাধীন জনপদের পথের দাবি হিসাবে। লোকজ বাঙলার আনাজপাতি, গান, গীতরঙ্গ পরম মমতায় উঠে আসবে বাঙলা কবিতার হৃদস্পন্দনে, একটা পূর্ববঙ্গীয় বয়ান ধারা গড়ে উঠবে- এ আমাদের সবারই মনোবাঞ্ছা। জনমিতির অঙ্কে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের আয়ু ও মরমিয়া কবিতায় উঠে আসবে, আসতেই হবে। কিন্তু তা বাঙালি ক্ষমাসুন্দর মুসলমানের জীবন ও দুনিয়া, তা কোনভাবেই মধ্যপ্রাচ্যের শেখ সংস্কৃতি হতে পারে না।
এখানেই একটি শঙ্কা দানা বেঁধে ওঠে- কেবল কাব্যগুণের ঘাটতিই শামসুর রাহমান অগৃহীত থাকার সত্যিকার কারণ নয়, এখনকার কবিগণ, কাব্য ব্যাখ্যাকারগণ বাঙলাদেশ জনপদের প্রাণের মন্ত্রটির স্ফুরণ ঘটানোর ঝুঁকি নিতে বারবার পিছিয়ে থাকেন- আসল কারণ সেটি।
সারারাত ধরে বিধ্বস্ত নীলিমার নিচে ক্ষরিত স্বদেশের শরীর থেকে প্রতি প্রহরে কুটেকুটে সুই তুলেছেন শামসুর রাহমান, কিন্তু রাজকুমার গেছে অন্য কারো ঘরে।